ঋণ অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার ছোঁয়ায়! BASIC Bank | Business Mania
BASIC Bank, একসময় ছিল ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান এখন কীসের জন্য বেশি পরিচিত? উন্নয়ন নাকি দুর্নীতি?
১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, ব্যাসিক ব্যাংক দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে উঠেছে বড় বড় অভিযোগ তথা অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, এমনকি হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারি!
প্রশ্ন হলো, কীভাবে একটি ব্যাংক এত বড় বিপর্যয়ে পড়ল? কারাই বা এর পেছনে ছিল? আর সবচেয়ে বড় কথা, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে BASIC Bank আদৌ কি সেই পুরনো আস্থার প্রতীক হতে পারবে?
তাই আজকের আলোচনায় আমরা জানবো BASIC Bank-এর জন্ম থেকে বর্তমান অবস্থা পর্যন্ত পুরো গল্পটা। থাকছে ব্যাংকটির উত্থান, পতন, এবং আলোচিত কেলেঙ্কারিগুলোর বিশ্লেষণ।
তাহলে চলুন, শুরু করা যাক!
BASIC ব্যাংক, যা বাংলাদেশ স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক লিমিটেড নামে পরিচিত, ২রা আগস্ট ১৯৮৮ সালে কোম্পানিজ অ্যাক্ট ১৯১৩ এর অধীনে নিবন্ধিত হয় এবং ২১ জানুয়ারি ১৯৮৯ সালে কার্যক্রম শুরু করে। প্রাথমিকভাবে, ব্যাংকটি বিএসসি ফাউন্ডেশন এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে বিএসসি ফাউন্ডেশন ৭০% এবং বাংলাদেশ সরকার ৩০% শেয়ার ধারণ করত। তবে, বিএসসি ফাউন্ডেশন নিষ্ক্রিয় হওয়ার পর ৪ জুন ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ সরকার ব্যাংকটির ১০০% মালিকানা গ্রহণ করে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে, ব্যাংকটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ক্ষুদ্র শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা ও বৃদ্ধিতে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। ব্যাংকটি টার্ম লোন, বাণিজ্যিক ব্যাংকিং সেবা, এসএসআইগুলিকে প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং এনজিওগুলির সাথে সংযোগের মাধ্যমে নগর দরিদ্রদের মাইক্রো ক্রেডিট প্রদান করে।
ব্যাংকটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য উন্নয়ন মূখী হলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আসে নানা প্রতিকূলতা । ব্যাংকটি ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ব্যাপক আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে দেশের ব্যাংকিং খাতে একটি বড় ধাক্কা খায়। এই সময়ে, ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন শেখ আবদুল হাই বাচ্চু, যিনি তার নেতৃত্বে ব্যাংকটির আর্থিক ব্যবস্থাপনায় গুরুতর অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হন।
২০০৯ সালে শেখ আবদুল হাই বাচ্চু বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান। তার নেতৃত্বে, ব্যাংকটি বিভিন্ন ভুয়া কোম্পানি ও ব্যক্তির কাছে ঋণ প্রদান শুরু করে, যা ব্যাংকিং নিয়মাবলীর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে দেখা যায়, ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে প্রায় ৪,৫০০ কোটি টাকা ঋণ অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়। এই ঋণগুলো মূলত ভুয়া কোম্পানি, অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান এবং সন্দেহজনক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রদান করা হয়েছিল।
উদাহরণস্বরূপ, দিলকুশা শাখায় ১৬ জন ঋণগ্রহীতা ৬৮৩ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেন, যাদের বেশিরভাগই ভুয়া প্রতিষ্ঠান ছিল। একজন ঋণগ্রহীতা, আসিফ ইকবাল, রিলায়েন্স শিপিং লাইনসের মালিক, ডিসেম্বর ২০১১ সালে একটি চলতি হিসাব খোলেন এবং মাত্র তিন মাসের মধ্যে ৭.৯ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন পান। তদন্তে দেখা যায়, তার বাসস্থান, অফিস বা কারখানার কোন অস্তিত্বই নেই।
ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ, বিশেষ করে চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু, এই অনিয়মের সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন। তদন্তে দেখা যায়, অনেক ঋণ প্রস্তাবের ক্ষেত্রে শাখা থেকে নেতিবাচক মন্তব্য থাকা সত্ত্বেও, পর্ষদ সেগুলো অনুমোদন করেছে। কিছু ক্ষেত্রে, শাখা থেকে প্রস্তাব পাঠানোর আগেই পর্ষদ ঋণ অনুমোদন করেছে, যা ব্যাংকিং নিয়মের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ছিল।
এই বিশাল আর্থিক কেলেঙ্কারির ফলে বেসিক ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০১৬ সালে ব্যাংকটি ১,৪৯৩ কোটি টাকা লোকসান করে, যা তার ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এরপর থেকে ব্যাংকটি ক্রমাগত লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে, যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লোকসানের পরিমাণ কিছুটা কমেছে। তবে ২০২২ সালেও ব্যাংকটি ১৩০ কোটি টাকা লোকসান করেছে।
