শুন্য থেকে ১৫০০০ হাজার কোটি টাকার কোম্পানী । The Dark Story of Bashundhara Group | Business Mania
বসুন্ধরা (Bashundhara) গ্রুপ, বাংলাদেশের সবচেয়ে বিতর্কিত এক কর্পোরেট সাম্রাজ্য।
এক সময়ের ছোট কাগজ ব্যবসা থেকে শুরু করে যারা আজকের প্রভাবশালী কনগ্লোমারেট (Conglomerate)। ১৯৯০ এর দশক হতে সিমেন্ট (Cement), কাগজ (Paper), টিস্যু পেপার (Tissue Paper) এবং ইস্পাত (Steel) উৎপাদন, এলপি গ্যাস (LP Gas) এর বোতলজাতকরণ এবং বিতরণের সহ বিভিন্ন ব্যবসা করে আসছে। ২০১৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক দায়েরকৃত কর ফাঁকির মামলায় বসুন্ধরা গ্রুপের কর্মকর্তাদের আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট (Supreme Court)। ২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর বসুন্ধরার জমির দাম নিয়ে মোহাম্মদ শাহজাহান ‘জালিয়াতির’ (Forgery) অভিযোগে বসুন্ধরার চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন।
আর কিভাবে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবসার উত্থান ও এই বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে উঠার পিছনের যত দুর্নীতি, রাজনৈতিক অপব্যবহার ও ভূমি দস্যু এই নিয়েই বিজনেস ম্যানিয়ার আজকের ব্লগ পোস্ট।
বসুন্ধরা (Bashundhara) গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ আকবর সোবহান, যিনি শাহ আলম (Shah Alam) নামেই বেশি পরিচিত।
তিনি ১৯৫২ সালে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া (Brahmanbaria) জেলার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
তার পরিবার মূলত কৃষিজীবী ছিল এবং সেই সময়ে তেমন কোনো বড় ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে যুক্ত ছিল না।
শৈশব থেকে শাহ আলমের ব্যবসায়িক ঝোঁক ছিল। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (Dhaka University) থেকে অর্থনীতিতে পড়াশোনা করেছিলেন।
যদিও তার পড়াশোনা তাকে সরকারি চাকরি বা অন্য কোনো নির্দিষ্ট পেশায় নিয়ে যেতে পারত, কিন্তু শাহ আলম বরং ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে মনস্থির করেন।
তার জীবনের প্রথম দিককার দিনগুলোতে তিনি ঢাকায় ছোটখাটো ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। তার ব্যবসায়িক যাত্রা শুরু করেছিলেন ঢাকায় বেশ সাধারণ ধরনের কিছু উদ্যোগের মাধ্যমে। একপর্যায়ে তিনি কাগজের (Paper) ব্যবসায় হাত দেন, যেটি তাকে ব্যবসায়িক পরিচিতি এনে দেয়।
শাহ আলমের প্রথম বড় পদক্ষেপ আসে ১৯৮৭ সালে, যখন তিনি ইস্ট-ওয়েস্ট প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট (East-West Property Development) প্রতিষ্ঠা করেন। ইস্ট-ওয়েস্ট প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট শুরু হয় একটি কাগজের মিল হিসেবে।
আর তখন বাংলাদেশ দ্রুত আধুনিকায়নের (Modernization) পথে হাঁটছিল এবং কাগজের (Paper) চাহিদা দ্রুত বাড়ছিল।
শাহ আলম এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তার ব্যবসাকে সম্প্রসারণ করতে থাকেন। তার ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত এবং কঠোর পরিশ্রম তাকে সফলতার (Success) পথে নিয়ে যায়।
১৯৯০-এর দশকে, যখন দেশের অর্থনীতি উন্মুক্ত (Open) হতে শুরু করে, শাহ আলম রিয়েল এস্টেট (Real Estate) এর সম্ভাবনা দেখতে পান। সে সময় শাহ আলম মূলত ঢাকার আবাসিক ও বাণিজ্যিক রিয়েল এস্টেট প্রকল্পগুলোর উপর মনোযোগ দেন।
ঢাকা শহরের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকায় নগর উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা তীব্র হয়, আর শাহ আলম সেই চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে এই খাতে প্রবেশ করেন। তার প্রকল্পগুলো মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য বিশেষভাবে আকর্ষণীয় ছিল এবং সময়ের সাথে সাথে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের (Investors) দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়।
