মেঘনা গ্রুপের লক্ষ কোটি টাকার দুর্নীতি! Meghna Group Corruption | Business Mania
সামান্য লবণ বিক্রেতা থেকে দেশের অন্যতম সেরা উদ্যোক্তা হিসেবে উঠে আসা মেঘনা গ্রুপের মালিক মোস্তফা কামালের জীবনগল্প সত্যিই চমকপ্রদ। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি নিজেকে শূন্য থেকে শীর্ষে নিয়ে গেছেন। তাঁর সাফল্যের গল্প যেন কোনো রূপকথার মতো। এটি মোস্তফা কামালের সাফল্যের দৃশ্যমান দিক।
কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠে রয়েছে অন্য এক বাস্তবতা—যেখানে টাকার পাচার, শুল্ক ফাঁকি, কারসাজি, জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে। সততার মোড়কে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে হলেও, দুর্নীতি ও অনিয়মের পথে তিনি একটি শিল্প গড়ে তুলেছেন। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের তথ্য-উপাত্ত বলছে, ৭০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠানের মালিক মোস্তফা কামাল মূলত অবৈধ উপায়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদ সংগ্রহ করেছেন। গত ২০ বছরে তিনি অন্তত এক লাখ কোটি টাকা পাচার করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে, যার মধ্যে ৮০ হাজার কোটি টাকা আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পাচার করা হয়েছে। এর পাশাপাশি শুল্ক, কর ও ভ্যাট ফাঁকির অঙ্কও বিশাল। টাকা পাচারের অভিযোগ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) উচ্চতর তদন্তের জন্য অভিযোগ জমা পড়েছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, দুদক ও এনবিআরের তৈরি নথিপত্র থেকে এসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
আজকের বিজনেস ম্যানিয়া (Business Mania) ব্লগ পোস্টে আমরা তুলে ধরব মেঘনা গ্রুপের উত্থান এবং এর সঙ্গে জড়িত নানা অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা।
মেঘনা গ্রুপের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৭০-এর দশকে, প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামালের হাত ধরে। কুমিল্লার এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া কামাল এর বাবা ছিলেন সাধারণ সরকারি চাকুরে। একান্নবর্তী পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুটির লেখাপড়ায় হাতেখড়ি গ্রামেরই এক পাঠশালায়।কিশোর বয়সে বাবার উপর অভিমান করে ঢাকা আসেন তিনি এবং চাকরি নেন চকবাজারে।শত প্রতিকূলতার মধ্যেও স্নাতক ডিগ্রি (Degree) অর্জন করতে সক্ষম হন। ব্যবসার প্রেরণা কিন্তু পান অনেক আগেই, চাচার কাছ থেকে। গ্রামের সাপ্তাহিক হাটে তাঁর চাচা সুপারির ব্যবসা করতেন। মোস্তফা কামাল বিকালে কিংবা সন্ধ্যায় চাচার সুপারির ব্যবসায় সময় দিতেন। সেখান থেকেই ব্যবসার প্রতি তাঁর ঝোঁক সৃষ্টি হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি সীমান্ত বর্তি এলাকা হতে লবন ও কেরোসিন তেল বিক্রি করতেন।
যুদ্ধশেষে ঢাকায় ফিরে এসে চাকরির পাশাপাশি তিনি টুকটাক ব্যবসা শুরু করেন। ঘুরতে থাকেন এ-জেলা ও-জেলায়। তবে সাফল্যের এই যাত্রা সহজ ছিল না। সদ্য স্বাধীন দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ছিল অস্থিতিশীল, যার মধ্যে দুর্বল অবকাঠামো এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই চ্যালেঞ্জ নিতেই তিনি নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ঘাট এ কিছু জমি কিনে মেঘনা গ্রুপ (Meghna Group) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৯ সালে মেঘনা গ্রুপ (Meghna Group) প্রথম যে শিল্পে হাত দেয় তা ছিল ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনারি (Vegetable Oil Refinery)।
