মাথাপিছু ঋণ ১ লাখ ১৮ হাজার টাকা! আমাদের ভবিষ্যৎ কী অন্ধকারে? | Foreign Loan of BD | Business Mania
শেখ হাসিনা সরকার তথা আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনের অবসান হওয়ার পরবর্তীতে ধীরে ধীরে সে সরকারের নানান অনৈতিক কর্মকান্ড ও কেলেঙ্কারির তথ্য ফাঁস হচ্ছে। দেশবাসী ও পুরো বিশ্বও সে বিষয়ে জানতে পারছে। শেখ হাসিনা সরকারের কেলেঙ্কারির গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি বিষয়বস্তু হচ্ছে অস্বাভাবিক হারে ঋন গ্রহন,যা প্রতি বছরেই বৃদ্ধিরত পর্যায়ে ছিল। এই ঋন নেওয়ার পেছনে ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের টাকা আত্বসাত করার কর্মকান্ড। বিভিন্ন প্রজেক্ট বাস্তবায়নের নামে সরকার বাছ বিচার ছাড়ায় বিভিন্ন বৈদেশিক ও দেশী ঋন গ্রহন করেছে এবং সেখানে বিভিন্নভাবে লুটপাটের কার্যক্রমের বাস্তবায়ন করেছে।
আওয়ামী লীগ সরকার কোন কোন বিদেশী উৎস থেকে ঋন নিয়েছে? সরকার ঋন নেওয়ার পরবর্তীতে কী কী দুর্নীতি ঘটিয়েছে ও কীভাবে টাকা লুটপাট করেছে? এখন ঋন পরিশোধের জন্য কী কী কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রয়োজন? এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও বিষয়াবলি নিয়েই আজকের ব্লগ পোস্ট।
বহিঃদেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার জাপান, রাশিয়া, চীন ও ভারতের নিকট হতে প্রধানত ঋন নিয়েছিল। এ ঋন নেয়া হয়েছিল মুলত দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় এবং এ চুক্তি অনুযায়ী জাপানের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ৯.২১ বিলিয়ন ডলার ঋন নিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার। এরপর রাশিয়ার কাছ থেকে ৫.০৯ বিলিয়ন ডলার, চীনের থেকে ৪.৭৬ বিলিয়ন ডলার ও ভারতের থেকে ১.০২ বিলিয়ন ডলার ঋন করেছে তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকার। উক্ত ঋন নেওয়ার তথ্যটি সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ওয়েবসাইটে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট ডাটা হিসেবে পাওয়া যায়। এ সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক ঋন ছিল ৫৫.৬০ বিলিয়ন ডলার। আর এখন সাম্প্রতিক সময়ের একটি তাৎপর্যপুর্ন বিষয় জেনে নেওয়া যাক। ফ্যাসিস্ট সরকার পদত্যাগের সময় ঋন রেখে গেছে ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। যা এখন ড. ইউনুসের অন্তর্বতীর্কালীন সরকারের উপরে এসে পড়েছে। এর মধ্যে দেশীয় বিভিন্ন উৎস থেকে ঋন নেয়া হয়েছে ১০ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশী উৎস থেকে ঋন ৮ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা।
বৈদেশিক ঋনগুলোর উৎসের মধ্যে অন্যতম আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা International Money Fund (IMF) এর থেকে আওয়ামি লীগ সরকার ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋন নেয়া আছে এবং এই ঋন ৭টি কিস্তিতে ৪২ মাসে পরিশোধ করার কথা ছিল। কিন্তু এই ঋনের অনেকগুলো কিস্তির টাকা পরিশোধ করেনি এবং পদত্যাগ করেছে। ফ্যাসিস্ট সরকার সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে এই ঋন নিয়েছিল এবং এখন সিঘ্রই অন্তর্বতীর্কালীন সরকারকে এই ঋনের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে যা ড. ইউনুস এর জন্য বড় মাথা ব্যাথার কারন।
সরকার বিভিন্ন প্রজেক্ট ও কার্যক্রম বাস্তবায়নের নামে ১ টাকার কাজের জন্য ১০০ টাকা ঋন নিয়েছে এবং বাকি ৯৯ টাকা লুট করেছে। প্রজেক্টগুলোর মধ্যে রয়েছে রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্প, পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প, আর বেসরকারী খাতের ৬৪ টি কলকারখানার প্রকল্প। এগুলো ছাড়াও আর অনেক প্রকল্পে জালিয়াতির বিষয়টি বিদ্যমান রয়েছে, তবে প্রধানত এ প্রকল্পগুলোই তাতপর্যপুর্ন ।
রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্পের বাস্তবায়নের নামে ৫০০ কোটি ডলার আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে শেখ হাসিনার উপর। যুক্তরাষ্টভিত্তিক ওয়েবসাইট গ্লোবাল ডিফেন্স কর্প (Global Defense Corp) এ দাবি করেছে। যেখানে বলা হয় এ জালিয়াতির কার্যক্রমে মধ্যস্থতা হিসেবে কাজ করেছেন শেখ হাসিনার ভাগ্নি শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক। গ্লোবাল ডিফেন্স কর্প (Global Defense Corp) নামক এই সাইটের দাবি, মালয়েশিয়ার বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে শেখ হাসিনা পরিবারকে অর্থ আৎসাতের সুযোগ করে দেয় রাশিয়ার প্রতিষ্ঠান রোসাটম। রোসাটম (Rosatom) রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে। রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্পের উদ্যােগের নামে রাশিয়ার কাছ থেকে মোটা অংকের ঋন নিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছিল ১লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। এখন তাদের দুর্নীতি ফাস করছে দুর্নীতি প্রচারকারী সাইট গ্লোবাল ডিফেন্স কর্পে (Global Defense Corp),বলা হচ্ছে এই দুর্নীতিতে শামিল রয়েছে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। এ নিয়ে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে যে এই পাচার করা অর্থের ৩০ ভাগ পান শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপ ও তার পরিবার। এ প্রকল্পের নির্মানের বাজেট প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বাড়িয়ে ১২ হাজার ৬৫ কোটি ডলার ধরা হয়েছিল। মুলত এই অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়েই রাশিয়ার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঋন নিয়ে ৫০০ কোটি ডলার লুট করে শেখ হাসিনার পরিবার।
দ্বিতীয় প্রকল্প হিসেবে পদ্মা সেতু নির্মানের ক্ষেত্রে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। যেখানে চীনের থেকে ২৪ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা ঋনের চুক্তি করে। কিন্তু এ বিষয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক বলেন, পদ্মা সেতু নির্মানে চীনের থেকে কোনো ঋন নেয়া হয়নি। যা ছিল সম্পুর্ন মিথ্যা । চীনের সংবাদপত্র গুলিতেও তে চীনের থেকে বাংলাদেশের ঋন নেওয়ার বিষয়টি পরিষ্কারভাবে উল্লেখিত হয়েছে। এখানে শেখ হাসিনা সরকারের বড় অংকের টাকা জালিয়াতি করার আভাস পাওয়া যায়।
এরপর বেসরকারী খাতের ৬৪ টি কলকারখানার প্রকল্প বাস্তবায়ন করার নামে শেখ হাসিনা সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে। আর সে টাকার সুনির্দিষ্ট পরিমান জানা যায়নি। এ প্রকল্পে বাংলাদেশ প্রাইভেটাইজেশন বোর্ডের মাধ্যমে আজ অবধি ৬৪ টি মিল ও কলকারখানা বেসরকারীকরণ করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে খুলনার এজাক্স ও সোনালি, কুস্টিয়ার মোহিনী মহসিন জুটমিল সহ ৬৪ টি কলকারখানা। যার একটিও চালু করার দৃষ্টান্ত নেই। এসব প্রকল্পের বাস্তবায়নের জন্য তৎকালীন সরকার ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা ঋণ নিলেও কোনো মিল সংস্কার করেনি ,বরং সম্পুর্ন টাকা তারা লুট করেছে।
ঋনের নামে বাংলাদেশকে ফাঁদে ফেলতে পারে চীন। দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলোর উপর চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রও উদ্বিগ্ন ছিল। পাকিস্তান, কেনিয়া ও শ্রীলঙ্কা ও চীনের থেকে ঋন নিয়েছিল এবং পরবর্তীতে তারা এ ঋনের ফাদে পড়ে । চীন বিভিন্নভাবে নিজ স্বার্থ উদ্ধার করেছিল এ ৩ দেশকে ঋন প্রদান করে।
বেসরকারী গবেষনা সংস্থা CPD একটি বার্তা দিয়েছে যে পদ্মা সেতুসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্পে ৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে সম্মত হয়েছিল চীন। শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগে যা বর্তমান সরকারের ঘাড়ে এসে পড়েছে। এজন্য বলা যায় চীন নিজ স্বার্থে এই ঋনের মাধ্যমেও বাংলাদেশকে ফাদে ফেলতে পারে।
বিগত সরকারের রেখে যাওয়া ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋন পরিশোধ করার সমস্ত দায় শেষ পর্যন্ত জনগণের কাঁধেই পড়বে। জনগণের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আদায় করেই সরকারের আয় বাড়াতে হবে,এ ছাড়া বিকল্প নেই বলে মনে করেন অনেক অর্থনীতিবিদ।
বর্তমানে বাংলাদশের মানুষের মাথাপিছু ঋণ প্রায় দেড় লক্ষ টাকা যা ভবিষ্যৎ কমার লক্ষন নেই। বিশ্বব্যাংকের মতে ঋন পরিশোধের ক্ষেত্রে দুটি পথ আছে। একটি সরকারী আয় বাড়ানো দুটি উপায় থাকে, প্রথমত আয়কর বাড়ানো ও পরোক্ষ আয় যেমন মেট্রো, এলিভেটেড এর ভাড়া বাড়ানো এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে রিফাইনান্সিং। রিফাইনান্সিংয়ের ক্ষেত্রে নতুন ঋন দিয়ে পুরনো ঋন পরিশোধ করা হয়। রাজস্ব আয় বাড়ানো যদি সম্ভব না হয় তাহলে বিকল্প থাকবে সরকারের ব্যয় কমানো।
এছাড়া বাংলাদেশ থেকে যে লক্ষাধিক কোটি কালো টাকা পাচার হয়েছে , এ পাচার করা যত সহজ তা ফিরিয়ে আনা ততই কঠিন। গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (GFI) এর তথ্যমতে গড়ে প্রতিবছর ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়।
ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে মন্তব্য জানান কমেন্ট বক্সে, পরবর্তি ব্লগ পড়তে বিজনেস ম্যানিয়ার নিউজলেটারটি সাবসস্ক্রাইব করুন।