এই রিয়েল এস্টেট (Real Estate) খাতে তার সাফল্যই তাকে অন্যান্য শিল্পে যেমন সিমেন্ট (Cement), কাগজ (Paper), এবং পরে মিডিয়ায় (Media) প্রবেশের সুযোগ করে দেয়। আর তার এই উদ্যোগই বসুন্ধরা (Bashundhara) গ্রুপকে একটি ছোট কাগজ কোম্পানি থেকে দেশের অন্যতম বৃহৎ রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার (Developer) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
কিন্তু এটা ছিল কেবল শুরু।
এরপর তিনি সিমেন্ট ব্যবসায় প্রবেশ করে, বসুন্ধরা সিমেন্ট (Bashundhara Cement) চালু করে, যা অঞ্চলের বৃহত্তম সিমেন্ট উৎপাদকদের একটি হয়ে ওঠে। খুব শীঘ্রই তারা ভারী শিল্পের (Heavy Industry) দিকেও প্রবেশ করা শুরু করে, বসুন্ধরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স (Industrial Complex) চালু করে। তাদের পোর্টফোলিওর (Portfolio) মধ্যে শিপিং (Shipping), ইস্পাত (Steel), শক্তি (Energy) এবং এমনকি মিডিয়াও অন্তর্ভুক্ত ছিল। বাংলাদেশ প্রতিদিন (Bangladesh Pratidin), দেশের অন্যতম বৃহত্তম সংবাদপত্রও তাদের মালিকানাধীন।
তার এই প্রাথমিক ব্যবসায়িক উদ্যোগগুলো বসুন্ধরা গ্রুপের বিশাল সাম্রাজ্যের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এতে করে তিনি নির্মাণ ও অবকাঠামো (Infrastructure) খাতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন, যা পরবর্তীতে তার ব্যবসা সম্প্রসারণে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারে সহায়ক হয়। তাদের কৌশল ছিল পরিষ্কার — সর্বস্তরের জনগণের মাঝে তাদের আধিপত্য বিস্তার করা।
শাহ আলমকে দেখলে মনে হয় তিনি যেন বাংলাদেশের কর্পোরেট দুনিয়ার ‘মাঝি’ (Helmsman)।
তবে মাছ ধরতে নয়, তিনি ব্যবসার বড়শিতে ধরেন জমি (Land) আর ঋণ (Loan)।
সিমেন্ট (Cement), মিডিয়া (Media), রিয়েল এস্টেট (Real Estate)—সব এক ঝাঁকেই। আর যখন দেশটার ব্যাংকিং (Banking) খাত ভেঙে পড়ছে, তিনি যেন তৃপ্তি নিয়ে নদীর তীরে বসে বড় বড় চুক্তি গিলছেন!
রিয়েল এস্টেটে তাদের প্রথম সফলতা এবং বাড়তে থাকা রাজনৈতিক সংযোগ ব্যবহার করে, বসুন্ধরা প্রবল গতিতে সম্প্রসারণ করতে সক্ষম হয়েছিল।
কিন্তু এই বিশাল সাম্রাজ্য ও আধিপত্য কি এতো সহজেই সম্ভব হলো? এখানেই পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নেওয়া শুরু করে।
বাংলাদেশের ব্যবসায়িক দৃশ্যে একটি শক্তিশালী নাম বসুন্ধরা (Bashundhara)। সাফল্যের সাথে সাথে উঠে আসে তাদের নানা দূর্নীতি (Corruption) ও অসৎ কর্মকান্ডের কথা। নানা ধরনের বিতর্ক (Controversy) ও অভিযোগের মুখোমুখিও হওয়া শুরু করে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও অন্যান্য সদস্যরা।
তাদের ভূমি দখল (Land Grabbing), অবৈধভাবে সরকারি সম্পত্তি অধিগ্রহণ (Acquisition) এবং রাজনৈতিক প্রভাবের (Influence) মাধ্যমে ব্যবসা সম্প্রসারণের অভিযোগগুলো ক্রমাগত সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে শুরু করে।
এক্ষেত্রে বসুন্ধরা গ্রুপের ভূমি দখলের অভিযোগের পেছনের পটভূমি জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৮৭ সালে শাহ আলমের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, বসুন্ধরা ঢাকায় একটি শক্তিশালী ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য হিসেবে গড়ে ওঠে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক (Political) অস্থিরতা এবং দুর্বল আইনগত কাঠামকে কাজে লাগিয়ে বসুন্ধরা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। এই সম্পর্কগুলো তাদের অবৈধ জমি দখলে সহায়ক হয়।
দেশের দ্রুত নগরায়ণের সময়, সরকারি জমি (Government Land) এবং জলাভূমি (Wetlands) দখল করে বসুন্ধরা বিভিন্ন প্রকল্প শুরু করে। বসুন্ধরা রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া (Residential Area) এবং রিভারভিউ (Riverview) প্রকল্পের মাধ্যমে তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করে।
বসুন্ধরা যে জমিগুলি দখল করেছে, সেগুলোর অধিকাংশ RAJUK থেকে অনুমোদিত নয়। তবুও, রাজনৈতিক শক্তি ও অর্থের প্রভাবে তারা আইনি ঝুঁকি এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।
