প্লাস্টিক থেকে টেক্সটাইল, বেঙ্গল গ্রুপের সাম্রাজ্যের উত্থান! | Bengal Group | Business Mania
বাংলাদেশের অন্যতম বহুমুখী ব্যবসায়িক গ্রুপগুলোর মধ্যে একটির নাম Bengal Group। প্লাস্টিক পণ্য থেকে শুরু করে প্যাকেজিং, টেক্সটাইল, এমনকি ইলেকট্রনিক্স, প্রায় সবখানেই তাদের উপস্থিতি দেখা যায়। ছোট পরিসরে শুরু হলেও, আজ তারা দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান।
মাত্র কয়েকটা পণ্য থেকে শুরু করে আজ তাদের ব্যবসা বিস্তৃত হয়েছে প্লাস্টিক, কনজ্যুমার গুডস, টেক্সটাইল, প্যাকেজিং, ইলেকট্রনিক্সসহ বহু সেক্টরে। কীভাবে তারা এই সাফল্য পেল? কী তাদের মূল বিজনেস স্ট্র্যাটেজি? আর এত বড় কোম্পানি হওয়ার পরও তাদের নিয়ে কি কোনো বিতর্ক আছে?
আজকের আমরা আলোচনা করব Bengal Group-এর শুরু থেকে বর্তমান অবস্থা, তাদের বিজনেস মডেল, বাংলাদেশি মার্কেটে তাদের প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। তাই চলুন শুরু করা যাক।
১৯৬৯ সালে, মরশেদ আলম পুরান ঢাকার একটি ভাড়া করা কারখানায় বেঙ্গল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে, প্রতিষ্ঠানটি প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনে মনোযোগ দেয়, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্লাস্টিক শিল্পে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
সময়ের সাথে সাথে, বেঙ্গল গ্রুপ তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করে বিভিন্ন খাতে প্রবেশ করে, যেমন প্লাস্টিক (Plastic), রাবার (Rubber), মেলামাইন (Melamine), টেক্সটাইল (Textile), প্যাকেজিং (Packaging), ইলেকট্রনিক্স (Electronics), এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ। এই বৈচিত্র্যময় পণ্য ও সেবা প্রদানের মাধ্যমে, প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় কনগ্লোমারেট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৪ সালে, মরশেদ আলমের ছোট ভাই মো. জসিম উদ্দিন বাংলাদেশ প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। একই বছরে, বেঙ্গল গ্রুপ রহমানিয়া বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ইন্ডাস্ট্রিজ অধিগ্রহণ করে, যা তাদের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ খাতে প্রবেশের সূচনা করে।
তবে ২০০৭ সালে আসে এক ধাক্কা। মার্চ মাসে, কারওয়ান বাজারের বিএসইসি ভবনের প্রথম তলায় অবস্থিত বেঙ্গল গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ে একটি অগ্নিকাণ্ড ঘটে, যেখানে চারজন নিহত এবং ৩৬ জন আহত হন। এই দুর্ঘটনা প্রতিষ্ঠানটির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, তবে তারা দ্রুত পুনরুদ্ধার করে এবং তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখে।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে, বেঙ্গল প্লাস্টিক ৫০ কোটি টাকার সম্প্রসারণ পরিকল্পনা ঘোষণা করে, যা তাদের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ছিল।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে, বেঙ্গল গ্রুপ ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি) এবং ডাচ সরকারী সংস্থা এফএমও থেকে ঋণ গ্রহণ করে ঢাকায় একটি বিলাসবহুল হোটেল, সুইসোটেল ঢাকা, নির্মাণের জন্য। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের সাথে চুক্তি করে বিভিন্ন ভবনের ছাদে সোলার প্যানেল স্থাপন করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য।
একই বছরে, তারা একটি ব্যাংক খোলার অনুমতি চায় এবং
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে, বাংলাদেশ ব্যাংক বেঙ্গল ব্যাংক লিমিটেডের অনুমোদন দেয়, যার পরিশোধিত মূলধন ছিল ৫০০ কোটি টাকা। এর মাধ্যমে, বেঙ্গল গ্রুপ আর্থিক খাতে তাদের উপস্থিতি আরও সুদৃঢ় করে।
২০২২ সালে, বেঙ্গল সিমেন্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য সিমেন্ট সরবরাহের চুক্তি করে, যা তাদের নির্মাণ খাতে অবদানকে আরও বৃদ্ধি করে। একই বছরে, বেঙ্গল প্লাস্টিক পরপর ১৩ বার রপ্তানি ট্রফিতে স্বর্ণপদক অর্জন করে, যা তাদের পণ্যের উচ্চ মানের প্রমাণ।
বর্তমানে বেঙ্গল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ও প্রভাবশালী শিল্পগোষ্ঠী। বিভিন্ন খাতে তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত। বেঙ্গল প্লাস্টিকস এখন দেশের সর্ববৃহৎ প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রতি মাসে ৩,০০০ মেট্রিক টনের বেশি কাঁচামাল প্রক্রিয়াজাত করা হয়। শুধু দেশেই নয়, বিদেশের বাজারেও বেঙ্গল গ্রুপের তৈরি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে, যা বাংলাদেশের শিল্পখাতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।
সম্প্রতি বেঙ্গল গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান এবং এফবিসিসিআই-এর সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন নিউ ইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলির পক্ষ থেকে সম্মাননা অর্জন করেছেন, যা প্রমাণ করে যে প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও স্বীকৃতি পাচ্ছে। তবে ২০২৪ সালের শেষের দিকে বেঙ্গল গ্রুপের সাতটি কারখানায় হামলার ঘটনা ঘটে, যা তাদের রপ্তানি কার্যক্রমের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবে প্রতিষ্ঠানটি দ্রুত এই ধাক্কা সামলে ওঠার চেষ্টা চালাচ্ছে এবং তাদের কার্যক্রম পুনরুদ্ধারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে।
