রমজানে বাণিজ্য: হালাল মার্কেটের বাস্তবতা | Market Overview | Business Mania
আজকের আলোচনায় শুরুতেই সবাইকে জানাই পবিত্র মাহে রমজানের শুভেচ্ছা। রমজান বা রামাদান (Ramadan) হলো সিয়াম সাধনার মাস। এই মাসটি হলো
রমজান মাস এদেশের নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনে স্বস্তি কম অস্বস্তি নিয়ে আসে বেশী৷ পণ্য সামগ্রীর উপর কোন প্রকার ছাড় তো দেখাই যায় না, উলটো অন্যান্য সময়ের তুলনায় প্রায় সব পন্যেই অধিক দামে বিক্রী হয়। যার ফলে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষেরাই যে কেবল ক্ষতির সম্মুখীন হয় বিষয়টা এমন নই। এটা আমাদের বিজনেসকেও নানা ভাবে ক্ষতি করে।
বিজনেস মিনিয়ার আজকের আলোচনায় একটু অন্য রকম। আমরা রমজান মাসকে দেখবো ব্যবসায়ীক দৃষ্টিভংগী থেকে। তাহলে চলুন শুরু করা যাক।
আমাদের দেশের ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও রমজান মাসে মূল যে সমস্যাটা ফেইস করে সেটা হলো এই সময় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম থেকে সাধারনের তুলনায় ২০ থেকে ৩০% বেশি৷ আমরা যদি ২০২৩ আর ২৪ এর বাজারের দামের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখবো যে রমজানের ঠিক আগের মাসের সয়াবিন তেলের দাম ছিল প্রতি লিটারে ১৫৮ থেকে ১৬৫ টাকা। যা রমজানে বেড়ে দাঁড়ায় ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকা। চিনির দাম প্রতি কেজিতে বাডে প্রায় ৩৫টাকা। খোলা আটার দাম প্রতি কেজিতে বাড়ে প্রায় ১২টাকা যেই রসুন রমজান এর আগে পাওয়া যেত ৫০ টাকায় তার দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১০০ টাকায়। বাকি সব পণ্যের ক্ষেত্রেও একই জিনিস লক্ষ্য করা যায়।
২০২৪ এর বাজারে মূল্যেও একই প্যাটার্ন লক্ষ্য করা যায়। প্রায় প্রতিটি পণ্যের দামই কেজি প্রতি ১২ থেকে ১০০টাকা। কোন কোন পন্যের দাম তো প্রায় দ্বিগুন হয়ে যায়।
যদিও ২০২৫ সালের রমজান মাসে এখন অব্দি জিনিয়াপত্রের দাম আহামরি বাড়েনি। অন্যান্য বছরগুলোর তুলনায় কমই আছে।
তবুও আমরা যদি অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর দিকে তাকাই দেখবো রমজান মাসের ৩০ থেকে ৪০% ছাড়ে পন্য বিক্রি করা হচ্ছে। যেমন এই বছর কাতারেই, কাতার সরকার রমজানের আগে
রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে প্রায় য ৮০০টিরও বেশি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমিয়েছে। রমজান জুড়ে এই কম দাম বজায় থাকবে, এবং কোন দোকান যদি এই আদেশ অমান্য করে, তাহলে সরাসরি সরকারের হটলাইনে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিযোগ করা যাচ্ছে। এমনি সৌদি আরবেও দেখা যায় একই চিত্র। সেখানেও লুলু হাইপারমার্কেট, পান্ডা, ক্যারিফোরের মতো চেইন শপগুলোতে ৫০%-৭০% পর্যন্ত ছাড় দিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রী করা হচ্ছে ।
