লক্ষ কোটি টাকার গাজী সাম্রাজ্য কি বিপদে? | Gazi Group Empire Under Threat | Business Mania
গাজী গ্রুপ (Gazi Group) বাংলাদেশে শিল্প ও ব্যবসা জগতের এক বিশাল নাম ।
যা চার দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশের বিভিন্ন খাত যেমন ম্যানুফ্যাকচারিং (Manufacturing), মিডিয়া (Media), কমিউনিকেশন (Communication) এ শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে।
এর অগ্রযাত্রার পেছনে রয়েছেন শিল্পপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী, যিনি টেক্সটাইল (Textile) ও পাট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং গাজীর অনুপস্থিতি গাজী গ্রুপের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু প্রশ্ন তৈরি করেছে।
নেতৃত্বের এই শূন্যতার মধ্যে গাজী গ্রুপ (Gazi Group) তার স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে পারবে কি না, এ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
প্রতিষ্ঠানটি এখন এমন এক মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে যেখানে নতুন চ্যালেঞ্জ ও সুযোগের মুখোমুখি তো হতে হবেই পাশাপাশি গাজীর উত্তরাধিকার তার ব্যবসার গতিপথ কতটা নির্ধারণ করবে সেটিও দেখার বিষয়। আর এর সবকিছু নিয়েই থাকছে বিজনেস ম্যানিয়ার (Business Mania) আজকের ব্লগ পোস্ট।
গাজী গ্রুপের যাত্রা শুরু হয় ১৯৭২ সালে, যখন গোলাম দস্তগীর গাজী প্লাস্টিক ও রাবার পণ্য উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেন। তখন থেকেই গাজী গ্রুপ (Gazi Group) একটি ছোট পরিসরের ব্যবসা থেকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শিল্প প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হতে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা গোলাম দস্তগীর গাজী, তার নেতৃত্ব এবং প্রভাবের মাধ্যমে গাজী গ্রুপকে দেশের অন্যতম শক্তিশালী ব্যবসায়িক গোষ্ঠীতে পরিণত করেন। তার উদ্ভাবনী ধারণা এবং দৃঢ় নেতৃত্বই কোম্পানিটিকে শিল্পের বিভিন্ন খাতে প্রতিষ্ঠিত করে।
১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে, গাজী গ্রুপের ব্যবসায়িক কার্যক্রম ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে। এই সময়ে প্রতিষ্ঠানটি গাড়ির টায়ার থেকে শুরু করে নির্মাণ সামগ্রী পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের পণ্যের উৎপাদন শুরু করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০২ সালে গাজী টায়ার কারখানার উদ্বোধন। এটি বাংলাদেশের প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে বড় আকারের টায়ার উৎপাদন শুরু করে, যা গাজী গ্রুপকে দেশের শিল্পখাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে আসে। গাজী টায়ারের মাধ্যমে গাজী গ্রুপ (Gazi Group) দ্রুত দেশের বাণিজ্যিক যানবাহন বাজারে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে, যা পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক বাজারেও রপ্তানির মাধ্যমে প্রসারিত হয়।
এরপর ২০০৯ সালে গাজী টেলিভিশন (Gazi Television) চালুর মাধ্যমে গাজী গ্রুপ মিডিয়া জগতে প্রবেশ করে। ২০১২ সালে আনুষ্ঠানিক সম্প্রচারের মাধ্যমে জিটিভি (Gazi Television) দেশের অন্যতম জনপ্রিয় চ্যানেলে পরিণত হয়। জিটিভি ক্রিকেটসহ দেশের বিভিন্ন বড় ইভেন্টের লাইভ (live) সম্প্রচারের অধিকার লাভ করে, যা চ্যানেলটির জনপ্রিয়তা বাড়ায়। বিশেষ করে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (Bangladesh Premier League) সম্প্রচার করার চুক্তি করার মাধ্যমে চ্যানেলটি ক্রীড়া সম্প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই চুক্তি শুধু চ্যানেলটির নয় বরং পুরো গাজী গ্রুপের প্রভাবকে আরও শক্তিশালী করে।
