J P Morgan : The Man Who Saved America Twice || বিশ্ব ব্যাংকিং ব্যাবস্থার মোড়ল !
JP Morgan- অর্থনীতি দিয়ে যিনি কন্ট্রোল করতেন রাজনীতি
সম্পদ, ক্ষমতা, প্রভাব প্রতিপত্তি– জেপি মরগানের ছিল সবকিছু। আমেরিকার বুকে তিনিই ছিলেন প্রথম বিলিয়ন ডলার কোম্পানির মালিক।
তৎকালীন আমেরিকার প্রফিটেবল সব রকম ইন্ডাস্ট্রিতে ছিল তার পদচারণা। এমনকি বেশকিছু ক্ষেত্রে জেপি মরগানের একশনের উপর নির্ভর করতো সেই সময়কার মার্কিন জিডিপি।
তার কলমের এক খোঁচায় দেউলিয়া থেকে বেঁচে যেত অনেক অনেক কোম্পানি। অস্ত্র ব্যবসা থেকে শুরু করে রেল রোড, পানামা খাল ক্রয় কিংবা টমাস আলভা এডিসনের বাতি আবিষ্কার সবকিছুই ছিল তার অর্থ লালসার প্রতিফলন। তো ব্যবসা জগতে তার প্রভাব নিশ্চয়ই এতোক্ষণে আন্দাজ করে ফেলেছেন। এই তিনিই কারো কাছে নিন্দিত– কারো কাছে নন্দিত আবার কারো কাছে খুবই ভয়ঙ্কর –আর তার নিজের চরিত্রে সবগুলো বিশেষণ বেশ ভালোভাবেই হয়তো লেপেছিলেন জেপি মরগান। আজকের এই ভিডিওর বাকি অংশে জানবো Richest Finance King এর শুরু থেকে শেষ অব্দি…
John Pierpont Morgan এর জন্ম ১৮৩৭ সালে আমেরিকার Connecticut শহরে। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো মরগানের বাবা junius Spencer Morgan নিজেও ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকার (Banker)।
তাই টাকা দিয়ে যতটা ভালো সম্ভব সেই শিক্ষাটাই সন্তানের জন্য কিনেছিলেন জেপি মরগ্যানের বাবা। কেননা তিনিও চেয়েছিলেন তার সন্তান তার মতোই ফিন্যান্স জগতের মানুষের হোক।
আভিজাত্য আর প্রাচুর্যের মধ্যে জন্ম হলেও জেপি মরগানের শিশুকাল ছিল খুবই কষ্টের, কারণ আর দশটা স্বাভাবিক বাচ্চার মত ছিলেন না তিনি, ছিলেন একজন অসুস্থ শিশু।
তার ছিল নিউমোনিয়াজনিত সমস্যা, বাতজ্বর,মাইগ্রেন এবং খিচুনির মতো কষ্টকর আরো নানান অসুখ। এমনকি ছেলেবেলায় তার শারীরিক কন্ডিশন এতটাই খারাপ ছিল যে সে তার সমবয়সী বাচ্চাদের সাথে খেলার মতো ফিট থাকতো না কখনোই।
এই রোগের চিকিৎসায় মরগানের বাবা দিলেন আজব এক সলুশন। তিনি তার সন্তানকে আটলান্টিকের মাঝখানের আজর আইল্যান্ড নামের একটি দ্বীপে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিলেন।
নিজের অবস্থার পরিবর্তনের আশায় জেপি মরগান ও তার পরিবার ছেড়ে দ্বীপ এ গিয়ে আশ্রয় নিলেন, সেখানে কাটিয়ে দিলেন প্রায় এক বছরের কাছাকাছি সময়। এরপর সুস্থ অনুভব করলে সে বাড়ি ফিরে আবার তার পড়ালেখায় মনোনিবেশ করেন।
১৮৫৭ সালের মধ্যে জেপির শিক্ষাজীবণ কাটে বোস্টন, সুইজারল্যান্ড এবং জার্মানিতে। এরপর মাত্র ১৯ বছর বয়সে মরগান প্রবেশ করেন কর্মজীবনে, সে সময় জেপির বাবা লন্ডন বেজড একটি মার্চেন্ট ব্যাংকিং(Merchant banking) ফার্মের পার্টণার ছিলেন, যা ছিল Duncan, Sherman & Co. এর আওতায়। আর সেই কোম্পানির আগ্রহে আমেরিকাতেই চাকরী পেয়ে যান মরগান।
তার চাকরি ছিল মূলত আমেরিকার অর্থনৈতিক এবং পলিটিক্যাল সিস্টেম এর যে প্রভাব মার্কেটের উপর পড়তো সেটা নিয়ে রিপোর্ট তৈরী করা। বুঝতেই পারছেন জেপি মরগান(J. P. Morgan) ঠিক কোন বিষয়টা নিয়ে ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই রিসার্চ করে ফেলেছিলেন!