মিসরেও রমজান আসলে সরকারের তত্ত্বাবধানে বিশাল খাদ্যমেলার আয়োজন হয়। কায়রোতে “ওয়েলকাম রমজান ফেয়ার” নামে সপ্তাহব্যাপী মেলায় শত শত প্রতিষ্ঠান রান্নার তেল, চাল, ডাল, মাংস, সবজি, ফল থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সব পণ্য মূল্যছাড়ে বিক্রি করে থাকে।
এমনকি আমাদের পাশের দেশ ভারতেও রমজান এলে কম দামে বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় পন্য বিক্রি করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে যে রমজান আসলেই জিনিসপত্রের দাম বাড়ে এটা মূলত করা হয় কৃত্রিম সংকট তৈরীর মাধ্যমে। বিভিন্ন সিন্ডিকেট এই লক্ষ্য কাজ করে থাকে। সরকার চাইলে সহজেই এই সব সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিয়ে জিনিসপত্রের দাম মানুষের হাতের নাগালে রাখতে।
এছাড়াও বাংলাদেশে রমজানকে ঘিরে পর্যটনখাতে বিশেষ কোন আয়োজনই চোখে পরে না। এদিক থেকে ব্যাতিক্রম কোন সব মুসলিম দেশগুলো।
যেমন সৌদি আরবে রমজান এলেই বহু বিদেশি ওমরাহ পালন করতে আসে। সেই সাথে তারা সৌদি আরবের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ও ঘুরে এবং কেনাকাটা করে। যার ফলে সৌদি আরবের বিশাল একটা আয় আসে এই রমজান মাসে।
এছাড়া তুরস্কেও রমজান এলে বড় বড় শহরগুলোর রাস্তায় “ইফতার টেন্ট” (Iftar Tent) নামের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যেখানে হাজার হাজার মানুষ এক সাথে ইফতার করে। এছাড়াও মসজিদগুলোতে “মায়া” নামে বিশেষ আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়। যেখানে বিভিন্ন ইসলামিক বার্তা প্রদর্শন করা হয়। এর ফলে রমজান এলেই বহু বিদেশি পর্যটক তুরস্কে যায়।
এছাড়া রমজান এলেই ইরানের মাশদাহ শহরকেও বিশেষ সাজে সাজানো হয়। যার ফলে অনেক দেশি বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট হয়।
দুবাইকে বলা হয় বিজনেজ হাব (Business Hub)। আর রমজান এলেই দুবাই এর ব্যস্ততা আরো বহুগুনে বেড়ে যার। বিশ্বএর বিভিন্ন দেশের ধণী মুসলিমরা এসময় দুবাই ভ্রমনে আসে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের দিকে যদি আমরা তাকাই। দেখবো রমাজন এলেই এদেশের পর্যটন খাত একদম ঝিমিয়ে। কিন্তু চাইলেই আমরা রমজান এলেই কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, সিলেট এই জায়গাগুলোকে সুন্দর ভাবে সাজাতে পারি৷
সেন্ট মার্টিন কিংবা কক্সবাজার এর সমুদ্র তীরগুলোতে তুরস্কের মতো কমিউনিটি ইফতার এর আয়োজন করা যেতে পারে। যেখানে হাজার হাজার মানুষ একসাথে সমুদ্রের পাড়ে বসে মহান আল্লাহর তালার শুকরিয়া আদায় করবে ইফতার করবে।
পুরো সেন্ট মার্টিনকেই চাইলে এ সময় বিভিন্ন একটা রূপে সাজানো যায়। যার ফলে অনেক বিদেশি মুসলিম পর্যটক আকৃষ্ট হবে।
এছাড়া বড় বড় শহরের রাস্তাগুলোতে হরেক রকম আলোকসজ্জা দিয়ে সাজানো যায়। যা সহজেই বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে।
এছাড়াও ঢাকাকে বলা হয় মসজিদের নগরী। তাই রমজান এলেই ঢাকার মসজিদগুলোকে বিভিন্ন রুপে সাজাতে পারে। বিভিন্ন খোলা জায়গায় আলোক সজ্জার আয়োজন করা যায় যেখানে ইসলামিক বিভিন্ন বার্তা প্রদর্শিত হবে।
