From Orphan to King of Watches ? Rolex ঘড়ি আভিজাত্যের প্রতীক কেন?
প্রায় ৬৪ বছর আগে ১৯৬০ সালে, ক্যাপ্টেন ডন ওয়ালশ এবং জ্যাক পিকার্ড (Don Walsh and Jacques Piccard) নামে দুই বিজ্ঞানী ডুব দিয়ে সমুদ্রের তলদেশে প্রায় ৩৫ হাজার ৮০০ ফুটেরও বেশি গভীরতায় পৌঁছেছিলেন। তাদের এই গভীর সমুদ্র অভিজানে অনেক জীবন রক্ষা কারি সরঞ্জামের সাথে যে জিনিষটি সবার নজর কেড়েছিল তা হল একটি ঘড়ি!! ঘড়িটি যেমন ছিল বিলাসী আর ব্যয় বহুল তেমনি ছিল গভীর সমুদ্রের পানির প্রবল চাপ সহ্য করার ক্ষমতা। আকর্ষণীয়ভাবে, ঘড়িটি কিন্তু তাদের হাতে ছিল না । বরং বিশেষ এই ঘড়িটি দুজন বিজ্ঞানী যে যান এ করে সমদ্রে নেমেছিল তার বাইরে স্ট্র্যাপ করা ছিল!! আসলে তারা ব্যাবহার করে ছিল রোলেক্স ব্র্যান্ড এর ডীপ সী স্পেশাল (Deep Sea Special) নামে ঘড়িটি। অন্যন্য ডিজাইন , আর কার্যকারীতার কারনে দুই ডাইভার আস্থা রাখে ঘড়িটির উপর । আর এভাবেই রোলেক্স এর বেশ সুনাম ছড়িয়ে পড়ে সবর্ত্র।
রোলেক্স , যার নাম শুনলেই চোখে ভাসতে থাকে এটি রয়্যাল এবং দামি ঘড়ির অবয়ব! যে ঘড়িতে থাকে ইউনিক ফিচার, বিলাসবহুল ভাইব এবং পার্ফেক্ট লুকিং ডিজাইন(perfect looking design)!
কিন্তু রোলেক্স কিভাবে নিছক ঘড়ি থেকে পার্ফেক্ট(perfect) একটি ব্র্যান্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লন্ডনের এক কোলাহলপূর্ণ শহর থেকে ১৯০৫ শুরু হয় রোলেক্সের যাত্রা। আর শুরুতে এই যাত্রার পথিক ছিলেন হ্যান্স উইলসডর্ফ(Hans Wilsdorf) নামের এক তরুণ উদ্যোক্তা। ১০০ বছরের বেশি সময় আগের কথা। সঙ্গে ছিলেন তাঁর শ্যালক আলফ্রেড ডেভিস (Alfred James Davis) । দুজনের নামের সঙ্গে মিলিয়ে কোম্পানির নাম রাখা হয় ‘উইলসডর্ফ অ্যান্ড ডেভিস’ আর তাদের ঘড়িতে থাকত কোম্পানীর ইনিশিয়াল ডব্লিউ এন্ড ডি।
প্রতিষ্ঠাতা পরিচিতি
শ্যালক–দুলাভাই মিলে ব্যবসা শুরু করলে যে তা একদিন সফল হতেই পারে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই রোলেক্স (Rolex) ।
হ্যান্স উইলসডর্ফের জন্ম জার্মানির বাভারিয়া অঞ্চলে ১৮৮১ সালে। নেশার দিক দিয়ে তিনি ছিলেন একজন উদ্যোক্তা। পাশাপাশি বিভিন্ন হাত ঘড়ির দিকেও ভদ্রলোকের ছিলো বিশাল ঝোঁক।
আর ঘড়ির প্রতি তার এই প্রচন্ড পরিমাণের ভালোবাসা তৈরি হয় সুইজারল্যান্ডের লা শ- দে-ফন্স (La Chaux-de-Fonds) নামে একটি বিশিষ্ট ঘড়ি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষানবিশ হিসাবে কাজ করাকালীন সময়ে।
এরপর উইলসডর্ফ লন্ডনে চলে আসেন। যা পরে রোলেক্স কোম্পানিতে পরিণত হয়।
কোম্পানির যাত্রা
