খাদ্য থেকে কৃষি: কাজী গ্রুপের দখলে সবকিছু! | Kazi Farms | Kazi Empire | Business Mania
বাংলাদেশে এমন কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলো কেবল ব্যবসায়িক সফলতাই নয়, বরং দেশের অর্থনীতি ও সমাজে গভীর প্রভাব ফেলে। কাজী ফার্মস গ্রুপ তাদের মধ্যে অন্যতম। মুরগি, ডিম, কিংবা ফিড ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কে কথা বললেই এই প্রতিষ্ঠানের নাম সবার আগে আসে। কিন্তু কখনো ভেবেছেন, কীভাবে শুরু হলো এই বিশাল সাম্রাজ্য? কীভাবে একটি ছোট উদ্যোগ আজ দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় কৃষি ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো?
এই প্রতিষ্ঠান শুধু খাদ্য উৎপাদনে সীমাবদ্ধ নয়, এর পেছনে লুকিয়ে আছে এক ভিন্নধর্মী যাত্রা। শুরুতে প্রতিকূলতা, কঠোর পরিশ্রম আর দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত সবকিছুর প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হয়েছে কাজী ফার্মসের আজকের সফলতার গল্প।
আজকের আলোচনায় আমরা জানবো, কীভাবে কাজী ফার্মস গ্রুপ দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও শিল্পায়নের অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখে, তাদের সফলতার গল্প, ইতিহাস ও এর ভেতরের গভীর সত্যগুলো ।
কাজী ফার্মস লিমিটেডের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৬ সালে, যখন এটি আমদানি করা ডিমের জন্য একটি হ্যাচারি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পরের বছর প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের প্যারেন্ট ফার্ম চালু করে। ২০০৪ সালে কাজী ফার্মস গ্র্যান্ড-প্যারেন্ট ফার্ম স্থাপন করে, যা বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। আর সেই একই বছরে কাজী ফার্মস দেশের প্রথম হ্যাচিং ডিম ও ডে-ওল্ড চিকস রপ্তানি করে, যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের অবস্থানকে শক্তিশালী করে।
বর্তমানে কাজী ফার্মসের অধীনে ৫০টিরও বেশি ব্রয়লার প্যারেন্ট ফার্ম, লেয়ার প্যারেন্ট ফার্ম, গ্র্যান্ড-প্যারেন্ট ফার্ম, হ্যাচারি, ফিডমিল এবং সেলস অফিস রয়েছে, যা সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পে কাজী ফার্মস আজ একটি নির্ভরযোগ্য এবং শক্তিশালী নাম।
২০০৬ সালে কাজী ফার্মস দেশের সবচেয়ে বড় এবং আধুনিক ফিডমিল স্থাপন করে, যা কারিগরি সহায়তা পায় কারগিল ইউএসএ এবং বুউলার সুইজারল্যান্ডের কাছ থেকে। এই ফিডমিল কাজী ফার্মসের নিজস্ব প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি দেশের অন্যান্য ফার্মগুলোকেও ফিড সরবরাহ করে।
কাজী ফার্মস গ্রুপ বিশ্ববিখ্যাত Cobb-Vantress USA-এর Cobb 500 ব্রয়লারের জন্য গ্র্যান্ড-প্যারেন্ট ফ্র্যাঞ্চাইজি হিসেবে কাজ করছে। Cobb 500 ব্রয়লারকে বিশ্বের সেরা ব্রয়লার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পাশাপাশি, তারা Aviagen USA-এর Ross ব্রয়লার এবং Hy-line USA-এর লেয়ার মুরগির একমাত্র ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে।
কাজী ফার্মস লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী জাহেদুল হাসান একজন অভিজ্ঞ স্থপতি এবং প্রকৌশলী। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পেশাগত জীবনে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। এছাড়া, তিনি সৌদি আরবের কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইনে অধ্যাপনা করেছেন। পাশাপাশি তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে কাজী ফ্যাশন লিমিটেড পরিচালনা করেছেন এবং ২০০২ সালে এটি বিক্রি করে পুরোপুরি পোলট্রি ব্যবসায় মনোযোগ দেন।
কাজী জাহেদুল হাসানের স্ত্রী ড. Perween Hasan,কাজী ফার্মসের পরিচালক পদে রয়েছেন।
কাজী ফার্মস লিমিটেডের পরিচালক হিসেবে আছেন, কাজী জিশান তিনি কোম্পানির কাঁচামাল ক্রয় ও বিক্রয় ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছেন ।
কাজী ফার্মস লিমিটেড পোল্ট্রি, ফিড, এবং ডিম উৎপাদনের বাইরে তাদের কার্যক্রমকে বিভিন্ন খাতে ছড়িয়ে দিয়েছে। দেশের বাজারে তারা শুধু মুরগির বাচ্চা বা ডিম সরবরাহেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আইসক্রিম, ফ্রোজেন ফুড, টেলিভিশন চ্যানেল এবং সফটওয়্যার সেবা পর্যন্ত বিস্তৃত।
তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান কাজী ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড “বেলিসিমো” এবং “জানজী ” ব্র্যান্ডের আইসক্রিম দিয়ে দেশের প্রিমিয়াম মার্কেটে অবস্থান তৈরি করেছে। পাশাপাশি “কাজী ফার্মস কিচেন” ফ্রোজেন ফুড পণ্যে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এদিকে, ২০১৫ সালে চালু হওয়া কাজী মিডিয়া লিমিটেডের দীপ্ত টিভি এখন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান টিভি চ্যানেল।