১৯৮০-এর দশক থেকে মেঘনা গ্রুপ (Meghna Group) অন্যান্য সেক্টরে প্রবেশ করতে শুরু করে। সিমেন্ট খাতে তাদের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আসে ২০০০ সালের দিকে। এখানে তারা ‘মেঘনা কেম ’ এবং ‘ইউনিক সিমেন্ট (Unique Cement)’ এর মতো ব্র্যান্ডগুলোর মাধ্যমে দেশের শীর্ষ সিমেন্ট প্রস্তুতকারকের জায়গা দখল করে নেয়। পাশাপাশি কনজিউমার গুডস (Consumer Goods) বিভাগে তাদের পরিচিত ফ্রেশ (Fresh), No 1, এবং পিউর (Pure) এর মতো ব্র্যান্ডগুলো দেশের প্রতিটি ঘরে ছড়িয়ে পড়ে, যা খাদ্যপণ্য, বোতলজাত পানি, এবং রান্নার লবণ প্রভৃতির সরবরাহ করে।
শিপিং (Shipping) খাতে, মেঘনা গ্রুপ (Meghna Group) দেশের অন্যতম বৃহত্তম শিপিং (Shipping) ও শিপবিল্ডিং (Shipbuilding) কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৯০-এর দশকে শিপবিল্ডিং এবং শিপব্রেকিং (Shipbreaking) সেক্টরে তাদের বিনিয়োগ বাড়ে। এই সময়ে তারা বড় ধরনের ব্যবসায়িক উদ্যোগ নেয় এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের সাথে অংশীদারিত্বও করে। উল্লেখযোগ্যভাবে, তারা বহু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করে, যা তাদের বৈশ্বিকভাবে আরো শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যায়।
এছাড়াও, মেঘনা গ্রুপ (Meghna Group) একাধিক অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং কারখানা প্রতিষ্ঠা করে, যার মধ্যে Meghna Economic Zone এবং Meghna Pulp and Paper Mills অন্যতম। সম্প্রতি তারা প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার (Billion Dollars) বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন খাতগুলোতে প্রবেশ করেছে, যেমন Poly Vinyl Chloride, কেমিক্যালস (Chemicals), এনার্জি (Energy), এবং বেভারেজ (Beverage) খাতে।
মেঘনা গ্রুপের ব্র্যান্ড ‘Fresh’ দেশের অন্যতম জনপ্রিয় বেভারেজ ব্র্যান্ড (Beverage brand) । পানীয় জল, ফলের রস, এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত পানীয় পণ্য তাদের ব্র্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত। Fresh ব্র্যান্ডটি শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও নিজেদের প্রভাব বিস্তার করছে। তারা দেশের অন্যতম শীর্ষ খাদ্যপণ্য প্রস্তুতকারী হিসেবে নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছে।
আর তাদের এই বিপুল সম্পদ এবং ব্যবসায়িক শক্তি তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী করে তুলেছে। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্ক তৈরি করে, যা তাদের ব্যবসার স্বার্থে সহায়ক হয়েছে। স্থানীয় সরকার এবং জাতীয় নির্বাচনে তাদের সংযোগের ফলে তারা বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারে ।
এই প্রতিষ্ঠানটির রাজনৈতিক প্রভাব এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ যে, তারা সরকারের বিভিন্ন নীতির উপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে, বিশেষ করে শিল্প এবং বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়ে। তাদের রাজনৈতিক শক্তি কেবল ব্যবসার উন্নয়নে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সামাজিক ও পরিবেশগত বিষয়গুলিতেও তাদের প্রভাব রয়েছে। ফলে, মেঘনা গ্রুপ (Meghna Group) বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজের প্রেক্ষাপটে একটি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে ।
মেঘনা গ্রুপের অনিয়ম ও জালিয়াতির বিস্তারিত তুলে ধরতে একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন এনবিআরকে (National Board of Revenue) দেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, মোস্তফা কামাল ২০০০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২১ বছরে আমদানিতে ৭৯ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা আন্ডার ইনভয়েসিং (Under Invoicing), শুল্কায়নযোগ্য পণ্য-মোটরযান-নৌযানের বিপরীতে বাধ্যতামূলক বীমা পলিসি এড়িয়ে গিয়ে ন্যাশনাল ইনস্যুরেন্সের (National Insurance) ১ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা, সরকারের ভ্যাট (VAT), স্ট্যাম্প ডিউটি (Stamp duty) ও ব্যাংক কমিশনের ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি আত্মসাৎ করেছেন। অর্থপাচার ও বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা নিতে গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ কাজে লাগিয়েছিলেন মোস্তফা কামাল। মেঘনা নদীর জায়গা দখল করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ, অবৈধ দখলে নদী ভরাট করে নষ্ট করেছেন নদীর গতিপথ। বেসরকারি ৯টি ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন তিনি, যার বেশির ভাগই ফেরত আসার কোনো সম্ভাবনা নেই।