পরবর্তিতে হ্যান্স এবং ডেভিস উভয়েরই উদ্ভাবনী শক্তির কল্যাণে ঘড়িতে সুইস মুভমেন্ট এবং ইংরেজ স্টাইল যোগ করা হয়। ফলে এই কোম্পানি ধীরে ধীরে সকলের নজরে আসে। তাদের কোম্পানি পুরো ব্রিটিশ সাম্রাজ্য জুড়ে – পকেট এবং হাত ঘড়ি বিক্রি শুরু করে।
নামকরণ
তিন বছরের মধ্যে, উইলসডর্ফ এবং ডেভিস ব্রিটিশ ঘড়ির বাজারে শীর্ষস্থান দখল করে ফেলে। কিন্তু খুতখুতে হ্যান্স সবসময় কিভাবে তার পণ্য কে আরো নিখুত করা যায় সে নিয়ে চিন্তা করত। এর ই ধারাবাহিকতায় তারা ঘড়ির ডায়াল এর ভেতরে একটি ব্র্যান্ড নাম খোদায় করতে চাইছিল। কিন্তু সে সময় ঘড়িতে এমন বৈশিষ্ঠ থাকা একদম অপ্রচলিত ছিল । কিন্তু নিয়ম ভাঙ্গায় ছিল হ্যান্স এর স্বভাব। তাইতো ১৯০৮ সালে W & D লিমিটেডের ট্রেডমার্ক হিসাবে “রোলেক্স” নামটি নিবন্ধন করেন।
কোম্পানির ভাষ্যমতে, লন্ডনে একটি ঘোড়ায় টানা ডাবল ডেকারে ঘোরার সময় একটি জিনি নাকি হ্যান্সের কানে “রোলেক্স” নামটি ফিসফিস করে বলে গিয়েছিল। সেই জাদু কথাটি বিশ্বাস করা হোক বা না হোক, যা সত্য তা হল “রোলেক্স” নামটি আদর্শ ছিল কারণ এটি যেমন মনে রাখা সহজ, তেমনি যেকোনো ভাষায় উচ্চারণ করা সহজ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সেই সময়ে, ডায়ালে ফিট করার মতো এটি ছিল যথেষ্ট ছোট। হান্সের এই সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল তা আজ ১০০ বছর পরে এসেও উপলব্ধি করা যায়।
১৯১৯ সালে এসে রোলেক্সকে সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতে স্থানান্তর করা হয়। ধীরে ধীরে প্রোডাক্টের চাহিদা বেড়ে গেলে ২ প্রতিষ্ঠাতাই ঘড়ির উদ্ভাবন এবং গুণমান উন্নত করার দিকে মন দিতে থাকে।
প্রথম ওয়াটারপ্রুফ ঘড়ি তৈরি
এরই প্রেক্ষিতে ১৯২৬ সালে রোলেক্স বিশ্বের প্রথম ওয়াটারপ্রুফ হাতঘড়ি অয়েস্টার (Oyster) বাজারে আনে। এই ঘড়িটিতে ধুলো এবং আর্দ্রতা থেকে নিজেকে রক্ষা করার মতো ক্ষমতা ছিলো। সেই সাথে ওয়াটারপ্রুফ ফিচার থাকায় কিছুদিনের মধ্যেই এই ঘড়িটি তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
এরপর অয়েস্টার পারপেচুয়াল ( Oyster Perpetual) নামে আরো একটি ঘড়ি বাজারে আনে রোলেক্স। ব্র্যান্ডের খ্যাতিমান ইতিহাসের অন্যতম আইকনিক মডেল হয়ে উঠে এই ঘড়ি। ১৯৩১ সালে প্রথমবারের মতো তৈরি করা এই ঘড়িতে রয়েছে ডিজাইন করা অয়েস্টার কেস, স্ক্রু–ডাউন ক্রাউন, ঘড়ির ব্যাক কেস, ওয়াটারপ্রুফ ফিচার। ১৯৫৩ সালে এডমন্ড হিলারী (edmund hillary ) ও তেনজিং নোরগে (Tenzing Norgay) এই ঘড়িটি পরে সর্বপ্রথম এভারেস্ট বিজয় করে যা রোলেক্স কে আরো তুমুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়।
তাছাড়া এই ঘড়িকে ১৯৭২ সালে আপডেট করার কারণে ঘড়িটির মেইনস্প্রিংয়ের সাহায্য ৩৬০° ঘুরানোর ফিচার যুক্ত করা হয়। মোটকথা এই ঘড়িটি রোলেক্সের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সেরা উদাহরণ হিসাবে বাজারে এক ধরণের ফ্যান্টাসি তৈরি করে। যে ফ্যান্টাসির জোরে সকলেরই মনে রোলেক্সের একটা ঘড়ি কেনার আশা তৈরি হতে থাকে।
