এশিয়ান হাইওয়েঃ এক সড়কেই বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে ! Asian Highway Bangladesh | Business Mania
চাকরির সুবাদে আপনি ঢাকা থাকেন, কিন্তু আপনার পরিবার, আপনার আত্মীয়-স্বজন সবাই থাকে ঢাকার বাইরে বরিশাল, খুলনা অথবা আরো দূরে। একটা সময় ছিল আপনি একটা দিন ছুটি পেলে আপনার পরিবারের কাছে যাওয়াটা ছিল অসম্ভব, কারণ সেই সকল জায়গায় যেতে হলে আপনার দশ থেকে বারো ঘন্টা বা তার বেশি সময় লেগে যেত।
কিন্তু সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে পদ্মা সেতু (Padma Bridge)। দেশের অভ্যন্তরে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে গতিশীল করা এবং দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধি করার লক্ষ্যে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল (Metro Rail), এলিভেটর এক্সপ্রেসওয়ে (Elevated Expressway) দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। গড়ে তোলা হচ্ছে সারাদেশে শক্ত নেটওয়ার্ক (Network)। দেশের ভেতরে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা অভূতপূর্ব এই পরিবর্তন কি শুধু দেশের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকবে!! নাকি দেশের সীমানা (Boundary) ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়বে এশিয়া (Asia) ও বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তি দেশগুলোর ভেতরেও?
এক লাখ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এক পাকা রাস্তা যা এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করবে ইউরোপকে। পণ্য ও যাত্রী নিয়ে বিনা বাধায় লরি, বাস ও গাড়ি চলবে সেই রাস্তায়। কাগজে-কলমে পরিকল্পনাটা শুনতে কিন্তু দারুণই লাগে।
প্রকল্পটির নাম এশিয়ান হাইওয়ে (Asian Highway)। এ প্রকল্পের আওতায় অসংখ্য সড়কের একটা নেটওয়ার্ক (Network) গড়ে তোলার কথা ছিল। এই নেটওয়ার্কের (Network) মাধ্যমে যুক্ত হওয়ার কথা ছিল দুই মহাদেশের দুই দূরতম প্রান্তের। কথা ছিল, ইউএন-এসক্যাপের (UN-ESCAP) এশিয়ান হাইওয়ে (Asian Highway) নেটওয়ার্ক (Network) এমন এক রুট (Route) নির্মাণ করবে যা ঢাকাকে ছুঁয়ে যাবে। আর ইস্তাম্বুলকে (Istanbul) যুক্ত করবে টোকিওর (Tokyo) সঙ্গে।
রুট (Route) ম্যাপ (Map) অনুসারে, একজন যাত্রী ঢাকার একটা হাইওয়েতে (Highway) প্রবেশ করে বিনা বাধায় তামাবিল হয়ে ভারত ও মিয়ানমার অঞ্চল দিয়ে হো চি মিন সিটি (Ho Chi Minh City), হ্যানয় (Hanoi), বেইজিং (Beijing), সিউল (Seoul) পেরিয়ে সবশেষে টোকিওতে (Tokyo) পৌঁছাতে পারবেন। অন্য রুটটি (Route) বের হবে বেনাপোল দিয়ে। তারপর কলকাতা (Kolkata), নয়াদিল্লি (New Delhi), লাহোর (Lahore), ইসলামাবাদ (Islamabad), কাবুল (Kabul), তেহরান (Tehran) হয়ে ইসলামাবাদে গিয়ে শেষ হবে।
এশিয়ান হাইওয়ে প্রকল্পের ইতিহাস
এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক (Asian Highway Network) বা এএইচ (AH), গ্রেট এশিয়ান হাইওয়ে (Great Asian Highway) নামেও পরিচিত, এটি এশিয়া দেশগুলোর মধ্যে একটি সহযোগিতামূলক প্রকল্প এবং এশিয়া ও প্যাসিফিকের জন্য জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন (ESCAP) হাইওয়ে সিস্টেম (Highway System) এর অন্তরভুক্ত।
এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ১৯৫৯ সালে, স্নায়ুযুদ্ধের (Cold War) সময়। ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক (Asian Highway Network) তৈরির উদ্দেশ্য ছিল এশিয়ার ৩২টি দেশকে ইউরোপের সঙ্গে যুক্ত করা। নেটওয়ার্কটি তৈরির জন্য ২০০৩ সালে ব্যাংককে (Bangkok) একটি আন্তঃসরকার চুক্তি (Intergovernmental Agreement) গৃহীত হয়েছিল। বাংলাদেশ ২০০৯ সালে আঞ্চলিক চুক্তি (Regional Agreement) স্বাক্ষরের মাধ্যমে হাইওয়ে নেটওয়ার্কে সংযুক্তির আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেয়।
