আফগানিস্তান অর্থনীতি, তালেবান সরকারের তাক লাগানো সমৃদ্ধি
আফগানিস্তান, নামটি শুনলেই আপনার মনে হতে থাকবে, যুদ্ধবিদ্ধস্ত একটি দেশের চিত্র। দারিদ্রতা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, যুদ্ধ, আর ধর্মীয় গোঁড়ামিতে ভরা ভবিষ্যৎ-হীন একটি দেশ। বিগত কয়েক দশক ধরে আপনি হয়ত তাই ভেবে আসছেন। আর তালেবান(Taliban) মানে? খুব সহজ! আমরা অনেকেই জন্মের পর থেকেই জেনে এসেছি তালেবান মানে শিক্ষা দীক্ষা হীন ধর্মীয় গোঁড়ামিতে ভরা সন্ত্রাসী একটি দল। কিন্তু বর্তমান যে আফগানিস্তান এবং তালেবানের শাসন দেখা যাচ্ছে তা কিন্তু একেবারে ভিন্ন চিত্র। যা দেখে হতবাক গোটা বিশ্ব। ২০২১ সালে যখন তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে, তখন সবাই নিশ্চিত ছিলো যে নারীদের দুর্বিষহ জীবন,অচল অর্থনীতি, চোখ রাঙ্গানি আর কট্টর আইনের মার পেঁচে দুর্বিষহ হয়ে উঠবে আফগানিস্তানের জনজীবন। কিন্তু ক্ষমতা লাভের ২ বছর পর দেখা গেলো সম্পূর্ণ ভিন্ন মানচিত্র। কট্টর আইনের মাঝে থেকেও আফগানিস্তানের অর্থনীতি পেয়েছে অবিশ্বাস্য সাফল্য। কিন্তু কিভাবে? সেটাই জানবো আমাদের আজকের ব্লগ-এ।
২ বছর আগে তালেবান যে পরিস্থিতিতে ক্ষমতা দখল করে তখন দেশটির অবস্থা ছিলো একেবারে করুণ ও অর্থনৈতিক ভাবে ভঙ্গুর। তার উপর আবার নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা এবং চাপ। তাই সামনের দিনগুলো স্বাভাবিক ভাবেই তাদের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিলো। নিজেদের কঠোর আইন, নারীদের অধিকার হরণ, এবং সব রাজনৈতিক দলের উপর নিষেধাজ্ঞা সবই আবারো ফিরে এসেছে তালেবানদের সাথে। কিন্তু তারপরও সেই পুরনো অন্ধকারে আটকে নেই আফগানিস্তানের অর্থনীতি। গত দুই বছরে তালেবান সরকার প্রায় শতভাগ নিজেদের অর্থায়নে ৩০০ কিলোমিটারের মত খাল খননের মত মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি আফগানিস্তানকে চিনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এর সাথে অন্তর্ভুক্ত করেছে, এবং কাবুল কে একটি স্মার্ট সিটিতে রূপান্তর করার মত বেশ কিছু মেগা প্রকল্পও হাতে নিয়েছে তালেবান। এই প্রকল্পগুলো যেমন তাদের নিজস্ব অর্থায়নে হচ্ছে, পাশাপাশি পাচ্ছে বিদেশী অর্থায়ন ও । যেটি নিঃসন্দেহে তাদের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক একটি বিষয়।
এছাড়াও নিজেদের বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন, আয়রন, গোল্ড, লিথিয়াম এর মত ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ উত্তোলনের জন্য বৈদেশিক কোম্পানি গুলোর সাথে এরই মধ্যে সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলারের চুক্তিতেও সাইন করেছে তালেবান সরকার। নিজেদের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে অনেকগুলো পদক্ষেপই নিয়েছে তারা। যা বাস্তবেই কাজ করেছে। ২০২৩ সালে আফগানি মুদ্রা বিশ্বের টপ পারফর্মিং কারেন্সির মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো দেশকেই পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গিয়েছে আফগা্নি মুদ্রা।