রাজনীতির সাথে অর্থনীতির যে গভীর সম্পর্ক সেটা জেপি বুঝে ফেলেছিলেন একেবারেই অল্প বয়সে। আর এই দুটো বিষয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে যেকোনো ব্যবসায় সফল হওয়া সম্ভব।
প্রাথমিক জীবনের অসুস্থতা জেপি মরগানকে কৈশোর এবং যুবকে অনেক বেশি সাহসী করে তোলে, যার প্রভাব ছিল জীবনের শেষ অব্দি। ২৩ বছর বয়সে বাবার ব্যাংকে চাকরী করার সময় একবার বন্দরে যান বিদেশ থেকে আসা মাল বুঝে নেয়ার জন্য। সেইসময় তিনি দেখেন ব্রাজিল থেকে আসা মালিকবিহীন কফি বিক্রি করছে বন্দরের কিছু লোকজন। মরগান তাদেরকে ডলার দিয়ে সবটুকু কফি কিনে নেন, কারো অনুমতি ছাড়াই। জনশ্রুতি আছে এই কফি থেকে ৩ গুণ লাভ তুলে আনেন মরগান!
মরগানের বাবা এই ঘটনা থেকে বেশ ভালোভাবেই বুঝেছিলেন তার পাগল ছেলে ব্যবসায় কখনো ব্যর্থ হবেনা।
১৮৬৩ সালে আমেরিকান গৃহযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে না গিয়ে মরগান করেছিলেন অস্ত্রের ব্যবসা। আমেরিকান সরকারের অকেজো হয়ে যাওয়া রাইফেল গুলো সাড়ে তিন ডলারে কিনে মেরামত শেষে সরকারের কাছেই সেই রাইফেল বিক্রি করেছেন ২২ ডলার করে। যেখানে ইনভেস্টের তুলনায় তার লাভের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬০০ গুণ।
অস্ত্র ব্যবসা থেকে আয়ের মজা আরো ভালোভাবে বললে লোহা লক্কর থেকে ইনকামের সুযোগ হয়তো মরগানের মাধ্যমেই বুঝে গিয়েছিল মার্কিনিরা।
এরপর ১৮৭১ সালে ড্রেক্সেল (Drexel)এর সহায়তায় মরগান প্রতিষ্ঠা করেন ড্রেক্সেল এন্ড মরগান ব্যাংক, ছোট ছোট কোম্পানিকে প্রতিষ্ঠিত করে তোলার পাশাপাশি যেসব কোম্পানি দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌছে যেত সেসব কোম্পানিকে কলমের এক খোঁচায় স্বাভাবিক অবস্থানে নিয়ে আসতেন মরগান এই ব্যাংকেরই নাম খাটিয়ে। আর এভাবেই পুরো আমেরিকা জুড়ে বিজনেস ম্যাগনেট হিসেবে বেশ ভালো পরিচিতি পেয়ে যান জেপি মরগান।
মরগানের সেই ব্যাংকের বর্তমান নাম মরগান চেজ এন্ড কোম্পানি। আঠারো শতকের সেই সময়ে বিশ্বব্যাপী রেলওয়ে শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে, আর মরগান তখন নিজের সম্পদের সিংহভাগ বিনিয়োগ করতে শুরু করেন রেলওয়ে নির্মাণে।
যেসব কোম্পানি রেলওয়ে নির্মাণের টেন্ডার জমা দিতো ,নিজের ব্যাংক সহ ছোট বড় অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিকানাকে কাজে লাগিয়ে সে কোম্পানিতে প্রভাব খাটিয়ে মরগান পুরো ব্যবসা জগত থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতো। আর এভাবেই রেলপথ নির্মাণে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে তার স্টীল কোম্পানি একাই সব মুনাফা বাগিয়ে নেয়।
এরপর ১৮৯৩ সালে আমেরিকনরা স্বাক্ষী হয় গ্রেট ডিপ্রেশনের। তীব্র অর্থনৈতিক মন্দায় অনেক ব্যাংক ও কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যায়,মানুষের জীবন মান পৌঁছে যায় দুর্ভিক্ষে। দেশের অর্থনীতি রক্ষায় তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট হুবার শরণাপন্ন হন জেপি মরগানের। ঐ প্রেক্ষাপটে মরগান মাত্র ৩.৫ মিলিয়ন আউন্স স্বর্ণ দেখিয়ে ৬৫ মিলিয়ন বিদেশি বিনিয়োগ এনে তৎকালীন আমেরিকান অর্থনীতি একাই বাঁচিয়ে দেন।
হঠাত জেপি মরগানের হাতে আসে মোক্ষম সুযোগ। আমেরিকার আরেক বিজনেস মেগনেট ডেল কার্নেগী তখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েন। তাই কার্নেগী স্টীল কোম্পানি বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি, মরগান ৪৮০ মিলিয়ন ডলারে কিনে নেন কার্নেগী স্টীল । যা ছিল ঐসময়ের বিজনেস ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ডীল।