মহাসড়কে মহাদেশ অতিক্রম করতে এবং ইউরোপে পৌঁছানোর জন্য ৩২ টি দেশ চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই প্রকল্পে অংশ নেয়া কয়েকটি দেশ হলো ভারত (India) [লুক ইস্ট সংযোগ প্রকল্প (Look East Connectivity Project)], শ্রীলঙ্কা (Sri Lanka), পাকিস্তান (Pakistan), চীন (China), ইরান (Iran), জাপান (Japan), দক্ষিণ কোরিয়া (South Korea), নেপাল (Nepal) এবং বাংলাদেশ (Bangladesh)।
এই প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশে গোপালগঞ্জ, নড়াইল, যশোর, চট্টগ্রাম (Chittagong), কক্সবাজার (Cox’s Bazar) ও খাগড়াছড়ি জেলার মোট ১৭টি সেতু (Bridge), ৭টি কালভার্ট (Culvert), ১৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক (Connecting Road) ও দুটি এক্সেল লোড কন্ট্রোল স্টেশন (Axle Load Control Station) নির্মাণ করা হয়েছে যা প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে বাণিজ্যিক সুবিধার পাশাপাশি ইন্টারসিটি (Intercity) পরিবহন ও লজিস্টিক নেটওয়ার্ক (Logistic Network) উন্নত করেছে। এশিয়ান হাইওয়ের (Asian Highway) আওতাধীন একটি টেকসই যোগাযোগ নেটওয়ার্ক (Network) স্থাপন করতে ঢাকা, ভাঙ্গা, বেনাপোল সড়কে নড়াইলের কালনায় মধুমতি নদীর উপর দেশের প্রথম ছয় লেনের (Six-Lane) প্রথম দৃষ্টিনন্দন মধুমতি সেতু (Madhumati Bridge) নির্মাণ করা হয়।
এই সেতুটি দৈর্ঘ্য ৬৯০ মিটার ও প্রস্থ ২৭.১০ মিটার। উভয় পাশের সংযোগ সড়ক (Connecting Road) যার দৈর্ঘ্য ৪.৭৩ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ৩০.৫০ মিটার। এই সেতুটি নির্মাণে মোট ব্যয় হয় ৯ শত ৭ কোটি টাকা। এই সেতুটি উদ্বোধনের পর থেকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ সুফল ভোগ করতে শুরু করেছে।
অনেকের মতে পদ্মা সেতু (Padma Bridge) ও নড়াইলের কালনা সেতু (Kalna Bridge) তৈরির মূলে ছিল এশিয়ান হাইওয়ে (Asian Highway)। পদ্মা সেতু ও কালনা সেতু চালু হওয়ার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রুটে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ। এই রুটটি এশিয়ান হাইওয়ে (Asian Highway) নামে পরিচিত। এএইচ-১ (AH-1) রুটটি বাংলাদেশের বেনাপোল (Benapole) সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে যশোর (Jessore) হতে পদ্মা সেতু (Padma Bridge), ঢাকা (Dhaka) হয়ে কাচপুর (Kanchpur), নরসিংদী (Narsingdi), শেরপুর (Sherpur), সিলেট (Sylhet) দিয়ে তামাবিল (Tamabil) পর্যন্ত ৪৯১ কিলোমিটার সড়ক পথ অতিক্রম করবে।
এছাড়াও জয়দেবপুর (Joydebpur), চন্দ্রা (Chandra), টাঙ্গাইল (Tangail), এলেঙ্গা (Elenga), টেকনাফ (Teknaf), কক্সবাজার (Cox’s Bazar), চট্টগ্রাম (Chittagong) কিংবা চট্টগ্রাম (Chittagong) – দাউদকান্দি (Daudkandi) এর মতো রোড প্রজেক্টগুলো কাগজে-কলমে এশিয়ান হাইওয়ে এর না হলেও, সরকারি নথিপত্র অনুযায়ী এগুলো তিন এএইচ (AH) রুটেরই অংশ হিসাবে দেখানো হত।
এশিয়ান হাইওয়ে (Asian Highway) বাস্তবায়নের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি, যোগাযোগের গতিশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বহির্বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের ব্যবসায়ের প্রচার ও প্রসারের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে, এতে করে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু এতো কিছুর পর এশিয়ান হাইওয়ে প্রকল্পটি ২০১৬ থেকে ২০২২ মেয়াদে বাস্তবায়নের কথা ছিল। প্রকল্পের আওতায় ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন (Resettlement) ৩০ দশমিক ৩০ হেক্টর, আড়াই হাজার বর্গ মিটার কোর অফিস বিল্ডিং (Core Office Building), ১৭টি এপ্রোচ সড়কে ব্রিজ (Bridge), সাথে কালভার্ট (Culvert), একটি টোল গেট (Toll Gate), দুটি এক্সএল লোড কন্ট্রোল (Axle Load Control) এবং ৫৫২টি সিটি নির্মাণসহ (City Construction) ৫৫২ জন নিরাপত্তা কর্মী (Security Personnel) নিয়োগ দেওয়ার কথা ছিল। যার অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়নি।