আফগানিস্তানকে নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ সালে মূল্যস্ফীতি হ্রাস, জাতীয় মুদ্রামান স্থিতিশীল রাখা ও রাজস্ব সংগ্রহে তালেবান সরকার সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। আফগানিস্তান এখন মানবিক সাহায্য হিসেবে শত শত কোটি ডলার পাচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গেও তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ছে। ফলে চলতি ত্রৈমাসিকে আফগান মুদ্রার দর বেড়েছে। এর সাথে তালেবান সরকার মুদ্রার মান বাড়াতে বেশকিছু পদক্ষেপ ও নিয়েছে।
ইউএস আগ্রাসনের সময় আফগানিস্তান তাদের লেনদেনের জন্য ইউএস ডলার, পাকিস্তানি ও ভারতীয় মুদ্রাই ব্যবহার করছিল। যার ফলে আফগানি মুদ্রা তার মূল্যমান হারাতে থাকে। তালেবান ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় লেনদেনে ডলার ও পাকিস্তানি রুপির ব্যবহার বন্ধের পাশাপাশি দেশ থেকে বাইরে ডলার নিয়ে যাওয়ার উপরও কড়াকড়ি আরোপ করায় দেশটির মুদ্রার দর বাড়তে থাকে। তালেবান সরকার অনলাইন-ভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য অবৈধ ঘোষণা করেছে এবং যারা আইন লঙ্ঘন করবেন, তাঁদের কঠোর শাস্তি প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। পাশাপাশি প্রবাসী আয় বৃদ্ধির উদ্যোগও নেয় তারা। তারা বর্ডারেও ডলারের ইনফ্লো এবং আউট ফ্লো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে চলতি ত্রৈমাসিকে আফগানিস্তানের মুদ্রা আফগানির দর বেড়েছে ৯ শতাংশ। সব মিলিয়ে এ বছর আফগানির দর বেড়েছে ১৪ শতাংশ। ফলে চলতি বছর বিশ্বের যেসব মুদ্রার দর সবচেয়ে বেশি বেড়েছে, তাতে তৃতীয় অবস্থানে আছে আফগানি মুদ্রা । যার সামনে রয়েছে শুধু কলম্বিয়া ও শ্রীলঙ্কার মুদ্রা।
২০২১ সালের আগস্ট মাসে তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে আফগানিস্তানে নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহ দেখা গেছে। দেশটি বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে একরকম বিচ্যুত হয়ে যায়। নিষেধাজ্ঞার পর নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত হয়ে পড়ে। অর্থনীতির অবস্থাও খুব ভালো ছিলো না। এ ধরনের বাস্তবতায় আফগানির দর কমার কথা; কিন্তু ঘটেছে তার উল্টোটি। আফগানিস্তানে বিদেশি মুদ্রা মূলত মানি চেঞ্জারদের মাধ্যমে লেনদেন হয়, স্থানীয়ভাবে যারা ‘সরাফ’ নামে পরিচিত। বাংলায় আমরা যাদের বলি ‘হুন্ডি ব্যবসায়ী’। এরা সাধারণত বাজারে স্টল স্থাপন করে বা গ্রাম ও শহরে দোকান-ভিত্তিক ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। কাবুলের উন্মুক্ত বাজার ‘সরাই শাহজাদা’ কার্যত দেশটির আর্থিক কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে, যেখানে প্রতিদিন লাখ লাখ ডলারের সমপরিমাণ মুদ্রা হাতবদল হয়। আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, এই বাজারে লেনদেনের ক্ষেত্রে কোনো সীমা নেই।