কাজী ফার্মস গ্রুপের প্রযুক্তি খাতেও ভূমিকা আছে। তাদের সিসনোভা ইনফরমেশন সিস্টেমস লিমিটেড ওপেন-সোর্স সফটওয়্যার কাস্টমাইজ করে বিভিন্ন কোম্পানির জন্য এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং সমাধান তৈরি করে।
পোল্ট্রি সেক্টরে কাজী ফার্মস দেশের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। তাদের ব্রয়লার বাচ্চাগুলো Avigen Indian River এবং Cobb-Vantress-এর গ্র্যান্ড-প্যারেন্ট ফ্র্যাঞ্চাইজি থেকে আসে। এগুলোকে দেশের সেরা ব্রয়লার ব্রিড হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
কাজী ফার্মসের এই বৈচিত্র্যময় কার্যক্রম শুধু তাদের সাফল্যের চিত্র নয়, বরং দেশের কৃষি, খাদ্য এবং প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নেও একটি উল্লেখযোগ্য অবদান।
তবে এতো ব্যবসায়িক সাফল্য থাকার পরও, কাজী ফার্মস এর বিরুদ্ধে বহুবার বাজার অস্থিতিশীল করা, পোল্ট্রি বাজার ম্যানিপুলেশনের মতো ইত্যাদি মামলা ও অভিযোগ উঠে আসে।
যেমন কাজী ফার্মসকে ঘিরে ২০২২ সালের আগস্টে পোল্ট্রি পণ্যের দাম বৃদ্ধির অভিযোগ সামনে আসে। অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন ১২টি মামলা করে, যার মধ্যে দুটি কাজী ফার্মসের বিরুদ্ধে আসে।
মুরগির উৎপাদন কমেনি কিংবা চাহিদা বাড়েনি, তবুও প্রতি ডিমের দাম ২.৭ টাকা এবং মুরগির প্রতি কেজির দাম ৩০-৪০ টাকা বেড়ে যায়। শুনানিতে কমিশনের চেয়ারম্যান মো. মফিজুল ইসলাম এর যৌক্তিকতা জানতে চাইলে কাজী ফার্মস জানায়, তাদের বাজার শেয়ার মাত্র ৩-৪ শতাংশ, যা বাজার প্রভাবিত করার জন্য যথেষ্ট নয়।
কাজী ফার্মস দাবি করে, তাদের ডিম ও মুরগি নিলামের মাধ্যমে বিক্রি হয় এবং বাজার মূল্যের উপর ভিত্তি করে দাম নির্ধারণ হয়। দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে তারা ফিডের উপকরণে আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি, ডলারের দাম বৃদ্ধি এবং পরিবহন খরচ বাড়ার কথা উল্লেখ করে। তবে, তারা ডিম ও মুরগি উৎপাদনের খরচ বা গত মাসের নিলামের তথ্য দেখাতে ব্যর্থ হয়।
আবার বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন গত বছর গুলোতে পোল্ট্রি শিল্পের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে একাধিকবার দোষী সাব্যস্ত করে কোটি কোটি টাকা জরিমানা করেছে। কমিশনের দাবি, ডিম ও মুরগির মূল্যবৃদ্ধির পেছনে প্রতিষ্ঠানগুলোর কারসাজি রয়েছে।
বাংলাদেশের পোল্ট্রি বাজার প্রতিযোগিতামূলক। এখানে হাজার হাজার ছোট উৎপাদক রয়েছে ।
পোল্ট্রি শিল্পের উন্নয়ন এবং সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে সরকারের উচিত এই মামলা বাতিল করা এবং কমিশনে দক্ষ অর্থনীতিবিদদের অন্তর্ভুক্ত করা।
একই অভিযোগ আবার ও উঠে আসে ২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর । বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন (BCC) দেশের দুটি শীর্ষস্থানীয় পোল্ট্রি কোম্পানি কাজী ফার্মস এবং সগুনা ফুডসের বিরুদ্ধে মুরগি ও ডিমের বাজার ম্যানিপুলেশনের জন্য বড় অংকের জরিমানা আরোপ করে।
ডিমের বাজার পুনরায় অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। কমিশন ১০টি কোম্পানি ও সংগঠনের বিরুদ্ধে বাজারে একযোগে ম্যানিপুলেশন করে দাম বাড়ানোর অভিযোগে মামলা করে। এই তালিকায় কাজী ফার্মস, পারাগন পোল্ট্রি, ডায়মন্ড এগ, এবং আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত।
তবে এসকল বিতর্কের মাঝে দেশের জন্য কাজী ফার্মস এর অর্থনীতিতেই বলি বা সামাজিক উন্নয়নে অবদান গুলো অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
যেমন,
২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে, কাজী ফার্মস সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটিকে (www.cwu.edu.bd) ৫৩ কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা প্রদান,
বুয়েটে নতুন একটি কনফারেন্স সেন্টার নির্মাণে ১৫ কোটি টাকা অনুদান, ২০০৩ সালে, কাজী ফার্মস গাজীপুরে “উৎস” এর জন্য ১.৯ একর জমি দান করা , যেখানে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য স্থায়ী আবাসিক স্কুল নির্মাণ করা হয় ইত্যাদি অবশ্যই উল্লেখযোগ্য অবদান।
কাজী ফার্মস গ্রুপ শুধু একটি কোম্পানি নয়, এটি বাংলাদেশের কৃষি ও পোলট্রি শিল্পের ইতিহাসে এক অনুপ্রেরণার নাম।
কিন্তু তাদের এই যাত্রা এখানেই থেমে নেই। ভবিষ্যতে টেকসই উন্নয়ন এবং প্রযুক্তির আরো উন্নত ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের কৃষি খাতে নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করতে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আপনারা কী মনে করেন কাজী ফার্মস গ্রুপের এই সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ কী? আমাদের কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না।