বেঙ্গল গ্রুপের পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন বেশ কয়েকজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হলেন মোর্শেদ আলম, যিনি এই গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন মো. জসিম উদ্দিন, যিনি একই সঙ্গে বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসি-এর চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া বেঙ্গল গ্রুপের অন্যতম পরিচালক হলেন ফিরোজ আলম, যিনি বেঙ্গল সিমেন্ট লিমিটেড ও বেঙ্গল এলপিজি লিমিটেডসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। শামসুল আলম বেঙ্গল অ্যাডহেসিভ অ্যান্ড কেমিক্যাল প্রোডাক্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।এছাড়াও বেঙ্গল গ্রুপের পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন আরও
এই পরিচালনা পর্ষদের নেতৃত্বে বেঙ্গল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।
বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে বেঙ্গল গ্রুপ ব্যবসায়িক সফলতা অর্জন করবে বলে ধারণা করা যায়।
বেঙ্গল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী হলেও কিছু চ্যালেঞ্জ ও বিতর্ক তাদের অগ্রযাত্রায়ও বাধা হয়ে দাঁড়ায় । এর মধ্যে অন্যতম হল শ্রমিক অসন্তোষ এবং কারখানায় হামলা। ২০২৪ সালের শেষের দিকে বেঙ্গল গ্রুপের অন্তত সাতটি কারখানায় হামলার ঘটনা ঘটে, যা তাদের উৎপাদন এবং রপ্তানি কার্যক্রমে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। এসব হামলার পেছনে মূলত শ্রমিকদের অসন্তোষ এবং স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে অভিযোগ উঠে। প্রতিষ্ঠানটি দ্রুত তাদের কার্যক্রম স্বাভাবিক করতে চাইলেও এই ঘটনাগুলো ব্যবসায়িক পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
একটি বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী হিসেবে বেঙ্গল গ্রুপকে প্রতিনিয়ত নানান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয় না, এটাই স্বাভাবিক। ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা, নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সম্পর্ক, এবং বৈশ্বিক বাজারের ওঠানামা তাদের অগ্রগতিতে প্রভাব ফেলবে। তবে, প্রতিষ্ঠানটি এখনও টিকে আছে এবং নতুন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে নিজেদের পরিধি আরও বিস্তৃত করার চেষ্টা করছে। ভবিষ্যতে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা, টেকসই ব্যবসা কৌশল গ্রহণ এবং নৈতিক ব্যবসায়িক পরিবেশ বজায় রাখতে পারলেই বেঙ্গল গ্রুপ তাদের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবে।
এই প্রতিষ্ঠানটি তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনাগুলোতে যেসব দিক নিয়ে কাজ করছে, তা সবার কাছে পরিস্কার হওয়া জরুরি।
প্রথমত, বেঙ্গল গ্রুপ বর্তমানে সিমেন্ট (Cement) এবং নির্মাণ খাতে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করছে। সিমেন্টের মতো প্রতিযোগিতামূলক বাজারে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করতে তাদের প্রচেষ্টা স্পষ্ট। তারা ভবিষ্যতে আরও নতুন ধরনের সিমেন্ট এবং নির্মাণ উপকরণ বাজারে আনতে চায়। এর ফলে শুধু স্থানীয় বাজারেই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও তাদের অবস্থান শক্তিশালী হতে পারে।
এছাড়াও, বেঙ্গল গ্রুপ যে পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ গ্রহণের দিকে মনোযোগী, তা ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের প্রতি আগ্রহী, বিশেষ করে সোলার প্যানেল এবং বায়ু শক্তি ব্যবহার করার পরিকল্পনা রয়েছে।
বেঙ্গল গ্রুপের আরেকটি বড় লক্ষ্য হলো প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ এবং উদ্ভাবন। তারা তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং পণ্যের মান বাড়ানোর জন্য নতুন প্রযুক্তি এবং গবেষণা ও উন্নয়নে (R&D) বেশি ফোকাস দিচ্ছে।
সব মিলিয়ে, বেঙ্গল গ্রুপ যদি এই পরিকল্পনাগুলোর দিকে মনোযোগ দিয়ে এগিয়ে যায়, তবে তারা শুধুমাত্র দেশের নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হবে।
তো, বেঙ্গল গ্রুপ একদিকে যেমন নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে দেশের বৃহত্তম শিল্পগোষ্ঠী হিসেবে, তেমনি তারা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ এবং নানান সমস্যার সম্মুখীনও হয়েছে। তবে, তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অনেকটা আশাব্যঞ্জক এবং তারা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছে নতুন উদ্যোক্তা মনোভাব নিয়ে সাফল্যের দিকে এগিয়ে যেতে।
এখন আপনার কী মনে হয়? বেঙ্গল গ্রুপ তাদের এই উন্নয়ন পরিকল্পনা সফল করতে পারবে? আপনি কী মনে করেন তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে? কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না।