BlackRock’s Aladdin কিভাবে বিশ্ব অর্থনীতি বদলে দিচ্ছে ? Dark Side of ALADIN AI Software
বর্তমানে ২০২৪ সালে এসে আমরা যেখানে চ্যাট জিপিটি (ChatGPT) আর মিড জার্নির (Midjourney) মতো এ আই টুলগুলোর ব্যবহার নিয়ে মাতামাতি করছি। এটাও ভাবছি যে হয়তো সুদূর কোন ভবিষ্যতে এসে এই টুলগুলো আমাদের জীবন ও জীবিকা তে আধিপত্য কিংবা সহজ করতে শুরু করবে । সেখানে আপনাকে যদি বলা হয় যে , সেই ১৯৮৮ সাল থেকেই এমন একটি AI Tool আছে যা কিনা কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করা অর্ধেক এরও বেশি কর্মী কে রিপ্লেস করে দিয়েছে। আর যদি বলা হয় তাদের মধ্যে ছিল বাঘা বাঘা সব ওয়াল স্ট্রিটের ফান্ড ম্যানেজার এবং ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার , তাহলে কেমন লাগবে?
শুধু তাই না, এই AI tool এর কাছে এত পরিমান ডাটা রয়েছে যা দিয়ে পৃথিবীর যে কোন শেয়ার মার্কেট ম্যানিপুলেট এমন কি একটি দেশের অর্থনৈতিক মানচিত্র পরিবর্তন করা তাদের জন্য অনেক সহজ কাজ।
আর এই সফটওয়ার এর পেছনে কার হাত আছে জানলে আপনি মোটেও অবাক হবেন না । সে ব্যক্তি আর কেউ নয় কুখ্যাত ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম ব্ল্যাকরক এবং তার প্রতিষ্ঠাতে ল্যারি ফিঙ্ক (Larry Fink)।
আপনাদের অনেকেই হয়তো ২০০৮ সালে আমেরিকায় ঘটা গ্রেট রিসেশন এর ব্যাপারে জানা আছে। যেই রিসেশনে আমেরিকার সে সময়কার সবথেকে বড় ফ্যাইনেনসিয়াল ব্যাংক lahmen brothers অব্দি ফল করে। যার সাথে ছিল আরো অনেক বড় বড় ফ্যাইন্যানসিয়াল ইনিস্টিউট আর হেজ ফান্ড। কিন্তু মার্কিন সরকার এর পক্ষে সে সময় সবাইকে সহায়তা দিয়ে এই রিসেশন থেকে বের করে আনা সম্ভব ছিল না। তাই মার্কিন কংগ্রেস তখন ৩০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল একটি বাজেট প্রকল্প হাতে নেয়৷ কিন্তু এই অর্থ দিয়ে তারা ঠিক কাদের সাহায্য করলে লাভজনক হবে হবে সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খাচ্ছিল। এই বিশাল পরিমান অর্থ বন্টনের জন্য তখন তারা ল্যারি ফিঙ্ক এবং তার প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাকরক কে কন্সাল্টেন্সির জন্য ডাকা হয় । আর তারা এই পুরো কাজে সহায়তা নেয় তাদের ALADIN নামের এই আই টুলের। বলতে গেলে একটা সে সময় একটি আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ডিসাইড করে যে অর্থনৈতিক এই ডাউনফল থেকে কাদের সাহায্য করা হবে আর কাদের করা হবে না। যদিও এটা নিয়ে সে সময় আমেরিকায় বেশ কিছু প্রটেস্ট বা আন্দোলন হয়, যে একটা রোবট কেন লাখ লাখ মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। তবে সরকার সব উপেক্ষা করে তাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে অটল থাকে।
ALADIN নামের এই এ আই টুলের ব্যাপারে পুরোটা জানতে আমাদের চলে যেতে হবে ১৯৮৮ সালের ও একটু আগে। ১৯৮৬, ল্যারি ফিঙ্ক চাকুরিচ্যুত করা হয় ফার্স্ট বোস্টন নামের একটা ইনভেস্ট ব্যাংক থেকে। এটা সেই প্রতিষ্ঠান যেখানে কিনা তিনি কাজ করেছেন ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৬ সাল অব্দি প্রায় ১০ বছর। আর এতগুলো বছরে নিজের দক্ষতা দিয়ে এই ব্যাংক কে এনে দিয়েছিল প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের প্রফিট। কিন্তু ১৯৮৬ সালে বেশ কিছু ভুল প্রেডিকশন আর যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তিনি ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। আর এতেই ব্যাংকটি প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি করে বসে।