আর্থিক নিষেধাজ্ঞার কারণে আফগানিস্তানে এখন শত বছরের পুরনো ‘হাওলা’ পদ্ধতি যা বাংলায় ‘হুন্ডি’ বলে সেই মানি ট্রান্সফার–ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রবাসী আয় আনছে। সরাফদের ব্যবসার বড় একটি অংশ হচ্ছে এই হাওলা। বিশ্বব্যাংক হতে এ বছর আফগানিস্তানের ৩২০ কোটি ডলার সহায়তা প্রয়োজন ছিল, এর মধ্যে ১১০ কোটি ডলার তারা ইতিমধ্যে দিয়েছে ও। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস মতে, আফগান অর্থনীতি এ বছর সংকোচনের ধারা থেকে বেরিয়ে আসবে। ২০২৫ সাল পর্যন্ত দেশটিতে ২ থেকে ৩ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে। যদিও তারা যেভাবে নারীদের নিপীড়ন করে যাচ্ছে, তাতে বৈশ্বিক সহায়তা কমতে পারে।
তালেবানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল তাদের কৃষি ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা। ভৌগলিক কারণেই আফগানিস্তানের আবহাওয়া অনেক রুক্ষ। সেখানে বাৎসরিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ মাত্র ২০০ মিলিমিটার যা মোটেও কৃষির জন্য উপযোগী না। তার উপর দীর্ঘদিন যুদ্ধের জন্য বেশিরভাগ কৃষি জমিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার ফলে দেশটিকে প্রয়োজনীয় খাদ্যের জন্য বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে হয়। আর সেকারণেই তালেবান সরকার কৃষি সম্ভাবনা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমদানির উপর নির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ নেয়।
আমরা সবাই কম বেশি জানি যে আফগানিস্তানের প্রধান কৃষি পণ্য হচ্ছে আফিম। আফিম উৎপাদন করে সে দেশের চাষিরা প্রতিবছর ১ বিলিয়ন ডলার বা তারও বেশি আয় করে। কিন্তু ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে এসে তালেবান সরকার আফিম উৎপাদন পুরপুরি নিষিদ্ধ করে। এর ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এ নিয়ে তালেবানের রয়েছে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। আসলে তারা চাইছে কৃষকদের আফিম উৎপাদন থেকে সরিয়ে খাদ্য উৎপাদন যেমন, বাদাম জাতীয় পণ্য, গম, শাক সবজী ইত্যাদি উৎপাদন করার মাধ্যমে আমদানি নির্ভরতা কমাতে।
এছাড়াও উত্তর অঞ্চলের আমুদারিয়া নদীর পানি ব্যবহার করার জন্য একটি কৃত্রিম খাল খনন করার প্রকল্প ও গ্রহণ করে তালেবান সরকার। এর ফলে উত্তর অঞ্চলের পাঁচ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার হেক্টর মরুভূমি কৃষি উপযোগী জমিতে রূপান্তরিত হবে। যা থেকে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থানের ও সৃষ্টি হবে। আবার এই প্রকল্পের কারণে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। আর অবাক করা বিষয় হচ্ছে প্রকল্পটির অর্থায়ন হয়েছে আফগানিস্তানের ট্যাক্স হতে অর্জিত অর্থ থেকে। এবং এখানে কাজ করা ইঞ্জিনিয়ার হতে সাধারণ ওয়ার্কার সবাই ই আফগানিস্তানের। বিদেশী কোন পরামর্শ বা সহায়তা ছাড়াই এমন একটি প্রকল্পের এক তৃতীয়াংশ কাজ মাত্র ১০ মাসে শেষ করা সত্যিই অবিশ্বাস্য!!
