মিল্ক ভিটার যাত্রা ও উত্থান | Milk Vita History & Rise
দেশের স্বাধীনতা লাভের পরের সময়গুলোতে দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ (Milk Process)শিল্প নিয়ে বেশ ঝামেলার সৃষ্টি হয়। কেননা একে দেশ তো কেবলমাত্র দখলদার পাকিস্তানি হায়নাদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে, তার উপর এই নয় মাসের যুদ্ধে গ্রামের পর গ্রাম একদম উজার করে দিয়েছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনি। কত যে ছোট বড় শিল্প কারখানা থেকে শুরু করে ছোট ছোট সব ব্যবসা উজার করে দিয়েছিল তার কোন সঠিক হিসেব দেওয়া কারো পক্ষেই একদম সম্ভব ছিল না।
এসব কারণে দারিদ্র্য সীমারও বেশ নিচে চলে গিয়েছিল। সেই সাথে দেশের মানুষের জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টির যোগান দেওয়াও কঠিন হয়ে পরে।
এমন একটা সময় এসেও সবার আগে দেশের মানুষের পুষ্টির চাদিহার জোগান দেওয়া ছিল সব সময় তৎকালীন সরকারের প্রথম লক্ষ্য। সরকার লক্ষ্য করে যে পুষ্টির চাহিদা পূরনে গরুর দুধের কোন বেশ ভাল বিকল্প । কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তি অবস্থায় শহরে থাকা মানুষদের কাছে গরুর দুধের নাগাল পাওয়া যেমন ছিল কষ্টসাধ্য তেমনি গ্রামে যারা গরু পালন করত তাদের জন্য ও গরু রক্ষনা বেক্ষন কষ্টসাধ্য হয়ে পরে। কেননা গরু যে দুধ দিতো সেগুলো বাজারে বিক্রি করার সুযোগ সে ভাবে ছিল। সংরক্ষনের পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকায় প্রচুর নষ্ট হত। আর এই পুরো ব্যাপারটাই বেশ ভালোভাবে লক্ষ্য করেন তৎকালীন সরকার প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।
তিনি এমন একটা সমবায় প্রকল্প হাতে নেন যার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন গ্রামের মানুষ যারা গরু লালন পালন করেন তাদের থেকে ন্যায্য দামে দুধ কিনে এরপর সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করে শহরে বিক্রি করা হত। এতে লাভ হতো দুটো, গ্রামের মানুষরা যেমন দুধের ন্যায্য দাম পাবে তেমনই শহরের মানুষ গরুর দুধের চাহিদা পূরন হবে।
এরই লক্ষ্য ১৯৭৩ সালে দুটো খামার নিয়ে মিল্কভিটা(Milkvita) নামে দেশের মানুষের পুষ্টির চাহিদা পূরন আর একই সাথে দারিদ্রতা দূরীকরণ এর লক্ষ্য একটা সমবায় প্রকল্প শুরু করা হয় । বলতে গেলে এই মিল্কভিটা প্রকল্পটা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ব্রেইন চাইল্ড। দেশ স্বাধীনতা লাভের অনেক আগেই তিনি এমন একটা প্রকল্পের কথা ভেবেছিলেন।
তবে যে দুটো খামার নিয়ে এই মিল্কভিটার যাত্রা শুরু হয়েছিলো, সেগুলোর গোড়াপত্তন ও হয়েছিল আরো অনেক আগে। বলতে গেলে ব্রিটিশ আমলের শেষের দিকে এসে।
মোহাম্মদ মোখলেসুর রহমান নামের এক ব্যাক্তি ১৯৪৬ সালে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে একটা দুধের খামার তৈরী করেন । সে সময় সিরাজগঞ্জের সাথে কলকাতার রেল যোগাযোগ বেশ ভালো ছিল। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, গরুর দুধগুলো কিছুটা প্রক্রিয়াজাত করে কলকাতায় রেলযোগে নিয়ে বিক্রি করবেন। তিনি তার খামারের নাম দেন মিল্কভিটা। এরপর পরই ওই সময়টাতেই মিল্কভিটা দৈনিক প্রায় ২ হাজার লিটার দুধ কলকাতায় পাঠানো হত।