আর এই কারণে ফার্স্ট বোস্টন থেকে ফিঙ্কিকে কিছুটা অপমান করেই বের দেওয়া হয়। যেই ব্যাংকের মাধ্যমে ল্যারি তার ক্যারিয়ার শুরু করেছিল, সেই ব্যাংক থেকেই এভাবে বের করে দেওয়াটা মেনে নিতে পারে নি , কিছুটা ইগোতে লাগে তার।
এরপর পরই ল্যারি সিদ্ধান্ত নেয় এমন একটা এলগরিদম (Algorithm) বানানোর যেটা দিয়ে যেকোন ধরনের ফাইন্যানসিয়াল রিস্ক এনালাইসিস খুব সহজতর আর নিখুঁত ভাবে করা যায়। আর তাই মাত্র ৫ মিলিয়ন ডলার নিয়ে ব্ল্যাকস্টোন নামের অন্য একটা প্রতিষ্ঠানের সাথে ৫০% শেয়ারে একটি ফাইনান্সিয়াল প্রতিষ্ঠান খুলে বসে। আর সাথে নেয় অল্প কজন কিন্তু চৌকশ একটি কোডারদের টিম। প্রাথমিকভাবে যাদের কাজ ছিল একটা কোডিং করে সফটওয়্যার বানানো যেটার মাধ্যমে বড় থেকে বড় সব প্রেডিকশন খুব নিখুঁত ভাবে করা যাবে। আর এভাবেই জন্ম হয় এটির।
মুলত Assets, Liablity, Debt, Derivative, Investment আর Network এই কয়েকটা শব্দের প্রথম অক্ষরগুলো নিয়ে সফটওয়ারটির নামকরন।
মাত্র ৫ মিলিয়ন ডলার নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও ১৯৯৪ সালে এসে ব্ল্যাকরক হয়ে দাঁড়ায় প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের একটা রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ফার্ম। তবে এই বছরে এসেই ব্ল্যাকস্টোন তাদের ৫০% শেয়ার ২৫০ মিলিয়ন ডলারে ল্যারির কাছে বিক্রি করে দেয়। আর এরপর ব্ল্যাকরক আর ALADIN এর পুরো ক্ষমতাই চলে আসে ল্যারি ফিঙ্ক এর কাছে।
জন্মের পর থেকেই ALADIN কে শেয়ার প্রাইজ, প্রাইজের উঠানামা, মানুষের সেলিং বিহেভ, স্টকের ইতিহাস এসব ব্যাপারে বিপুল পরিমান তথ্য ফিড করানো হতে থাকে। এতে করে মাত্র ১০ বছর অর্থাৎ ১৯৯৮ সালের মধ্যেই আলাদিনের তথ্য ভান্ডার এতটাই সমৃদ্ধ হয়ে যায় যে আলাদিনের তথ্যের এক্সেস ব্ল্যাকরক চড়া দামে বিক্রি করতে থাকে।
প্রিয় পাঠক এতো গেলো বিংশ শতাব্দীর কথা, এখন একবিংশ শতাব্দীতে এসে ব্ল্যাকরক ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছে চলুন সেটা দেখে আসি। বর্তমানে তারা যে পরিমান এসেট নিয়ে কাজ করে তার পরিমান হলো প্রায় ২১ ট্রিলিয়ন ডলার। এমাউন্টটি আসলে ঠিক কতটা বিশাল এটা বোঝার সুবিধার জন্য আপনাদের বলতে পারি যে বর্তমানে আমেরিকার টোটাল জিডিপি হলো প্রায় ২০ ট্রিলিয়ন ডলার। আর গোটা ইউরোপের জিডিপি মাত্র ১৫ ট্রিলিয়ন ডলার। অর্থ্যাৎ দশটা প্রথম সারির দেশের মোট জিডিপির থেকেও বেশি।
শুধু তাই নয় বর্তমানে আমাদের পৃথিবীতে বাস করে প্রায় ৭ বিলিয়ন মানুষ যাদের হাতে রয়েছে প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলার। তাহলে বুঝতেই পারছেন ব্ল্যাকরকের কাছে কি পরিমাণ অর্থ আছে।
এমনকি আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ ও ২০০টির মতো ইনভেস্ট এর ব্যাংক এর থেকেও বেশি পরিমান অর্থ আছে ব্ল্যাকরকের কাছে। এছাড়াও বিশ্বের শেয়ার মার্কেটের ১০% রয়েছে এই ব্ল্যাকরকের হাতে।
এছাড়াও বিশ্বের প্রায় টপ ৮০০টি কোম্পানির মেজর শেয়ার হোল্ডার এর তালিকায় রয়েছে এই ব্ল্যাক রক। আর এই পুরোটাই তারা করতে পেরেছে আলাদিন ব্যবহার করে।