আফগানিস্তানের হাতে নগদ অর্থের স্বল্পতা থাকলেও তাদের হাতে সম্পদের প্রাচুর্য্যতা রয়েছে। দেশটির হাতে যে পরিমাণ লিথিয়াম আছে, তার মূল্য তিন ট্রিলিয়ন বা তিন লাখ কোটি মার্কিন ডলার। এ মাসেই লৌহ, আকরিক ও স্বর্ণের খনি নির্মাণে চীনা, ব্রিটিশ ও তুর্কি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে তালেবান সরকার ৬৫০ কোটি ডলারের চুক্তি করেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে তেল উত্তোলনের জন্য চীনা কোম্পানির সঙ্গেও চুক্তি করেছে তালেবানরা। এদিকে পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানে যে ডলার পাচার হয়, তাতেও আফগান অর্থনীতিতে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ ডলার নিলামে তুলে দেশীয় মুদ্রাকে শক্তি যোগাচ্ছে।
তবে এ সফলতা কি স্থায়ী হবে? কেননা আফগানিস্তানে নগদ অর্থের সরবরাহ বাড়লেও মানবিক ও আর্থিক পরিস্থিতি এখনো ভয়াবহ। তালেবান ক্ষমতা দখলের পর যুক্তরাষ্ট্র দেশটির যে ৯৫০ কোটি ডলার রিজার্ভ জব্দ করেছিল, তার মধ্যে ৩৫০ কোটি ডলার তারা ছেড়ে দিতে রাজি হলেও পরে আবার বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে তা স্থগিত করে।
জাতিসংঘের সতর্ক বার্তা অনুযায়ী, চলতি বছর বিদেশি সহায়তা ৩০ শতাংশ কমলে দেশটির মানুষের মাথাপিছু আয় ৩০ শতাংশ কমে ৩০৬ ডলারে নেমে আসবে, অর্থাৎ ২০২০ সালের তুলনায় ৪০ শতাংশ কমবে।
এছাড়া ও নারীদের ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কারণে তালেবান প্রশাসনের ভেতরেই বিভাজন তৈরি হয়েছে। প্রশাসনের অনেকেই এখন সর্বোচ্চ নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার (Hibatullah Akhundzada) সমালোচনা করছেন। তাঁর নির্দেশে নারীদের পড়াশোনা, কাজ, পার্কে যাওয়া, ব্যায়ামাগারে ব্যায়াম করা ও পুরুষ সঙ্গী ছাড়া একা একা দূরে কোথাও ভ্রমণ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এদিকে চলতি ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এক মূল্যায়নে বলা হয়েছে, ইসলামিক স্টেট বা আইএস আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হামলার পরিকল্পনা করছে। এমনকি আইএস আফগানিস্তানেও হামলা চালাচ্ছে; যেমন এক প্রদেশের ডেপুটি গভর্নর ও মসজিদে হামলা চালিয়েছে তারা। জাতিসংঘের তথ্যানুসারে, আইএস আফগানিস্তানের মাটিতে চীন, ভারত ও ইরানের দূতাবাসে হামলার হুমকি দিয়েছে।
এই অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে আফগান মুদ্রার দর আবারও পড়ে যেতে পারে বলেই আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা। তালেবানরা দেশের ভেতরে নিয়ন্ত্রণ হারালে মুদ্রার গায়েও তার আঁচ লাগবে। তাছাড়া চীনের সাথে সীমান্ত থাকায় এখন পর্যন্ত চীনের বিনিয়োগ-ই দেশটিতে সবচাইতে বেশি। লক্ষ করলে দেখা যায় এখন পর্যন্ত চায়না ইনভেস্টমেন্টের উপর অধিক নির্ভরশীল বেশীরভাগ দেশই তাদের ঋন পরিশোধ না করতে পেরে নিজেদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হারিয়েছে । তাই আফগানিস্তানে ও এই ঋন কতটা ফলপ্রসূ ভুমিকা রাখবে তা বলা যায় না। প্রায় শুন্য থেকে শুরু করা তালেবান সরকার তার এই অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা কতদিন ধরে রাখতে পারবে তা সম্পর্কে তাই কেউ ই নিশ্চিত নয়।
কেমন লাগলো আমাদের আজকের ব্লগটি? কমেন্টে অবশ্যই জানাতে ভুলবেন না। ভালো লাগলে লাইক দিন নিউজলেটার , সাবস্ক্রাইব করুন এবং শেয়ার করুন সবার সাথে।