সাবমেরিনার তৈরি
এরপর একটা সময় গিয়ে রোলেক্স সাবমেরিনার তৈরি করে বসে! হ্যাঁ! ঠিকই শুনেছেন!
এই সাবমেরিনার তথাকথিত সাবমেরিন নয়! এটি ঘড়ির বিশেষ একটি টুল বা ফিচার ছিলো। যা বিশেষভাবে পানির নিচে ডাইভিংয়ের জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল।
১৯৫৩ সালের সময়টাতে বাজারে আনা রোলেক্স সাবমেরিনারের ফিচারের প্রতি সবচেয়ে বেশি ঝুঁকে যায় ডুবুরিরা। অবস্থা এমন হয়ে উঠে যে যেকোনো মূল্যেই তারা রোলেক্স ব্র্যান্ডের এই চমৎকার টুলসের ঘড়ি চাই–ই চাই!
এছাড়াও ৫০ এবং ৬০ এর দশকে প্যান আমেরিকান ওয়ার্ল্ড এয়ারওয়েজের পাইলটদের জন্য ডিজাইন করা GMT-মাস্টার সহ আরও বেশ কয়েকটি আইকনিক মডেল বাজারে আনে রোলেক্স। সবমিলিয়ে এই ১০ বছরটা ছিলো রোলেক্সের টার্নিং পয়েন্ট। কারণ এই সময়টাতেই কোম্পানিটি তারিখ এবং সপ্তাহের দিন সম্পূর্ণরূপে শো করা ঘড়ি তৈরি করে পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়।
নেগেটিভ সাইড (Negative side)
এতো এতো জনপ্রিয়তা, কম সময়ে নতুন ফিচারের আবিষ্কারসহ এতো সফলতা থাকলেও হ্যান্স এবং ডেভিসের এই রোলেক্স কোম্পানিকেও বিতর্কের মুখে পড়তে হয়েছে।
শুধু তাই নয়! আপনি জানলে অবাক হবেন… এই ব্র্যান্ডের এমনকিছু ডার্ক সাইড(Dark side) রয়েছে।
প্রাইজ(Price)
রোলেক্স কোম্পানির প্রথম নেগেটিভ সাইড হলো এই কোম্পানির প্রোডাক্ট হাই প্রাইস ট্যাগ (High Price Tag)।
ধরুন আপনি যদি রোলেক্সের অত্যাধুনিক ডিজাইন এবং ডুয়াল টাইম জোন সমন্বিত স্কাই ডুয়েলার(Sky Dweller) নামের ঘড়িটি কিনতে চান তাহলে আপনাকে গুনতে হবে প্রায় ১৭ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। অন্যদিকে ডেটজাস্ট (Datejust) ঘড়ির দাম ৮ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা এবং রোলেক্স ডেটোনার(daytona) দাম ১৭ লক্ষ টাকা।
অন্যদিকে এই ব্র্যান্ড বিশ্বে সামাজিক অবস্থানকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরে। অর্থ্যাৎ এমন একটি পরিবেশ তৈরি করে যেখানে বোঝানো হয় রোলেক্স ঘড়ি কিনতে না পারাটাই বোধহয় আর্থিক দূর্বলতার অংশ। মোটকথা রোলেক্সের যোগসাজশে পৃথিবীতে সামাজিক বিভাজন অনেক বেশি হারে পরিলক্ষিত হতে থাকে এবং বর্তমানেও এমনটাই হচ্ছে।
রোলেক্স ব্র্যান্ডের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ নেগেটিভ দিক হলো এর এক্সক্লুসিভিটি। অর্থ্যাৎ বাজারে এই ব্র্যান্ডের ঘড়ি খুব কমই ছাড়া হয়। যার কারণে দিনশেষে চাহিদা মেটে না ঠিকই! তবে দামটা থাকে আকাশছোঁয়া!
