দেশে যেভাবে ফেরত আসবে পাচার হওয়া টাকা ! Bangladesh Corruption and Money Laundering | Business Mania
গত ১৬ বছরে বাংলাদেশ থেকে ঠিক কত টাকা পাচার হয়েছে, সেটা শুনলে হয়তো যে কারো চোখ কপালে উঠবে ! ডি জি এফ আই (Directorate General of Forces Intelligence) এর তথ্য অনুযায়ী, গত ৫০ বছরে দেশ থেকে প্রায় ১১ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। অঙ্কটা যে কত বড় তার একটি উদাহরণ হচ্ছে এই পরিমাণ টাকা দিয়ে আমরা কমপক্ষে ২০টি পদ্মা সেতু, ১০ টি মেট্রো রেল তৈরি করা যেত এবং অনায়াসেই মিটিয়ে ফেলা বৈদেশিক সব ঋণ । যা খুবই আশ্চর্যকর।
আজকে এই ব্লগ পোস্টে আমরা আলোচনা করবো কীভাবে এতো বিপুল পরিমাণ টাকা দেশ থেকে পাচার হয়ে চলেছে , পাশাপাশি কারা এর সাথে জড়িত এবং কীভাবে এই টাকা দেশে ফেরত আনা যেতে পারে।
মানি লন্ডারিং (Money Laundering) বা অর্থ পাচার কি ? অর্থ পাচার বলতে বোঝায় অবৈধভাবে অর্জিত অর্থকে বৈধ হিসেবে প্রদর্শনের বা এক কথায় কালো টাকা বিদেশে নিয়ে সাদা করতে পারার প্রক্রিয়া।
মূলত, তিনটি ধাপে করা হয়ে থাকে মানি লন্ডারিং। যে তিনটি ধাপ পার করতে হয় তাকে বলে Stage of Money Laundering. অবৈধ অর্থ কিংবা সম্পদকে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ঢোকানোর মাধ্যমে শুরু হয় মানি লন্ডারিং। এটি হতে পারে ভুয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কিংবা ডিপোজিটের মাধ্যমে ব্যাংকে বিপুল অঙ্কের টাকা জমা রাখার মাধ্যমে, অর্থনীতির পরিভাষায় এ ধাপটি পরিচিত ‘Placement’ নামে। এরপর শুরু হয় লেনদেন। অর্থাৎ প্রাথমিকভাবে অর্থ ব্যাংকে ‘প্লেসমেন্ট’ করা হলে তা একটি অ্যাকাউন্ট থেকে ক্রমান্বয়ে শত শত ভুয়া অ্যাকাউন্টে লেনদেন শুরু করা হয়। এ ধাপকে বলা হয় ‘Layering’। আর শেষ ধাপটি পরিচিত ‘Integration’ বা সমন্বয়করণ নামে। অর্থাৎ এ ধাপে পুরো অবৈধ সম্পদটিকে বৈধভাবে বিনিয়োগ করা হয়। ফলে অবৈধভাবে আয়ের মাধ্যমে অর্জিত টাকাকে শনাক্ত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
টাকা পাচারের পুরো বিষয়টা যেহেতু অবৈধ পন্থায় হয়ে থাকে সেজন্য এর সঠিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া মুশকিল। খুব প্রচলিত হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো। আমদানির ক্ষেত্রে যেটা করা হয়, কোন একটি পণ্যের দাম যত হবার কথা তার চেয়ে বেশি দাম দেখিয়ে টাকা পাচার করে দেয়া হয়
বাণিজ্য কারসাজির মাধ্যমে যখন কোন পণ্য আমদানি করা হয়,তখন কম দামের পণ্যকে বেশি দাম দেখানো হয়, ফলে অতিরিক্ত অর্থ দেশের বাইরে থেকে যায়। একইভাবে রপ্তানির ক্ষেত্রে বেশি দামের পণ্যকে কম দাম দেখিয়ে অতিরিক্ত অর্থ দেশে আনা হয় না।
এসব পাচারকৃত অর্থগুলো সাধারণত গোপনীয় ব্যাংকিং সিস্টেমে (Confidential Banking Systems) চলে যায়। বিভিন্ন দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমে যেমন সুইজারল্যান্ড (Switzerland), সিঙ্গাপুর (Singapore), এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের (United Arab Emirates) মতো দেশগুলোতে বেশি অর্থ পাচার হয়ে থাকে।
সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকিং সিস্টেম (Switzerland’s Banking System) তাদের গোপনীয়তার জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত। অনেক সময়, এই পাচারকৃত অর্থ বিলাসবহুল পণ্য (Luxury Goods) যেমন, রিয়েল এস্টেট (Real Estate) বা প্রিমিয়াম সম্পত্তি (Premium Properties) এবং ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হয়।
অন্যান্য দেশে যেমন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, এবং কানাডার প্রপার্টি মার্কেটে প্রচুর পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা হয়, যা বৈধ সম্পদের আড়ালে অর্থ পাচারের একটি উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর এই অর্থের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে সম্পদ গড়ে তোলা হয়, যা দেশের অর্থনীতি থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। বাংলাদেশের অর্থ পাচারের ইতিহাস খুবই আলোচিত এবং কুখ্যাত। গত ১৬ বছরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্থায়ী হয়ে রয়েছে।
প্রথমেই আসা যাক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের অনুযায়ী, শেখ হাসিনার ওপর অর্থ পাচারের নানা অভিযোগ উঠে এসেছে । যা রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বিরাট আলোচনা সৃষ্টি করেছে।
তার ছেলে, সজীব ওয়াজেদ জয়, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা, তাকেও কিছু সময় অর্থ পাচারের সাথে জড়িত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন মিডিয়ায় তার নাম অর্থ পাচারের আলোচনায় বারবার উঠে এসেছে। জয়ের বিরুদ্ধে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা বিভিন্ন চুক্তির মধ্যস্ততা কারি হয়ে পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া, বাংলাদেশের অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের নামও অর্থ পাচারের সাথে জড়িয়ে আছে। ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, এবং সরকারি কর্মকর্তাদের নাম বারবার উঠে এসেছে। দেশের অর্থনীতি থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ এভাবে পাচার হওয়ার ঘটনা ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে ।
রাশিয়ার ভূমিকা বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এই ১২.৬৫ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পে রাশিয়া ৯০ শতাংশ অর্থায়ন করছে । তবে, কিছু রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে, রাশিয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ৫০০ কোটি ডলার সহায়তা করেছে মালয়েশিয়ার ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে।
তাছাড়া, শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সাথে বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তির মধ্যস্থতা এবং পারমাণবিক কেন্দ্রের চুক্তির আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার অভিযোগ রয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে তিনি নিয়মিতভাবে শেখ হাসিনার কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করছেন ।
কিন্তু শুধু তাই নয়, একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের মাত্র ছয় মাস আগেও ক্রেমলিনে টিউলিপের গোপন বৈঠকের খবরও প্রকাশিত হয়েছে, যা এই লেনদেনের স্বচ্ছতা ও অখণ্ডতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে উদ্বেগের সৃষ্টি করে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে মানি লন্ডারিং এ দেশের অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব পড়ে?
