দি মুকেশ আম্বানি কিংডম : How Mukesh Ambani Become Billionaire
প্রচন্ড গরমের দিনগুলোতে, সারাদিন সূর্যের আগুনে পুড়ে ক্লাস, পরীক্ষা আর অফিস শেষে যখন বাসায় প্রবেশ করি, তখন আমাদের অনেকের মনেই হয়তো একটা বাসনা জাগে। ইশ এখন যদি বরফের কোন দেশে যেতে পারতাম। ঠান্ডা বরফ নিয়ে খেলতে পারতাম। প্রচন্ড গরমের দিনগুলোতে এমন ভাবনা মাথায় আসা খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার। কিন্তু কেমন লাগবে যদি আপনাদের বলি, এমন একটা বাড়ি আছে যেখানে বাইরের তাপমাত্রা ৪৮° ডিগ্রি সেলসিয়াসে গেলেও বাড়ির একটি অংশের তাপমাত্রা সর্বদা – ১০°ডিগ্রি সেলসিয়াসে থাকে। পুরোপুরি কৃত্রিম উপায়ে বাড়ির একটি ফ্লোরের তাপমাত্রা এভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যাতে ইচ্ছে করলেই আপনি এন্টার্টিকার ফিল নিতে পারেন।
এমনই নানা রকম অভিজাত্যে ভরা এই বাড়ির মালিক হলো মুকেশ আম্বানি(Mukesh Ambani) তার নাম হল আন্তিলিয়া (Antilia)। প্রায় ২৭টি ফ্লোরের এই ভবনটির উচ্চতা এতটাই বেশি যে এটার ছাদে দাড়ালে আপনি গোটা মুম্বাই(Mumbai) শহর দেখতে পারবেন। প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার ব্যায়ে নির্মিত এই বাড়িটির বর্তমান বাজার মুল্য প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার (7 billion dollar)। যা এটিকে বিশ্বের সবথেকে দামী (expensive) আবাসিক বাড়িতেও পরিনত করেছে।
আপনি যদি গত কয়েকদিন ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রাম কিংবা ইউটিউব এর কোন একটা চালিয়ে থাকেন তাহলে মুকেশ আম্বানির ছোট ছেলে আনান্ত আম্বানির প্রি –ওয়েডিং (pre-wedding) সেরিমনি (ceremony) সম্পর্কে অবশ্যই জেনে থাকবেন। এলাহি এই বিয়ের নানা রকম খবর দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া একদম পুর্ন।
কিন্তু এই মুকেশ আম্বানি এতটা ধনী হলো কীভাবে? যে ছেলের প্রি ওয়েডিং ফাংশনেই খরচ করছে প্রায় ১৩০০ কোটি রূপী!!
একজন ভারতীয় তার দিনের পুরোটাই কোন না কোন ভাবে মুকেশ আম্বানির কোন না কোন প্রডাক্ট অবশ্যই ব্যাবহার করেছেন। ঠিক এতটাই বিস্তৃত এই মুকেশ আম্বানির ব্যাবসা(business)।
ধরুন আপনি আপনার ভারতীয় কোন বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গেলেন। ঘুম থেকে উঠেই দেখলেন রুমের মধ্যে এসি চলছে। পাশের রুম থেকে ভেসে আসছে টিভির শব্দ। পাশের রুমে যেতেই দেখলেন কালারস(colors) চ্যানেলের আপনার বন্ধুর মেয়ে আর মা কোন হিন্দি সিরিয়াল দেখছে। আপনি টিভির সামনে বসার পর সিএনএন(CNN) চ্যানেলে কোন নিউজ দেখা শুরু করলেন।
এর একটু পর জিও মার্ট(JioMart) থেকে খাবার অর্ডার করলেন। এরপর বন্ধুর সাথে চলে গেলেন জিও ওয়ার্ল্ড প্লাজা তে শপিং করতে। কেনাকাটা শেষে বুক মাই শো থেকে টিকিট বুক করে দেখে নিলেন কোন সিনেমা এরপর গাড়িতে করে আসার সময় পেট্রোল ভরিয়ে নিয়ে বাসায় ফিরে আসলেন।
এই যে সারাদিনে আপনি যতগুলো প্রডাক্ট বা সার্ভিস ব্যাবহার করেছেন তার পুরোটাতেই রয়েছে মুকেশ আম্বানির অংশীদার। মুকেশ আম্বানির প্রায় ৫০টির বেশি আলাদা আলাদা বিজনেস রয়েছে। যার মধ্যে ফোর্বস ম্যাগাজিন(Forbes Magazine) এমনকি ভারতের বিখ্যাত ডিজাইনার মানিশ মালহোত্রার(Manish Malhotra) ব্রান্ডেও রয়েছে মুকেশ আম্বানির শেয়ার।