এই প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের অংশে এশিয়ান হাইওয়ের (Asian Highway) ১ হাজার ৭৭১ কিলোমিটার তৈরি হওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম (Dhaka-Chittagong) চার লেন মহাসড়ক (Four-Lane Highway) ও ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে (Expressway) নিয়ে ৩০০ কিলোমিটারেরও কম অংশের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সংযোগ সড়কগুলো তৈরি না হওয়ায় বাংলাদেশ অনেক অর্থনৈতিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যেমন, চীনের কুনমিং (Kunming) পর্যন্ত একটি ১৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা ছিল। চীন (China) রাস্তাটি তৈরি করতে রাজি হয়েছিল, সম্মতি দিয়েছিল মিয়ানমারও (Myanmar)। কিন্তু গত দশকের শেষ দিকে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার চুক্তি করতে অসম্মতি জানায়। কাজটি করা গেলে বাংলাদেশ সরাসরি কুনমিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারত।
অথচ সম্প্রতি মিয়ানমার (Myanmar) ও ভারত (India) সেভেন সিস্টার্স (Seven Sisters) রাজ্যকে—অরুণাচল (Arunachal), আসাম (Assam), মেঘালয় (Meghalaya), মণিপুর (Manipur), মিজোরাম (Mizoram), নাগাল্যান্ড (Nagaland) ও ত্রিপুরা (Tripura)—প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার নেটওয়ার্ক সড়কের মাধ্যমে মিয়ানমারের সিটওয়ের (Sittwe) সাথে সংযুক্ত করেছে। বাংলাদেশ সহজেই এই নেটওয়ার্কে (Network) যুক্ত হতে পারত। এর ফলে সেভেন সিস্টার্স (Seven Sisters) রাজ্যগুলো প্রবেশ করতে পারত বাংলাদেশের বন্দরগুলোতে (Ports)। ফলে বেড়ে যেত ব্যবসা (Business)।
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ (Developing Country)। এদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অধিকাংশ সময়ে অস্থিতিশীল থাকে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে এই ধরনের বড় বাজেটের প্রকল্পগুলো বিলাসিতা মাত্র। আর তারই ফলশ্রুতিতে দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য এই প্রকল্পটি থমকে যায়। এতে করে বাংলাদেশের পক্ষে বহির্বিশ্বের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক রক্ষা করা কিছুটা কষ্টসাধ্য হবে।
কিন্তু অন্যদিকে এই প্রকল্পের আওতায় যে সকল উন্নত দেশ (Developed Countries) রয়েছে সেই সকল দেশগুলো এই প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে আরো বেশি সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে। এর ফলে বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে, এরূপ দেশগুলো সহজে এ প্রকল্পের আওতাধীন দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তুলবে, তাই বাণিজ্যিক (Commercial) দিক থেকে এই দেশগুলো লাভবান হবে।
কিন্তু এই স্বপ্ন এখন স্বপ্ন হয়ে থাকবে কিনা তা দেখার বিষয়। মহা উৎসাহ ও ধুমধামের সাথে প্রকল্পটির কাজ শুরু হলো; শেষ পর্যন্ত তহবিল (Funding) কমে আসতে থাকে। রাজনৈতিক টানাপোড়েনে বলতে গেলে হিমঘরে চলে যায় এশিয়ান হাইওয়ে (Asian Highway) প্রকল্প। পরিকল্পনার কাজ ফের কখনো শুরু হবে কিনা, কিংবা হলেও কবে শুরু হবে তা এখনো নিশ্চিত নয়। তাই এশিয়ান হাইওয়ে প্রকল্পটি সম্পূর্ণভাবে উচ্চাভিলাষী বাংলাদেশের জন্য শুধু কাগুজে পরিকল্পনা হয়ে থাকবে কিনা তা ভবিষ্যতে দেখার বিষয়।
জন সচেতনতার জন্য ব্লগটি শেয়ার করুন আপনার পরিজনের সাথে। ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে মন্তব্য জানান কমেন্ট বক্সে, পরবর্তি ব্লগ পড়তে বিজনেস ম্যানিয়ার নিউজলেটারটি সাবসস্ক্রাইব করুন।