এছাড়াও গাজী পানির ট্যাংক, পানির পাম্প সহ কৃষি শিল্পের সাথে জড়িত নানা পণ্য উৎপাদন করে বাজারে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরী করে।
সামাজিক ক্ষেত্রেও গাজী গ্রুপের অবদান অনস্বীকার্য। কোভিড-১৯ (Covid-19) মহামারির সময় প্রতিষ্ঠানটি মানবিক সহায়তার জন্য ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল এবং নারায়ণগঞ্জে ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের জন্য চিকিৎসা ও সুরক্ষাসামগ্রী দান করে। এ ধরনের উদ্যোগ তাদের সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার একটি উদাহরণ হিসেবে প্রশংসিত হয়। এই সময়ে কর্মীদের সুরক্ষার জন্যও বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল ।
গাজী গ্রুপের উত্থান এবং সাফল্যের এই দীর্ঘ যাত্রায় এর নেতৃস্থানীয় ভূমিকা, প্রভাবশালী কার্যক্রম, এবং সমাজের প্রতি প্রতিশ্রুতি প্রতিষ্ঠানটিকে বাংলাদেশের শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতের অন্যতম উল্লেখযোগ্য নাম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
কিন্তু গোলাম দস্তগীর গাজীর কি গাজী গ্ৰুপ এর সুনাম ধরে রাখতে পেরেছেন ??
গোলাম দস্তগীর গাজীকে ঘিরে সম্পদ পাচার এবং অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। একাধিক তদন্তে উঠে এসেছে যে, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা (Canada), সিঙ্গাপুর (Singapore) এবং দুবাইয়ের (Dubai) মতো দেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন তিনি। হুন্ডির পাশাপাশি আমদানি ও রপ্তানির আড়ালে এই অর্থ পাচার করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মালয়েশিয়ার “মাই সেকেন্ড হোম (My Second Home)” প্রকল্পের অধীনে সেখানে তিনি অর্থ পাচার করে বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি, এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন। সিঙ্গাপুর (Singapore) এবং দুবাইয়ে গাজী গ্রুপের মালিকানাধীন একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা গাজীর এই অবৈধ কার্যক্রমকে আরও উন্মোচিত করে।
গত ১৫ বছরে গাজীর সম্পদের পরিমাণ ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে প্রায় ১৪৪৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর বিপরীতে, তার ব্যাংক ঋণের পরিমাণও বেড়ে প্রায় ৯৩৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। সামগ্রিকভাবে, গাজীর মোট দেনা এখন ১০২২ কোটি টাকা। ১৫ বছরের মধ্যে তার এই সম্পদ বৃদ্ধির হার প্রায় ২৫ গুণ। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, যেখানে ২০০৮ সালে তার ব্যাংক ঋণ ছিল মাত্র ৪৩ কোটি টাকা, বর্তমানে সেটি বৃদ্ধি পেয়ে ৯৩৫ কোটি টাকা হয়েছে, যা ২১ গুণ বেশি।
গাজীর স্ত্রী হাসিনা গাজীর সম্পদও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তার সম্পদের পরিমাণ ১৫ বছরে ২.১৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৬.৯ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এই অপ্রত্যাশিত সম্পদ বৃদ্ধির পেছনে গাজী দম্পতির অবৈধ কার্যকলাপই দায়ী বলে অভিযোগ উঠেছে। হাসিনা গাজী নারায়ণগঞ্জের তারাব পৌরসভার সাবেক মেয়র হিসেবেও প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেছেন।
এছাড়া, রূপগঞ্জের খাদুন এলাকায় গাজী টায়ার ফ্যাক্টরি (Gazi Tire Factory) নির্মাণের জন্য স্থানীয় কিছু জমি জোরপূর্বক দখল করা হয়। অভিযোগ রয়েছে যে, এভাবে প্রায় ১৫০০ বিঘা জমি গাজী দখল করেছেন, যার মধ্যে অনেক জমি ছিল সংখ্যালঘু পরিবারের।
আওয়ামী লীগের সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রী হিসেবে তার রাজনৈতিক প্রভাবও কাজে লাগিয়েছেন গোলাম দস্তগীর গাজী। সরকারি জমি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি নামমাত্র মূল্যে কেনা বা দখল করে তিনি তার সম্পত্তির পরিধি বাড়িয়েছেন। এই জমিতে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে গিয়ে এলাকার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছেন । তাদের আবাদি জমিতে গাজী স্টেডিয়াম (Gazi Stadium) এবং বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে।
বর্তমান অবস্থার কথা বিবেচনা করলে গাজী গ্রুপ (Gazi Group) কঠিন সঙ্কটের মুখোমুখি। ২০২৪ সালের ২৫ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে অবস্থিত গাজী অটো টায়ার কারখানায় ঘটে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। এই ঘটনার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম দস্তগীর গাজী গ্রেপ্তার হলে উত্তেজনার মধ্যে আগুন লাগে, যা ৬২ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে জ্বলতে থাকে। অগ্নিকাণ্ডে ১২৬ থেকে ১৭৬ জনের নিখোঁজ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারখানা কর্তৃপক্ষ জানায়, নিখোঁজদের কেউ শ্রমিক ছিল না; বরং সম্ভবত লুটপাট বা অন্য কোনো কারণে লোকজন ভেতরে প্রবেশ করেছিল। এর আগেই কারখানাটি ভাঙচুর ও লুটপাটের শিকার হয়। শত শত মানুষ ভেতরে ঢুকে আসবাবপত্র, মেশিন ও সম্পদ ধ্বংস করে।
কারখানার ভেতরের অবস্থা এতটাই বিপজ্জনক হয়ে পড়ে যে, আগুনে পোড়া ভবনের ওপরের তিনটি তলা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ দল ভবনটি পরিদর্শন শেষে একে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা করে।
গোলাম দস্তগীর গাজীর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের মামলায় তাকে আবারো জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এর প্রভাব পড়ে গাজী গ্রুপের ব্যবসায়িক ও সামাজিক অবস্থানে। এই অস্থিরতার মধ্যে, কোম্পানিটির ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় দেখা দিতে পারে । স্থানীয় জনগণের বিশ্বাসের অভাব এবং সরকারের দৃষ্টিতে কোম্পানির প্রতি অবহেলা, গাজী গ্রুপকে টিকে থাকার জন্য কঠোর চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
গাজী গ্রুপের অশান্ত যাত্রার এই পর্ব শেষ করার সময়, আমাদের উচিত সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের গভীর প্রভাব নিয়ে চিন্তা করা। গাজী অটো টায়ার (Gazi Auto Tire) কারখানায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ আগুন এবং এর নেতৃত্বের বিরুদ্ধে চলমান আইনি চ্যালেঞ্জগুলো কোম্পানির স্থিতিশীলতার প্রতি একটি কঠোর সতর্ক সংকেত।
গাজী গ্রুপের ভবিষ্যৎ এখন এক অন্ধকার পথে এবং জনসাধারণ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতিক্রিয়া এর গতিবিধি নির্ধারণ করবে। কোম্পানিটি কি এই সংকট থেকে উঠতে পারবে, নাকি এর খ্যাতি ও কর্মকাণ্ডের জন্য বিপর্যয়কর ক্ষতির সম্মুখীন হবে?
গাজী গ্রুপের পরিস্থিতি নিয়ে আপনার মতামত নিচে কমেন্টে শেয়ার করুন। আপনি কি মনে করেন, এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব কী হবে?
আপনাদের কি মতামত? জানিয়ে দিন আমাদের কমেন্ট বক্স এ আর পড়তে থাকুন বিজনেস ম্যানিয়া।