আর এত সব বিজনেস এর জন্যই মুকেশ আম্বানির বর্তমান সম্পত্তির মুল্য প্রায় ১১৭.৩ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৬ষ্ঠ স্থানে থাকা সর্বোচ্চ ধনী(richest) ব্যাক্তি তিনি। সেই সাথে সর্বপ্রথম ট্রিলিয়ন ডলার (Trillion dollar club) ক্লাবে প্রবেশ করা সর্বপ্রথম এশিয়ান ও তিনি।
বর্তমানে মিনিটে প্রায় ৯০ কোটি রূপী আয় করা এই মানুষটির জন্ম হয় ১৯৫৭ সালের ১৯শে এপ্রিল ইয়েমেনে। তার পিতা ভারতের আরেক শীর্ষ ধনী ধিরু ভাই আম্বানি(Dhirubhai Ambani)। তবে তার জন্মের সময় তাদের পরিবারের অবস্থা কিন্তু এমন ছিল না। মুকেশ আম্বানি যখন জন্মগ্রহন করেন তখন তার বাবা ইয়েমেনের একটি পেট্রোল রিফাইনারে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতো। কিন্তু মুখেশ আম্বানির জন্মের পরপরই ইয়েমেনে গৃহ যুদ্ধ শুরু হয়। এতে বাধ্য হয়ে ধিরু ভাই আম্বানি ১৯৫৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতে ফিরে আসেন।
এরপর পরই তিনি ১৯৫৮ সালেই মুম্বাই এ ৫০০ স্কয়ার ফিটের একটা জায়গার উপর রিলায়েন্স(Reliance) নামের একটা অফিস চালুন করেন। এটার মূল কাজ ছিল বিদেশে মসলা রপ্তানি করা।
এরপর ধিরু ভাই আম্বানি বুঝতে পারেন যে সুতা বা পলিয়েস্টার রপ্তানি করা আরো বেশি লাভজনক , আর তাই ১৯৬১ সালে পলিয়েস্টার রপ্তানি করা শুরু করে। এরপর ১৯৬৪ সালে নিজেরাই তা উৎপাদন করার জন্য কারখানা দিয়ে বসে।
এরপর ১৯৯২ সালে রিলায়েন্স, পেট্রো ক্যামিকেল ও পেট্রোল শোধনাগার ব্যাবসা শুরুর চিন্তা করে। এসময় মুকেশ আম্বানি স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি এমবিএ করছিল। ধিরু ভাই আম্বানি তাকে ড্রপ আউট করে পারিবারিক ব্যাবসা তে ফেরত আসতে বলেন।
মুকেশ আম্বানিও বাবার কথা শুনে ফিরে আসেন , এবং তার হাত ধরেই যাত্রা শুরু হয় রিল্যায়েন্স পেট্রোলিয়াম এর, যা , ৮ বছরেই মধ্যেই রিলায়েন্স এর প্রফিটকে প্রায় ১০ গুন বাড়িয়ে দেয়।
এরপর আসে সাল ২০০২, আম্বানি পরিবারের জন্য আসে একটা বিরাট ধাক্কা। কেননা এই বছরই মারা যান ধিরুভাই আম্বানি। সে সময় রিলায়েন্স এর ম্যানেজিং হেড(Managing Head) ছিল মুকেশ আম্বানি আর ভাইস প্রেসিডেন্ট(Vice President) ছিলেন অনিল আম্বানি।
শুরু হয় দুই ভাইয়ের মধ্যে দ্বন্দ কে কোন কোম্পানির মালিকানা পাবে। শেষমেশ ২০০৫ সালে তাদের মা কোকিলা বেন এর হাত ধরে রিলায়নেসকে দুই ভাই এর মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়।
এরমধ্যে অপেক্ষাকৃত পুরাতন বিজনেস যেমন রিলায়েন্স পেট্রলিয়াম, গ্যাস, ইনফাট্রাক্সচার যায় মুকেশ আম্বানির কাছে। আর নতুন কোম্পানি রিলায়েন্স কম, এনার্জি আর ক্যাপিটাল যায় আনিল আম্বানির কাছে।
সেই থেকে শুরু করে মুকেশ আম্বানি ধীরে ধীরে তার ব্যাবসায়িক পরিধি বাড়িয়ে চলছেন। বলা হয়ে থাকে মুকেশ আম্বানি একজন আসল বিজনেস ম্যান। টাকা থেকে কীভাবে টাকা বানাতে হয় এটা তার থেকে ভালো কেউ জানে না।
বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে একটা জিনিস ই ঘুরে বেড়াচ্ছে। কীভাবে মুকেশ আম্বানি তার ছেলের বিয়েতে প্রায় ১২০০ কোটি রূপি খরচ করতে পারে? এত বিশাল পরিমান অর্থ খরচ করা কি আসলেই সম্ভব।