তারা সরকারি জমি, জলাভূমি এবং সরকারি সম্পত্তি দখল করে যথাযথ অনুমোদন (Approval) ছাড়াই।
বসুন্ধরা রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া এবং রিভারভিউ প্রকল্পকে প্রধান উদাহরণ হিসেবে নিন। এই প্রকল্পগুলি নৌকাঘাট, জলাভূমি এবং এমনকি স্মৃতিস্তম্ভ স্থান পূর্ণ করে তৈরি করা হয়েছিল। এই গ্রুপটি বিশাল পরিমাণ সরকারি জমি অধিগ্রহণ করেছে।
তবুও, বসুন্ধরা সামনে এগিয়ে গেছে, এই অবৈধভাবে দখলকৃত জমির প্লট ধনীদের কাছে বিক্রি করে, প্রক্রিয়ায় শত কোটি টাকা (Crores) সংগ্রহ করেছে।
প্রায় ১১০০ একর জমি অধিগ্রহণের অভিযোগও রয়েছে এই বসুন্ধরা গ্রুপের বিরুদ্ধে।
প্রতিটি কর্পোরেট সাম্রাজ্যের পিছনে রাজনৈতিক সংযোগের একটি জাল থাকে, এবং বসুন্ধরা গ্রুপও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু দুর্নীতি রিয়েল এস্টেট এবং ব্যাংকিংয়ের মধ্যে থেমে নেই।
তাদের সরবরাহের নিয়ন্ত্রণ তাদেরকে বাজারের কেন্দ্রীভূত করে এবং মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা দেয়, যা অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি (Damage) সাধন করছে। এত অভিযোগ জমে যাওয়ার পর কর্তৃপক্ষের নজর দেয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা ছিল।
বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (CID) গ্রুপের কার্যক্রমে তদন্ত শুরু করে, জালিয়াতি (Forgery), জাল সার্টিফিকেট, ভ্যাট এভেশন (VAT Evasion) এবং অর্থ পাচারের (Money Laundering) দিকে মনোযোগ দেয়। এই তদন্তের শিকার হন আহমেদ আকবর সোবহান, তার ছেলে সায়েম সোবহান আনভীর এবং সাদাত সোবহান তানভীর, এবং অন্যান্য প্রধান নির্বাহীরা।
ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম (Financial Crime) ইউনিট একটি জটিল অবৈধ কার্যক্রমের জাল উন্মোচন করে, যেখানে অর্থ দেশের বাইরে পাচার হওয়া এবং জাল ঋণ ব্যাংকগুলিকে বিশাল অগ্রিম ঋণের বোঝায় ফেলার তথ্য। সায়েম সোবহান আনভীরের স্বর্ণ পাচারের (Gold Smuggling) সঙ্গে জড়িত থাকা এই মামলাকে আরো একটি স্তরে যোগ করেছে।
বসুন্ধরার কার্যক্রমের প্রভাব কেবল তাদের কর্পোরেট অফিস বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যখন একটি শক্তিশালী কনগ্লোমোরেট যেমন বসুন্ধরা জনগণের জমি শোষণ (Exploitation) করে, বাজার Manipulate করে এবং কর ফাঁকি দেয়, এর ব্যয় সাধারণ নাগরিকদের উপরই পড়ে।
পাবলিক স্পেস হারিয়ে যায়, সরকারি রাজস্ব কমে যায়, এবং অর্থনীতি শীর্ষ স্তরের মানুষদের পক্ষেই ঝুঁকে পড়ে।
তাদের আগ্রাসী রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন সম্পত্তির মূল্য বাড়িয়ে দেয়, যা সাধারণ বাংলাদেশিদের জন্য বাড়ি কেনা কঠিন করে তোলে। একই সাথে, তারা জনগণের জমি এবং জলাভূমি দখল করার মাধ্যমে প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিঘ্নিত (Disrupt) করছে, যা দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশগত ক্ষতি ডেকে এনেছে।
৪২,০০০ কোটি টাকার অপ্রাপ্ত ঋণ নিয়ে, বসুন্ধরার অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থতা দেশের ব্যাংকিং খাতের উপর বিশাল চাপ ফেলেছে। শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে বাধা দেয়।
তাহলে, কিভাবে বসুন্ধরা গ্রুপ একটি সাধারণ কাগজ ব্যবসা থেকে বাংলাদেশে বৃহত্তম এবং সবচেয়ে বিতর্কিত কর্পোরেট সাম্রাজ্যে পরিণত হলো? এটি উচ্চাকাঙ্ক্ষা (Ambition), লোভ (Greed), রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং দুর্নীতির গল্প।
যদিও তারা একটি সাম্রাজ্য নির্মাণ করেছে যা বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রতিটি কোণে প্রভাবিত করে, তারা একটি বিধ্বংসী ট্রেলও রেখে গেছে।
আর তা হলো অপরিশোধিত ঋণ, জনগণের সম্পদ খরচ, এবং এমনকি দেশের অর্থনীতির শোষন।
জন সচেতনতার জন্য ব্লগটি শেয়ার করুন আপনার পরিজনের সাথে। ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে মন্তব্য জানান কমেন্ট বক্সে, পরবর্তি ব্লগ পড়তে বিজনেস ম্যানিয়ার নিউজলেটারটি সাবসস্ক্রাইব করুন।