দেশের বাইরে যখন এসব টাকা পাচার হয় তখন কৃত্রিমভাবে ডলারের দাম বেড়ে যায় এবং দেশের মুদ্রা অস্থিতিশীল হয়ে উঠে। যে টাকাটা দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে সেটা দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না। যদি দেশে বিনিয়োগ হতো তাহলে কর্মসংস্থান বাড়তো । টাকা পাচারের ঘটনা কেবল অর্থনৈতিক নয়, দেশের জনগণ এর জন্য এক হুমকির ব্যাপার ।
যখন এত বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে চলে যায়, তখন দেশের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে বড় প্রভাব পড়ে। স্কুল, হাসপাতাল, রাস্তা নির্মাণ, কৃষি উন্নয়ন—এসব ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় তহবিলের ঘাটতি দেখা দেয়। এর ফলে দেশের গরিব এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তাছাড়া, দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে বিদেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যারা সততার সাথে প্রবাসে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন, তাদের উপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে, যা বিদেশি বিনিয়োগের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
কীভাবে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশে ফেরত আনা সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় উভয় প্রেক্ষাপটে নজর দিতে হবে।
বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশের বাইরে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার জন্য আন্তর্জাতিক আইনি প্রক্রিয়া এবং দ্বিপাক্ষিক চুক্তি গঠন করা হয়েছে।
নাইজেরিয়া এবং মালয়েশিয়া এর মতো দেশগুলো প্রমাণ করেছে যে কূটনৈতিক ও আইনি প্রচেষ্টার মাধ্যমে দেশের পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা সম্ভব।
নাইজেরিয়া এবং মালয়েশিয়া উভয়েই কূটনৈতিক চাপ, আন্তর্জাতিক আইন, এবং বৈশ্বিক সহযোগিতা ব্যবহার করে পাচারকৃত অর্থ সফলভাবে ফেরত এনেছে। তারা দীর্ঘমেয়াদী আইনি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে এবং অন্যান্য দেশের সাথে সমন্বয় করে চুরি করা সম্পদ ফেরত আনে ।
বাংলাদেশেও এই ধরনের প্রচেষ্টা করা সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক ইচ্ছা, শক্তিশালী আইনি কাঠামো, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। আন্তর্জাতিক আদালত (International Court) এবং ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্সের (Financial Action Task Force) মত প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ সরকার এই অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে।
এছাড়া, দেশের ভেতরে দুর্নীতি ও অর্থ পাচার রোধে কঠোর শাস্তির বিধানও কার্যকর করতে হবে। কঠোর তদন্ত, আইন প্রয়োগ, এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা ছাড়া এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
একটি বিশেষ উদ্যোগ হতে পারে দেশের সম্পদ ফেরত আনার জন্য একটি বিশেষায়িত সংস্থা গঠন করা। এই সংস্থা দেশের এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আইনি লড়াই চালাবে এবং বিদেশি আইনজীবী ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তায় হারানো অর্থ পুনরুদ্ধারের কাজ করবে।
বাংলাদেশের অর্থ পাচার একটি ব্যাপক সমস্যা , যা আমাদের জাতির ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে ও আমদের অর্থনীতিকে ক্রমান্বয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে । তবে, আমরা এখনও এটি প্রতিহত করার ক্ষমতা রাখি। এখনই সময় আমাদের এই সমস্যা রোধে শক্ত পদক্ষেপ গ্ৰহণ করা ।
সরকারের কঠোর পদক্ষেপ, আইনগত প্রচেষ্টা, এবং জনগণের সচেতনতা—এই তিনটি হাতিয়ার যদি সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়, তবে আমাদের হারানো অর্থ ফেরত আনা সম্ভব।
পাচারকৃত কোটি কোটি টাকা কি দেশের কল্যাণে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে ? জানিয়ে দিন আপনার মতামত ব্লগের কমেন্ট সেকশন এ ।
ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে মন্তব্য জানান কমেন্ট বক্সে, পরবর্তি ব্লগ পড়তে বিজনেস ম্যানিয়ার নিউজলেটারটি সাবসস্ক্রাইব করুন।