মুকেশ আম্বানি যে ১২০০ কোটি রূপী খরচ করেছেন এটা আসলে তার মোট সম্পত্তির মাত্র ০.০৮ ভাগ। আর এটির পিছনে রয়েছে আরো বিলিয়ন ডলারের একটি ব্যাবসা।
আপনারা হয়তো জানেন যে মুকেশ আম্বানির ছেলের এই প্রাক ওয়েডিং সেরিমনিতে পারফর্ম করছেন রিহানা । প্রায় ৬ মিলিয়ন ডলার খরচ করে রিহানাকে মুকেশ আম্বানি এম্নি এম্নি আনেন নি।
মুকেশ আম্বানির একমাত্র মেয়ে ইশা আম্বানির এই বছর একটা মেকআপ ব্রান্ড লঞ্চ করার কথা ছিল। তাদের পরিকল্পনা ছিল ভারতের অন্য মেকআপ ব্রান্ড যেমন নাইকা (Nykaa) কে সরিয়ে এক নাম্বার স্থানে আসা।
তাই মুকেশ আম্বানি রিহানার সাথে যোগাযোগ করে ৭০ কোটি রুপী ব্যয়ে ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান পারফর্ম করার জন্য ভারতে আনেন ৷
আর এতেই ইশা আম্বানির মেকআপ ব্রান্ডের ভ্যালুয়েশন চালুর আগেই পৌছে যায় প্রায় ৫১০ মিলিয়ন ডলারে।
ব্যবসার পাশাপাশি প্রতিপক্ষকে কিভাবে ঘায়েল করতে হয় তা মুকেশ আম্বানি থেকে কেউ ভাল জানেনা। ছোট ভাই আনিল আম্বানির পতনের পেছনেও অনেকে মুকেশ আম্বানিকেই দায়ী করে থাকে। ২০০৫ সালে যখন দুই ভাইয়ের মধ্যে কোম্পানি গুলো ভাগ হয় ৷ তখন একটা চুক্তি হয় যে আনিল আম্বানি তার রিলায়েন্স এনার্জির জন্য গ্যাস মুকেশ আম্বানির থেকেই কিনবে আর তাও ২ ডলার রেটে।
কিন্তু ২০১০ সালে মুকেশ আম্বানি এই রেট দ্বিগুণ করে ফেলে। ফলে আনিল আম্বানি কোর্টে যায় । বলা হয়ে থাকে মুকেশ আম্বানি তার রাজনীতি আর ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে কোর্টের রায় নিজের পক্ষে নিয়ে আসে। এতে কোর্ট আনিল আম্বানিকে ৪ ডলার রেটেই গ্যাস কেনার নির্দেশ দেয়।
ফলে হুট করেই আনিল আম্বানিকে বিশাল লসের মুখোমুখি হতে হয়। যার কারনে রিলায়েন্স এনার্জি বেশিদিন ব্যাবসা করতে পারেনি।
মুকেশ আম্বানি তার ভাইয়ের উপর দ্বিতীয় আঘাতটা আনে মোবাইল নেটওয়ার্ক সার্ভিস জিও (jio) লঞ্চ করার মাধ্যমে। এর আগে চুক্তি অনুযায়ি দুই ভাই কম পক্ষে ১০ বছর একে অপরের ব্যাবসাতে প্রবেশ করতে পারবে না বলা ছিল। কিন্তু এই চ্যুক্তি ও ভংগ করে মুকেশ আম্বানি।
আর তাই ২০১০ সালেই হুট করে বাজারে জিও লঞ্চ করে। যেখানে রিলায়েন্স কম একটু বেশি দামে ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছিল। সেখানে জিও প্রথম তিন মাস সকল ধরনের ইন্টারনেট সেবা আর কলরেট ফ্রি করে দেয়। ফলে আনিল আম্বানির রিলায়েন্স কমুনিকেশন (reliance communications) ও আর টিকতে পারেনি।
এভাবে মাত্র ৫ বছরের মাথায় দুটো বিশাল কম্পানি বন্ধ করতে বাধ্য হয় আনিল আম্বানি। শেষ মেষ তিনি আর এই দৌড়ে টিকে থাকতেই পারেন নি।
মাত্র কয়েক বছরের মাথায় নিজ ভাইয়ের কথিত ষড়যন্ত্রে তার সম্পত্তির মুল্য ৪২ বিলিয়ন ডলার থেকে ০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। পথে নেমে যায় আনিল ।
এমনকি আনান্ত আম্বানির এই প্রি– ওয়েডিং এ বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গ কিংবা সুন্দর পিচাই এর মতো শীর্ষ ধনী ব্যাক্তিরা আমন্ত্রন পেলেও নেই আনিল আম্বানি এমনকি ব্যাবসায়িক প্রতিদ্বন্দী গৌতম আদানী ও উপস্থিত রয়েছেন।
এই একটা জিনিসই কিন্তু মুকেশ আম্বানি সম্পর্কে অনেক কিছু জানিয়ে দেয়।
ব্লগ ভাল লাগলে কমেন্ট করতে ভুলবেন না । ধন্যবাদ ।