তবে এর দু বছর পর এসে দেশ ভাগের পর মিল্কভিটার ভাগ্যের ও কিছুটা পরিবর্তন ঘটে সেই সাথে এর মালিকানায় ও। ১৯৫২ সালে ইস্টার্ন মিল্ক প্রোডাকশন লিমিটেড নামের একটা কোম্পানি মিল্কভিটা কিনে নেয়। পরবর্তীতে যদিও ১৯৬৫ সালে এসে ইস্টার্ন মিল্ক প্রোডাকশন সরকার এর সাথে মিলে ইস্টার্ন মিল্ক প্রোডাকশন কোপারিটিভ নামে কাজ করা শুরু করে৷
একদিন নির্বাচনের প্রচারণা শেষ করে ঢাকায় ফিরছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। সে সময় বাঘাবাড়ি ফেরিঘাটে আসলে তিনি লক্ষ্য করেন। যে এই এলাকায় গরু পালনের হার সাধারণের তুলনায় অনেক বেশি৷ এবং ফেরি পার হতে আসা স্থানীয়দের প্রায় প্রত্যেকের কাছেই ছিল একটা গরু। এখান থেকে তিনি এই ইস্টার্ন মিল্ক প্রোডাকশন লিমিটেড এর ব্যাপারে জানতে পারেন। এবং ঠিক করেন যে দেশ স্বাধীন হলে আমুল (Amul) এর মতো বিশাল একটা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশেও তৈরী করবেন।
এরপর দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭৩ সালে এসে দেশের মানুষের পুষ্টির চাহিদা পূরন আর দারিদ্র্য দূরীকরণ এর লক্ষ্যে এই মিল্ক ভিটা আর আরো দুটি খামারকে নিয়ে একটা সমবায় উন্নয়ন প্রকল্প চালু করেন। যেটার নামকরণ করেন মিল্কভিটা নামেই৷
শুধুর দিকে ১৯৭৩ থেকে ৭৮ এই পাঁচ সাল ব্যাপি প্রকল্প হাতে নেয় মিল্কভিটা। পাবনা, টাংগাইল, মানিকগঞ্জ আর ফরিদপুরে কারখানা তৈরী করা হয়৷ উদ্দেশ্য ছিল এইসব জেলার আশে পাশের অঞ্চল হতে দিনে দুবার করে গ্রামের মানুষদের কাছ থেকে গরুর দুধ সংগ্রহ করা হবে।
এরপর সেগুলা বিভিন্ন মাধ্যমে এই পাবনা, টাংগাইল৷ মানিকগঞ্জ আর ফরিদপুরে নিয়ে আসা হবে। এরপর সেগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করে ট্যাংকারের মাধ্যেমে ঢাকায় নিয়ে আসা হবে। তারপর প্যাকেটজাত (packaging) করে বিক্রি করা হবে।
শুরুর দিকে মিল্কভিটা কেবল তরল দুধ, গুড়া দুধ বাজারে আনলেও সময়ের সাথে সাথে চাহিদার কথা মাথায় রেখে মিষ্টি দই, টকচ্ ঘি এসব পণ্য ও বাজারে আনা শুরু করে। আর বর্তমানে মিল্কভিটার প্রায় ২৭টির মতো পণ্য বাজারে রয়েছে। এরমধ্যে যেমন রয়েছে বিভিন্ন মিষ্টি, সন্দেশ তেমনই রয়েছে সুস্বাদু কেক ও।
শুধু তাই নয় বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জেলাতে সম মিলিয়ে ৫০টির মতো কারখানা রয়েছে মিল্কভিটার।
এছাড়াও ২০০৯ সালের দিকে যেই মিল্কভিটার প্রডাকশন ক্ষমতা ছিল প্রায় ৮ লাখ লিটার দুধ এক দশকের মাথায় অর্থাৎ ২০১৯ সালের দিকে এসে তা দাড়িয়েছে প্রাত ৯৫ লাখ লিটারে।
আর এভাবেই বর্তমানে দেশের মানুষের দুধের চাহিদার সিংহভাগ পূরন করে যাচ্ছে মিল্কভিটা।
ব্লগটি আপনাদের কাছে কেমন লাগলো তা কমেন্টে জানাবেন । সাম্প্রতিক বিষয়গুলো নিয়ে প্রতিদিন আপডেট পেতে চাইলে নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করে ফেলুন।