ঋণ কেলেঙ্কারির ফলে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। মার্চ ২০২৩ পর্যন্ত, ব্যাংকটির মোট ঋণের ৫৮% খেলাপি ছিল, যা দেশের ব্যাংকিং খাতে সর্বোচ্চ। এই খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকটির তারল্য সংকট দেখা দেয় এবং আমানতকারীদের আস্থা হ্রাস পায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা এই কেলেঙ্কারির তদন্ত শুরু করে। ২০১৫ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ৫৬টি মামলা দায়ের করে, যেখানে ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। তবে, তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া ধীরগতিতে চলার কারণে অনেকেই জামিনে মুক্তি পেয়েছেন, এবং কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগপত্র দাখিলেও বিলম্ব হয়েছে।
দুদকের তদন্তে দেখা যায়, ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান (Chairman) শেখ আবদুল হাই বাচ্চু ও তার সহযোগীরা ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ করে ব্যক্তিগত সম্পদ অর্জন করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে মোট ৫৯টি মামলায় ১৪৮ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে বাচ্চু ৫৮টি মামলায় অভিযুক্ত।
বেসিক ব্যাংক এখনও আর্থিক সংকট থেকে পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। তবে, ব্যাংকটি খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে কিছু সাফল্য অর্জন করেছে। ২০২২ সালে ব্যাংকটি ৫৫৬ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়, যা ২০২১ সালের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। তবে, ব্যাংকটির মোট ঋণের ৬৪% এখনও খেলাপি, যা ব্যাংকটির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
নতুন পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা উন্নত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। তারা নতুন আমানত সংগ্রহ, ঋণ বিতরণ এবং খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে মনোযোগ দিচ্ছে। তবে, ব্যাংকটির আর্থিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে আরও সময় ও প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
সম্প্রতি, ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। নভেম্বর ২০২৪ সালে, হেলাল আহমেদ চৌধুরী ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি একজন অভিজ্ঞ ব্যাংকার এবং ব্যাংক এশিয়া লিমিটেডের স্বাধীন পরিচালক ছিলেন।
ব্যাংক পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন আরও কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।
পরিচালক হিসেবে রয়েছেন ড. নাহিদ হোসেন, যিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া ড. মো. আব্দুল খালেক খান, যিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেডের প্রাক্তন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও (CEO), তিনিও পরিচালনা পর্ষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
এছাড়া মো. রফিকুল ইসলাম, যিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব, তিনিও পরিচালনা পর্ষদের অন্যতম সদস্য।
ব্যাংকের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. আনিসুর রহমান, যিনি ব্যাংকটির আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
BASIC ব্যাংক লিমিটেড, অতীতে আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হলেও, বর্তমানে পুনরুদ্ধারের পথে রয়েছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন এবং আর্থিক খাতে গৃহীত সংস্কারমূলক পদক্ষেপগুলি ব্যাংকটির পুনর্জাগরণের জন্য নতুন সম্ভাবনা সুস্পষ্ট।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান পর্যালোচনার জন্য আন্তর্জাতিক অডিট প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করেছে, যা আর্থিক খাতের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।
বর্তমানে ব্যাংকটি যদি সুশাসন, স্বচ্ছতা, এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার উপর গুরুত্বারোপ করে, তবে এটি তার আর্থিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আর্থিক সংস্কার ও স্থিতিশীলতার প্রচেষ্টার প্রেক্ষিতে, BASIC ব্যাংক সঠিক পদক্ষেপ ও সুশাসনের মাধ্যমে তার পূর্বের সুনাম পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবে এবং দেশের আর্থিক খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।
একটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেসিক ব্যাংক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা এবং সরকারি প্রকল্পে অর্থায়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে ঋণ অনিয়ম ও আর্থিক অব্যবস্থাপনার কারণে এর স্বচ্ছতা ও পরিচালনা নিয়ে প্রশ্ন উঠে।
ব্যাংকটিকে ব্যাংকিং খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে চাইলে বেসিক ব্যাংকসহ পুরো ব্যাংকিং খাত শক্তিশালী ও সুশাসিত হওয়া অপরিহার্য।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার যদি শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করে এবং ব্যাংকটি যদি যথাযথ নীতি অনুসরণ করে, তাহলে এটি ভবিষ্যতে একটি কার্যকর ও লাভজনক ব্যাংক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
বেসিক ব্যাংকের এই কেলেঙ্কারি আমাদের আর্থিক খাতের দুর্বল দিকগুলো তুলে ধরে। তাই প্রশ্ন থেকে যায়, ব্যাংকিং খাতে প্রকৃত সংস্কার কি আদৌ সম্ভব? নাকি কেবল নতুন মুখ আসবে, কিন্তু পুরনো দুর্নীতি চলতে থাকবে?
আপনার মতামত জানাবেন কমেন্টে! আপনার কী মনে হয়, বেসিক ব্যাংক কি আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে?