চায়না কিভাবে আপনাকে এত স্বল্প মূল্যে পণ্য দেয়? How Could China Provide Cheap Products?
চীনের প্রোডাক্ট মানেই সস্তা এমনটাই সব সময় আমাদের মাথায় আসে। এইতো কিছুদিন আগেও আমাদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু চীনের ছোট সাইজের স্মার্টফোনগুলো হয় ব্যবহার করেছি নাহয় আশেপাশের মানুষদের ব্যবহার করতে দেখেছি। ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা দামের এই টাচ স্ক্রিনের ফোনগুলো কিন্তু সে সময় মোবাইলের বিশাল একটা বাজার দখল করেছিল। কিন্তু সেই চীন ই আবার উন্নত বিশ্বে সেই একই পণ্য আরো বেশি মূল্যে এবং ভালো মানের সরবরাহ করে থাকে! চীন যেমন আমাদের দেশে রাস্তায় ফেরি করে বিক্রি করা ছোট্ট একটা খেলনা পুতুল বানিয়ে থাকে আবার সেই চীন আমেরিকাসহ (America) ইউরোপের (Europe) বিভিন্ন দেশে উচ্চ প্রযুক্তির সব পণ্য সরবরাহ করে থাকে।
কিন্তু চীন একদম ছোট পণ্য থেকে শুরু করে উন্নত প্রযুক্তির নানা পণ্য তৈরি করে কীভাবে? কি এমন ক্ষমতা চীনের আছে যা অন্য কোন দেশের কাছে নেই। কেনই বা আমেরিকার রাশিয়া কিংবা যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো এভাবে ম্যাস প্রোডাকশন দিতে পারে না, যা চীন খুব সহজে করে যাচ্ছে। কি এমন জাদুর কাঠির পরশ পেলো তারা যার কারনে এক সময় যারা পুরো বিশ্বের কেবল মাত্র ২% জিডিপি (GDP) শেয়ার করতো তারা এখন ১৮% জিডিপি শেয়ার করে থাকে। সেই সাথে বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হলো চীন। যার জিডিপি বর্তমানে প্রায় সাড়ে ১৮ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলার।
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের যেতে হবে আজ থেকে কয়েক দশক আগে ১৯৫৮ সালের দিকে। আমরা আজকের চীনের থেকে তখনকার চীন ছিল একদম আলাদা। সে সময় চীনের শাসনকর্তা ছিলেন মাও সে–তুং (Mao Zedong)। তিনি ১৯৫৮ সালে গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড (Great Leap Forward) ক্যাম্পেইন চালু করেন। এই ক্যাম্পেইনের অধীনে চীনা সরকার দেশের সকল কৃষকদের জমি নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় এবং বলা হয় কৃষকদের নিজেদের কোনো জমি থাকতে পারবে না, তারা নিজেরা কোন ফসল বাজারে বিক্রি করতে পারবে না । তারা সরকারের দেওয়া জমিতেই ফসল চাষ করবে। আর এর পুরোটাই সরকারকে দিয়ে দিবে। বিনিময়ে সরকার তাদের বেতন দেবে।
কিন্তু এই পুরো প্রকল্পটি চীনা সরকারের জন্য হীতে বিপরীত হয়। সরকার সেভাবে কৃষি খাতে অর্থলগ্নি করে না, ফলে অচীরেই গোটা চীন জুড়ে চরম দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এখানেই শেষ নয়, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে অদ্ভুত এক বিপ্লবের সূচনায় সমস্ত স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল যেন শিক্ষক এবং ছাত্ররা তাদের সমস্ত শক্তি বিপ্লবের উপর দিতে পারে ।
এর কয়েক বছরের মধ্যেই চীনে সে সময় এই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। সাধারন জনগন রাস্তায় নেমে পরে। চীন সরকার এই আন্দোলন শক্তভাবে দমন করার চেষ্টা করতে থাকে। যেই সরকার এর বিরুদ্ধে কথা বলে তাকেই জেলে ঢুকানো শুরু করে। এমনকি নিজেদের দলের লোকদের ও রেহায় দিতো না।
পুরো এই সময়টাতে চীনের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মানুষ খাদ্যের অভাবে আর সরকারের নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করে। চীনের এই দুর্ভাগ্যের শেষ ঘটে ১৯৭৬ সালের দিকে এসে। এই বছর মাও সে–তুং মারা গেলে ক্ষমতায় আসে দেং শিয়াওপিং (Deng Xiaoping)। আর তখন থেকেই চীনের ভাগ্য বদলাতে শুরু করে।
দেং যে সময় ক্ষমতায় আসেন সে সময় চীনের জিডিপি ছিল মাত্র ২০ হাজার ৫৩ কোটি ডলার সাথে ৯০% মানুষ বাস করতো দারিদ্র সীমার নিচে। দেং শিয়াওপিং (Deng Xiaoping ) এসেই এত কাল ধরে আসা সব প্রথা বাতিল করে দেয়। কৃষকদের জমি তাদের কাছে ফিরিয়ে দেন এবং এটাও বলেন কৃষকরা চাইলেই তাদের ফসল বাজারে বিক্রি করতে পারবে এর জন্য শুধু অল্প পরিমানে ট্যাক্স (Tax) তাদের সরকারকে দেওয়া লাগবে। ফলে অল্প বছরের মাথাতেই দুর্ভিক্ষে ভুক্তে থাকা চীন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠে।
এরপর চীনের সরকার নজর দেয় শিক্ষা খাতে। তারা চিন্তা করতে থাকে তাদের বিপুল জনগোষ্ঠীকে কিভাবে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করা যায়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে তারা প্রায় ১২ বছর তাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ রেখেছিল। চীন সরকারের বক্তব্য ছিল– এত ছেলেমেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে কি করবে? কোথায় চাকরি পাবে? কেই বা চাকরি দেবে? এত হাজার হাজার বেকারকে চাকরি দেয়ার মত প্রতিষ্ঠান চীনে নেই। এই সময়টায় চীন ছাত্রছাত্রীদের আধুনিক প্রশিক্ষণ দিয়েছিল নানা ধরণের ট্রেড কোর্সে। স্বল্প মেয়াদী ট্রেড কোর্স শিখে চীনের ছেলেমেয়েরা স্বাবলম্বী হয়ে গেলো। প্রতিটি বাড়ি গড়ে উঠল একটা করে ছোট ছোট কারখানায়।
পরিবারের সবাই সেখানে কাজ করে। বড় ফ্যাক্টরি করার আলাদা খরচ নেই। ফলে পণ্যের উৎপাদন খরচ কমে গেলো। বর্তমানে যে কোন পণ্য স্বস্তায় উৎপাদন করার সক্ষমতায় তাদের ধারে কাছে কেউ নেই।
পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলে চাইনিজ পণ্যের প্রসার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে তারা বিশ্ব বাণিজ্যের এক অপ্রতিরোধ্য পরাশক্তি। উপযুক্ত মূল্য দিলে তারা এমন জিনিস বানিয়ে দেবে যার গ্যারান্টি আপনি চাইলে ১০০ বছরও দিতে পারবেন।
এই সময়টায় চীনের সরকার এটি বুঝতে পারে যে তাদের রয়েছে প্রায় ৯৫ কোটির জনশক্তি। আর তারা যদি উন্নতি করতে চায় তাদের এই জনসংখ্যাকে কাজে লাগিয়েই সেটা করতে হবে। কেননা রাশিয়া কিংবা আমেরিকার মতো চীনের তেমন কোন প্রাকৃতিক সম্পদ নেই।
সে সেময় চীনের আশে পাশের কয়েকটা দেশ তাইওয়ান (Taiwan), জাপান (Japan) ও সাউথ কোরিয়ার (South Korea) বেশ কিছু কোম্পানি বেশ গ্রো (grow) করতে থাকে। যেমন জাপানের সনি (Sony), সাউথ কোরিয়ার এলজি (LG), স্যামসাং (Samsung), তাইওয়ানের ফক্সকন (Foxconn) ইত্যাদি।
এই সব কোম্পানিগুলো যেই সমস্যা মোকাবেলা করে তা হলো একে তো ব্যবসা বাড়ানোর জন্য যে নতুন নতুন কারখান তৈরি করবে তার জন্য না ছিল পর্যাপ্ত পরিমানে জমি আর ছিল বিশাল পরিমানের শ্রমিকের ঘাটতি । আর এই দুই সুবিধাই ছিল চীনের কাছে। চীন তাই দেশের বিভিন্ন জায়গায় ইকোনমিক জোন তৈরি করা শুরু করে। এবং এসব দেশের সাথে নতুন চুক্তিতে যায়। চীন তাদের কম দামে জমি আর লেবার সরবরাহ করে, পাশাপাশি ট্যাক্স ও কম রাখে। বিনিময়ে এসব প্রতিষ্ঠান চাইলেই তাদের কারখানা চীনে স্থাপন করতে পারবে।
ফলে ১৯৮৮ সালের দিকে তাইওয়ানের ফক্সকন (Foxconn) কোম্পানি চীনের সেনজেন শহরে তাদের প্রথম কারখানা চালু করে। এবং সেই কারখানা পরিচালনাও চীনের লোকবল দিয়ে করতে শুরু করে।
একে তো চীনে লেবারের কস্ট অনেক কম। যেখানে আমেরিকা , ইউরোপের দেশগুলোতে প্রতি ঘন্টায় একজন লেবারকে দিতে হয় প্রায় ২৩-২৭ ডলার, সেদিকে চিনে শ্রমিক পাওয়া যেত ঘন্টায় মাত্র সাড়ে ৫-৮ ডলার। এর সাথে সাথে সরকারের দেওয়া নানান সুবিধার ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই গুগল (Google), মাইক্রোসফট (Microsoft), এইচপি (HP), আইবিএমের (IBM) মতো প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কারখানা চীনের সেনজেনে খুলতে শুরু করে।
আর বর্তমানে এসে চীনের এই সেনজেনে প্রদেশে রয়েছে প্রায় ৬০ হাজারের বেশি কারখানা, শুধু তাই না চীনের মোট জিডিপির ৩০% আসে এই শহর থেকেই।
লেবার কস্ট কম হওয়ায় এই কোম্পানিগুলো আরো কম দামে বাইরের দেশে নিজেদের পণ্য বিক্রি করতে শুরু করে। সেই সাথে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠে হাজার হাজার লোকাল কোম্পানি। যেগুলো নিজেদের মতো কম কোয়ালিটির প্রোডাক্ট আরো সস্তায় বানিয়ে বাংলাদেশ (Bangladesh), ভারত (India), শ্রীলঙ্কা( Sri Lanka) সহ তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলোতে সাপ্লাই করতে থাকে।এছাড়া কাঁচামালের সহজলভ্যতা, দ্রুত পলিসি তৈরি করা এবং তা কার্যকর করার ক্ষমতা চীনকে অন্য যে কোন দেশ থেকে এগিয়ে রেখেছে।
এখানেই চীনা সরকার থেমে না থেকে বিভিন্ন বড় বড় প্রতিষ্ঠানের ইলেক্ট্রনিক প্রোডাক্টগুলো রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং করে। এরপর সেখান থেকে কপি পেস্ট করে নিজেদের মতো করে প্রোডাক্ট তৈরি করতে শুরু করে। আর এভাবেই জন্ম নেয় শাওমি (Xiaomi) থেকে শুরু করে অ্যামাজনের (Amazon) কপি করা আলিবাবার (Alibaba) মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানেগুলো।
জনশক্তি তো বাংলাদেশেরও রয়েছে এবং সেটা চীনাদের থেকে অনেক সস্তায়ও পাওয়া যায় কিন্তু তারা কি চীনাদের মতো দক্ষ? উত্তরটা স্বাভাবিকভাবেই, না। কারণ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা দক্ষ জনশক্তি তৈরির উপর ততটা ফোকাস করে না।
বাংলাদেশেও কিন্তু অনেক পরিমান জনশক্তি রয়েছে কিন্তু তারা আট ঘণ্টায় যে কাজ যে পরিমাণ কাজ করতে পারে সেটা চীনের দক্ষ জনশক্তির করতে অর্ধেকেরও কম সময় লাগে! সম্ভবত এটাই একমাত্র কারণ যে পৃথিবীর সকল বড় বড় কোম্পানি তাদের পণ্য চীনে উৎপাদন করতে চায়। আমরা স্বপ্ন দেখি একদিন বাংলাদেশও বৈশ্বিক অর্থনীতির রোল মডেলে পরিণত হবে, চীনের সফলতার গল্পকে পুঁজি করে সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের শিখরে।
আজ এ পর্যন্তই। আপনি যদি বিজনেস ম্যানিয়াতে প্রথম এসে থাকেন তাহলে নিউজলেটারটি সাবস্ক্রাইব করার অনুরোধ রইল। সবাইকে শুভকামনা।