এখন আলাদিনকে আমরা কেন ভয়াবহ বলছি সেটা আপনাদের খুলে বলি। ২০১৭ সালে, ব্ল্যাকরক মোনার্ক নামের একটা সিক্রেট প্রজেক্ট হাতে নেয়। এই প্রজেক্টের কাজ ছিল কোম্পানির থেকে বেশির ভাগ ফান্ড ম্যানেজারদের চাকুরি থেকে বের করে দেওয়া, এবং তাদের জন্য যেই ফান্ডটা রাখা হয় তা পুরোটাই আলাদিনের উন্নতির খরচ করা।
বর্তমানে প্রতিদিন বিলিয়ন এর ও বেশি প্রেডিকশন করে থাকে এই আলাদিন। আর সেটা করতে ২০০০ এর বেশি প্যারামিটার ব্যবহার করে। যা করা কোন মানুষের পক্ষে কল্পনাতেও সম্ভব নয়। আর এটা আলাদিন করে থাকে প্রায় ৬০০০ এর মতো শক্তিশালী সব সুপারকম্পিউটার ব্যবহার করে।
জলবায়ুর সূক্ষ্ম পরিবর্তন থেকে শুরু করে, কোন রাজনৈতিক নেতা কোন ধাচের বক্তব্য দিচ্ছে এসব কিছুই এনালাইসিস করে প্রেডিকশন দেয় এই আলাদিনে। ফলে ব্ল্যাকরকের প্রায় ৭০% এসেট কে নিয়ন্ত্রণ করে এই আলাদিন।
জিনিসটি কতটা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে সেটি আরেকটি ছোট উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটা করনা মহামারীর রেশ কাটিয়ে উঠতে আমেরিকান সরকার প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের একটা বিশাল বাজেট প্রকল্প হাতে নেয়। কিন্তু এই বিশাল পরিমাণ টাকার কতটুকু ঠিক কোন খাতে ব্যবহার করা হবে এর পুরোটাই ঠিক করা হয় এই আলাদিন নামের এ আই সফটওয়্যার ব্যবহার করে। অর্থাৎ একটি মেশিন ভাগ্য নির্ধারন করেছে মার্কিন জনগনের।
আর সবথেকে ভয়াবহ ব্যাপারটা হচ্ছে ব্ল্যাকরক এখনো মিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আলাদিনের ইম্প্রুভমেন্টে ব্যবহার করে যাচ্ছে। কেননা ল্যারি এর ভাষ্যমতে এটি কেবল তার ক্ষমতার ৫% অব্দি পৌছেছে।
সামনের দিনগুলোতে হয়তো আলাদিনকে শুধু রিস্ক ফ্যাক্টর প্রেডিকশনেই ব্যবহার করা হবে এমনটাই নয়। হতে পারে শেয়ার মার্কেটের কোন শেয়ার দাম বাড়ানো হবে কোনটার কতটুকু কমানো হবে, কোন কোম্পানির প্রোডাক্ট কিনতে মানুষকে ম্যানুপুলেট করা হবে আর কোনটার হবে না এই সবই হয়তো নির্ধারন করা হবে এই আলাদিন এর মাধ্যমে।
এছাড়াও আমাদের প্রত্যেকের ব্যাংক ডিটেলস থেকে শুরু করে আমাদের বায়িং হ্যাবিট, আমাদের ফ্যাইন্যানসিয়াল এবিলিটি এমনই সব স্পর্শকাতর ডাটা ইতিমধ্যে হয়তো চলেও গেছে আলাদিনের কাছে।
বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারসহ আলাদিনের প্রায় সাড়ে ৩ মিলিয়ন ইউজার রয়েছে। এদের মধ্যে কেউ যে শুধুমাত্র নিজের স্বার্থ হাসিলে এটি ব্যবহার করবে না তার কোন গ্যারান্টি নেই।
আজ থেকে মাত্র দু তিন বছর আগে ইলন মাক্স যখন এ আই এর ক্ষমতা নিয়ে ব্রিফ করেছিলো, তখন বলেছিল যে এ আই আসলে মানুষের জন্য কতটা ভয়ংকর তখন আমাদের অনেকেই কথাটা সেভাবে গুরুত্ব না দিলেও এখন চ্যাট জিপিটি আর গুগলের সোরা এর মতো টুলগুলোর কারণে আমরা কিছুটা হলেও বুঝতে পারছি।
কিন্তু আলাদিন যেন তার থেকেও ভয়ংকর। হয়তো অদূূর ভবিষ্যতে এসব টুল দিয়ে পৃথিবীর মানুষ কে নিয়ন্ত্রন করতে ব্যবহার হবে কিনা সে উত্তর ও আমরা পেয়ে যাব খুব শীঘ্রই।
প্রিয় পাঠক আজ এই পর্যন্তই , আগামী ব্লগে আমরা আসবো এমনই কোন বিষয় নিয়ে। সেই অব্দি ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন আর সচেতন থাকুন। আর এ ধরণের ব্লগ পছন্দ করলে, আমাদের নিউজলেটারটি Subscribe করতে ভুলবেন না।