এছাড়াও বাংলাদেশেও আল্লাহর যেসব প্রিয় বান্দা ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছেন। সে সব ওলি আউলিয়াদের জীবনীকেও সুন্দর ভাবে তুলে ধরা যায়।
এছাড়াও আমরা সকলেই জানি যে রমজান এলেই পুরান ঢাকাতে বসে ঐতিহ্যবাহী ইফতারের বাজার। এই বাজারটি যদি সরকারীভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পায় এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকটা ভালোভাবে মেইনটেইন করা যায়। তাহলে এটাই বিদেশি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণের জায়গা হয়ে উঠবে।
এছাড়া দেশের প্রায় প্রতিটা জেলারই নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী কিছু ইফতার আইটেম আছে। এই জিনিসগুলোকেও সুন্দর ভাবে ফুয়িয়ে তুলা যায়।
এভাবে পরিকল্পনা করে আগালেই রমযান মাসেও এদেশের পর্যটন খাত চালু থাকবে। যার ফলে দেশরই ভালো হবে।
এছাড়াও ক্যালেন্ডার এর হিসাব অনুযায়ী সামনের কয়েকটা বছর এর রমজান মোটামুটি ঠান্ডার মধ্যে পরবে। এ সময়ের মধ্যে যদি আমরা দেশের পর্যটনখাতকে একটু সাজাতে পারি, সেই সাথে সামাজিক স্থিতিশীলতা আনতে পারে। তাহলে রমজান এলেই বাইরের অনেক মুসলিম ঠান্ডা আবহাওয়ায় রমজান পালনের জন্য দেশে আসবে।
এতো গেলো পর্যটনের কথা। চলুন এবার অন্য আরেকটা দিকে ফোকাস (Focus) দেওয়া যায়।
বাংলাদেশের একটা বিরাট সংখ্যক ধর্ম প্রান মুসলিমের বাস। যারা নিজেদের ধর্মকে প্রানের থেকেও বেশি ভালোবাসে। কিন্তু বাংলাদেশের সেভাবে নিজস্ব কোন হালাল কসমেটিকস ব্রান্ড নেই। আগে বাজারে যে দু একটা হালাল কসমেটিকস ও পাওয়া যেত তাও এখন হারিয়ে গিয়েছে।
তাও ক্ষেত্র বিশেষে যে অল্প কয়েকটা কোম্পানি আছে এগুলো যদি যথাযথ ভাবে সরকারের সাহায্য পায়। তাহলে রমজান মাসকে সামনে রেখে নানা ধরনের হালাল কসমেটিকস বাজারে আনতে পারে। যা এদেশের ধর্মপ্রান মুসলিম সাদরে গ্রহন করবে।
এছাড়াও বাংলাদেশে আতর বাজারের একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে, বিশেষ করে সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার সুজানগর ইউনিয়নে আগর আতর উৎপাদন বিখ্যাত। এই এলাকায় প্রায় ৩০০টি কারখানায় প্রায় ৪০,০০০ মানুষ আতর শিল্পের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। শুধু ২০১৯ সালেই প্রায় ৬১০ কোটি টাকা মূল্যের পণ্য রপ্তানি করা হয়। তবে করোনা মহামরির পর এই সেক্টর আর ঘুরে দাড়াতে পারে নি।
তাই যদি রমজানকে কেন্দ্র করে এই সেক্টরকে ঢেলে সাজানো যায়, তাহলে যেমন আতর বিদেশি রপ্তানি করা যাবে। তেমনি অনেক পর্যটক ও আকৃষ্ট হবে।
আজকের আলোচনায় আমরা চেষ্টা করেছে রমজান মাসকে একটু ভিন্ন ভাবে দেখার। তাই কোন ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। রমজান মাসে যেন আল্লাহ আমাদের সকলের রিযিক বাড়িয়ে দেন সাথে দেশ ও জাতিকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যায় সেই দোয়ায় করি।আমিন। সেই সাথে সুন্দর থাকুন, সচেতন আর সাবধান থাকুন। ধন্যবাদ।