ব্যবসায় রাতারাতি বিপুল পরিমাণ মুনাফা অর্জনের নেশায় তিনি বেছে নিয়েছেন সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে কম খরচে আমদানির পথ। আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের (Under Invoicing) মাধ্যমে তিনি আমদানি করা পণ্যের প্রকৃত দামের চেয়ে কয়েক গুণ টাকা কমিয়ে দেখাতেন। এতে একদিকে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে অন্যদিকে প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে অনেক কম দামে পণ্য কেনায় বেশি লাভ পকেটে পুরেছেন। আর আন্ডার ইনভয়েসের টাকা পাঠিয়েছেন হুন্ডিতে। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে এনবিআরকে (National Board of Revenue) অনুরোধ জানিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাটি।
কিন্তু কি এই আন্ডার ইনভয়সিং (Under Invoicing) । ধরা যাক, একজন ব্যবসায়ী একটি পণ্য ১ হাজার ডলারে কিনে এনেছেন; কিন্তু পণ্যটির মূল্য ঘোষণা করছেন ৫০০ ডলার। এতে সরকার ৫০০ ডলারের ওপর রাজস্ব পাবে। বাকি ৫০০ ডলারের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে। অন্যদিকে আমদানিকারক পণ্যটি সম্পূর্ণ রাজস্ব দেওয়ার পর যেই মূল্য দাঁড়াত তার সঙ্গে লাভ যুক্ত করে বিক্রি করে। এতে সরকারকে ঠকিয়ে দ্রুত অধিক টাকা উপার্জনের সুযোগ তৈরি হয়।
২০০০-২০২০ সালের মাঝে গ্রুপটি প্রায় এক লাখ ২৮ হাজার ১৩১ কোটি ৩৩ লাখ শুল্কায়নযোগ্য মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে। তবে এ সময়ে আমদানি ঋণপত্র বা এলসি অনুযায়ী ইনভয়েস (Invoice) মূল্য দেখানো হয় ৪৮ হাজার ৩৬৮ কোটি ৪২ লাখ ৪২ টাকা। সে হিসাবে আমদানির আড়ালে ৭৯ হাজার ৭৬২ কোটি ৯০ লাখ ৭৮ হাজার ৮১৫ টাকার অতিরিক্ত সুবিধা নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এছাড়া মেঘনা গ্রুপের সাতটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২৪১.২৭ একর জমি দখলের তথ্য উঠে এসেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তদন্তে। এর মধ্যে ৮৪.৭৭ একর জমিতে ভবন নির্মাণ, ৫.৫ একর জমিতে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। হাইকোর্টের এক রায়ে নদী দখলকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হলেও ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের মদদে তা উপেক্ষা করেন মোস্তফা কামাল। নদী দখলে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হওয়ার পাশাপাশি গতিপথ হারাচ্ছে মেঘনা। অস্তিত্ব সংকটে নদীসংলগ্ন নিচু আবাসিক এলাকা। আনন্দবাজার এলাকায় নদীর ৫০০ ফুট জায়গা দখল করে মাটি ভরাট এবং প্রায় ৫০ একর জমি গ্রাস করেছেন তিনি। পিরোজপুরে ইউনিয়নের ছয়হিস্যা জৈনপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ১০০ বিঘা জমি এবং আষাঢ়িয়ার চর ও ঝাউচর এলাকায় বালু ভরাট করে প্রায় ৭০০ ফুট দখলে নিয়ে সীমানাপ্রাচীর দিয়েছেন মোস্তফা কামাল। মেঘনা গ্রুপের মালিকানাধিন ন্যাশনাল ইন্সুরেন্স কোম্পানী (National Insurance Company) নিয়ে পরিচালকদের মধ্যে দ্বন্দের সুচনা হয়। এই দ্বন্দ্বের ফলে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ (Meghna Group of Industries) দুই ভাগে বিভক্ত হয়।
প্রিয় দর্শক কীভাবে এমন একটি বিশাল কোম্পানি এত বিতর্কের মাঝে থেকেও এত সফল হতে পারে? কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না। ভালো লাগলে লাইক দিন, নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং শেয়ার করুন।