এরপর ১৯০৪ সালে পানামা খাল কিনতে মার্কিন সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ দেন দেন মরগান।
প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন আমেরিকা আবার অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ে । আবারও দেশকে রক্ষায় ডাক পড়ে জেপি মরগানের। দেশের বড় বড় ব্যাংকার ও বিত্তশালীদের নিয়ে তিনি নিজের বিখ্যাত লাইব্রেরী রুম লক করে সিদ্ধান্ত দেন সব ব্যাংকগুলোতে ইনভেস্ট করার জন্য। কারন সেই সময় বেশিরভাগ ব্যাংক নিজেদের দেউলিয়া ঘোষনা করতে শুরু করে।
বিশ্বাস করুন বা নাই করুন সারা রাত বিত্তশালীদের লাইব্রেরীতে আটকে রেখে বিনিয়োগের স্বীকারোক্তি নিয়ে তারপর ছাড়েন সবাইকে। তার এই প্ল্যান শেষ পর্যন্ত কাজ করে, যা মার্কিনীদের আবার ঘুরে দাড়াতে সাহায্য করে।
তবে আমেরিকার জনগণ এবার বেশ ভালোভাবেই বুঝে ফেলে পুরো দেশ একজন ব্যাক্তির উপর নির্ভর হয়ে পড়েছে । পুঁজিবাদী অর্থনীতি দিয়ে একজন ব্যাক্তির পক্ষে রাজনীতি কিংবা সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব সেটাও বুঝে ফেলে আমেরিকানরা। এরপর থেকে আমেরিকার জনগণ নিজেরাই উদ্দোক্তামনা হয়ে ওঠে ,যেন নিজের অর্থনৈতিক অবস্থান নিজেই তৈরি করতে পারে।আর সেখান থেকেই পুঁজিবাদ অর্থনীতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যায়।
বুঝে হোক বা না বুঝে হোক আমরাও সেই নোংরা পুঁজিবাদের অংশ হয়ে উঠছি। কারণ গুটিকয়েক ব্যাংক ছাড়া আমাদের দেশের প্রতিটি ব্যাংকই পুঁজিবাদের ধারক বাহক হয়ে উঠছে,যা মোটেও আমাদের অড়থনীতির জন্য ভালো কিছু বয়ে আনতে সক্ষম হবেনা।
ইন্টারেস্টিং আরেকটি বিষয় হলো ১৯১৩ সালে মরগানেরও টাইটানিকে চড়ার কথা ছিল।তবে শেষ মুহূর্তে তিনি যাত্রা বাতিল করেন স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে। তবে টাইটানিকের সে যাত্রার সারথি না হলেও সে বছর ইতালির রোমে ঘুমানোর সময় মারা যান তিনি।
তো বিশ্ব ব্যাংকিং ব্যবস্থার এই মুহূর্তে যে কয়টা মোড়ল রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম জেপি মরগান চেইজ । ব্যাংকটির বর্তমান সিইও জেমি ডাইমন যেন জেপি মরগানের আরেক রুদ্রমূর্তি হয়ে শাসন করে চলেছেন আমেরিকার সবচেয়ে পাওয়ারফুল চেইজ ব্যাংক।
২০০৬ সাল থেকে ব্যাংকটির সিইও হিসেবে থাকা ডাইমন তার উদ্ভাবিত fortress balance sheet দিয়ে বিশ্বকে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দেন। তবে এইটুকু আসতে তার সময় লেগেছে ১৯৮৬ থেকে ব্যাংকি সেক্টরে তার ঝুলিতে অর্জিত অভিজ্ঞতার সবটুকু।
তিনি ব্যাংকের গ্রাহকদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন আমেরিকার সব ব্যাংক অর্থনৈতিক ধাক্কায় টালমাটাল হলেও মর্গান চেইজ নড়বেনা একচুলও। আর তিনি যে রিস্ক নিতে পছন্দ করতেন তা ফুটে উঠত তার ইনভেস্টমেন্টের ধরণগুলো বিবেচনা করলেই।
এই যেমন বর্তমান আমেরিকা সরকারের দুটি ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠান আছে তাদের দখলে।একটি Bear Stearns এবং অপরটি Washington Mutual. এর পুরোটাই হয়েছে জেমি ডায়মনের সাহসী বিডিং এর ফলেই।
২০১২ সালে এক উপস্থাপক ডায়মনকে জিজ্ঞেস করেন তিনি এবং তার প্রতিষ্ঠান ২০০ না ৩০০ ট্রিলিয়ণে গেলে থামবেন, উত্তরে জেমি বলেন, চাদে গিয়ে যেদিন তাদের অর্থ সম্পদ আটকাবে সেদিন।
মরগান গত হলেও তার সৃষ্টিগুলো রয়ে গেছে এখনো। তার পরিবারবর্গ ও জেমি ডাইমন এর মতো মানুষ সেই অর্থনৈতিক স্তম্ভের উপর দাড়িয়ে আজও শাসন করে যাচ্ছে বিশ্ব ব্যাংকিং ব্যবস্থা।
আজকের জন্য এই পর্যন্তই।জেপি মরগানের বিখ্যাত একটি উক্তি না বললে নয় (একটু pause)“A man always has two reasons for doing anything: A Good Reason and the Real Reason.”