তাছাড়া টাকা–পয়সা সব জোগাড় করে আপনি যদি রোলেক্স ঘড়ি কিনতেও চান তাহলে আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে দীর্ঘ সময়। নির্দিষ্ট রোলেক্স মডেলের অত্যধিক চাহিদা থাকার কারণে আপনি এই ঘড়ি অর্ডার করা মাত্রই হাতে পাবেন না। অবাক করা বিষয় হলো পছন্দসই রোলেক্স ঘড়ি খুচরা মূল্যে কিনতে হলে আপনাকে কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে। তাছাড়া এই দীর্ঘ অপেক্ষা সম্ভাব্য বায়ারদের মধ্যে হতাশা এবং অসন্তোষেরও সৃষ্টি করে।
বর্তমান পরিস্থিতি
হ্যান্স উইলসডর্ফ ১৯৬০ সালে মৃতুবরন করার পর থেকে রোলেক্সের মালিকানার দায়িত্ব পালন করছে “হ্যান্স উইলসডর্ফ” ফাউন্ডেশন নামের একটি অর্গানাইজেশন, যা উইলসডর্ফ তার স্ত্রী ফ্লোরেন্স ফ্রান্সেস মে ক্রোটির অকাল মৃত্যুর পর প্রতিষ্ঠা করেন ।
এই অর্গানাইজেশনের প্রধান দায়িত্ব হলো রোলেক্স কোম্পানির লাভের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ শিক্ষা এবং বিভিন্ন সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচিসহ দাতব্য কাজে ব্যয় হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করা।
তাই বর্তমানে রোলেক্সের এই যাত্রা বেশ ভালোভাবেই চলছে। এতোকিছুর পরও কোম্পানিটি স্বাধীনভাবে নিজেদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি রোলেক্সের প্রতিশ্রুতিই সম্ভবত ব্র্যান্ডটি বিশ্বের নাম্বার ওয়ান টাইমপিস ব্র্যান্ডে পরিণত করেছে। যেখানে ঘড়ির প্রতিটি উপাদান সাবধানতার সাথে তৈরি করা হয় এবং সময়ের সাথে সাথে মাথানষ্ট সব ফিচারে নতুনরূপে সাজানো হয় পুরনো মডেলে ঘড়ি। ফলস্বরূপ বাজারে আসে নতুন মডেল।
তবে প্রযুক্তি এবং গ্রাহকের চাহিদা বজায় রেখে রোলেক্স কি এভাবে বছরের পর বছর বিশ্বে টিকে থাকতে পারবে? নাকি নতুন কোনো এক কম্পিটিটর এসে দখল করবে টাইমপিসের এই বিলাসবহুল ব্র্যান্ডের জায়গা?
কমেন্ট বক্সে আপনার মতামত জানিয়ে দিন এক্ষুণি! নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করে ফেলুন।