সন্দেহ ও শত্রুতা থেকে দু’টি বিখ্যাত জুতার ব্র্যান্ড | Adidas vs Puma Story In Bangla
সাধারণ মুচি পরিবারের দুই ভাইয়ের সন্দেহ আর শত্রুতা থেকে কি কোটি টাকার দু’টি সফল কোম্পানী গড়ে ওঠা সম্ভব? কি হয় যখন ২য় বিশ্বযুদ্ধে জুতার কোম্পানীকে অস্ত্র তৈরী করতে বাধ্য করা হয়?
জেনে নিন সেই অসাধারণ দু’টি ব্যবসার গল্প যা দুই ভাগে বিভক্ত করে দিল জার্মানীর হার্জাগো-নরিক নামের এক শহরতলীকে এবং পরিণত হল বর্তমান পৃথিবীর দু’টি অনন্য জুতার কোম্পানীতে।
বাড়ির ভেতরেই একটি লন্ড্রি, আর সেখানে বসেই জুতার কারিগর বাবা ক্রিস্টফ ডজলার জুতা বানান। মা পলিন ডজলার লন্ড্রির ব্যবসাটা দেখেন। তাদের সন্তানেরা বাবার থেকে জুতা বানানোর কৌশল শেখে। এভাবেই চলছিল ঊনিশ-শো শতাব্দীর জার্মানীর এই ডজলার পরিবারের মধ্যবিত্ত জীবন।
চার সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছেলে রুডফ বা রুডি। কথাবার্তায় দারুন পারদর্শী। সহজেই মিশে যেতে পারে মানুষের সাথে। দ্রুত নেটওয়ার্ক তৈরী করে ফেলতে তার জুড়ি পাওয়া ভার।
আর সবচেয়ে ছোট ছেলে এডফ বা আডি। একটু চুপচাপ আর ক্রিয়েটিভ প্রকৃতির। তার নিপুন হাতে বানানো জুতাগুলো এক কথায় অসাধারণ। অপূর্ব সব জুতা বানানোর উদ্ভাবনী শক্তি তার স্রষ্টা প্রদত্ত।
তাই দুইজনের দক্ষতা এক হয়ে ঠিক হল আডি জুতা বানাবে এবং রুডি সেগুলো বিক্রি করবে।
১৯২৪ সালে এই দুইভাই তাদের কাপড় ধোয়ার ঘরে “গ্যাবরুডার ডজলার সু-ফ্যাবরিক” নামের একটি কোম্পানী শুরু করে যার নাম বাংলা করলে দাঁড়ায় “ডজলার ভাইদের জুতা-কারখানা”। তাদের কোম্পানী মূলত খেলোয়াড়দের জন্য জুতা বানানো শুরু করে।
জুতা বানাতে গিয়ে আডি খেলার মাঠে খেলোয়াড়দের দৌড়ানোর সুবিধা, অসুবিধাগুলো ও সংগ্রামগুলো গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করে। বৃষ্টির ফলে মাঠের পিচ্ছিলতা, মাঠের উচু নীচু অংশ, দৌড়ানোর গতির তারতম্য সহজেই খেলোয়াড়কে মাটিকে ফেলে দিতে পারে। তাই সে তার জুতাগুলো এমনভাবে বানাতে চাইলো যা পায়ে দিয়ে একজন খেলোয়াড় সহজে পিছলে পড়বে না এবং মাঠের যে কোনো পরিস্থিতিতে ভালোভাবে দৌড়াতে পারবে।
জুতায় এমন বৈশিষ্ট্য যুক্ত করতে সে তার ছোটবেলার খেলার সাথী ফ্রিট-সেলাইন যে পেশায় একজন কামার, তাকে দিয়ে নিজের বানানো জুতার নীচে স্পাইক করিয়ে নিল। জুতায় স্পাইক করা মানে হচ্ছে ছোট ছোট পিরামিডের মত সূচালো ধাতব কিংবা প্লাস্টিকযুক্ত প্লেট জুতার নীচে এমনভাবে জুড়ে দেওয়া যেন তা পায়ে দিলে সূচালো অংশ মাটিতে খানিকটা ডেবে গিয়ে খেলোয়াড়কে দৌড়ানোর সময় ব্যালেন্স রাখতে সাহায্য করে। এতে এমনকি বৃষ্টির মধ্যেও খেলোয়াড়ের পিছলে পড়ার সম্ভাবনা কমে যায়। তখনকার সময়ে স্পাইক করা জুতার চিন্তাটা একেবারেই নতুন। জুতা বানানোর এ অভিনব কৌশল তাদের সুনাম খুব দ্রুত ছড়িয়ে দেয়।
তারা মাঠ ও দৌড় সংক্রান্ত খেলাগুলোকে কেন্দ্র করে আলাদাভাবে জুতা বানানো শুরু করলো। এক বছরের মাথায় তারা ফুটবল খেলোয়াড়দের জন্য চামড়ার তৈরি বিশেষ ধরণের বুট জুতা তৈরী করা শুরু করে। আডির বন্ধু ফ্রিট-সেলাইন হাত দিয়ে চমৎকারভাবে জুতাগুলো স্পাইক করে দিত।
দ্বিতীয় বছরটাও তাদের আর্থিকভাবে কষ্টেই যায়। এ সময় তাদের কোম্পানীতে প্রায় ১২জন কর্মী প্রতিদিন ৫০ জোড়া জুতা বানাচ্ছিল।
জুতাগুলো বাজারে ভালো চলায় পাঁচ বছরের মাথায় ১৯৩০ সালের মাঝামাঝিতে গিয়ে বিক্রির সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়ালো বছরে ২ লাখ জোড়া জুতা।
ওদিকে একই সময়ে রাজনীতির মাঠে চলছিল অন্য খেলা। এডলফ হিটলারের নেতৃত্বে ডানপন্থি উগ্রবাদী দল নাৎসি পার্টি তখন ক্ষমতার শীর্ষে- যারা কিনা সাদা-কালো মানুষে বৈষম্য, ইহুদি বিদ্বেষ, জাতীয়তাবাদ ও আর্য জাতির শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস করতো। নাৎসি পার্টি জার্মান তরুন প্রজন্মকে বিশেষ করে কম বয়সীদের খেলার জন্য দারুনভাবে উদ্দীপ্ত করে তোলে। বিনোদনের উৎস ও জনপ্রিয়তা কুড়ানোর অন্যতম মাধ্যম বার্লিন অলিম্পিক খেলাকে টার্গেট করে তারা জার্মানকে একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে নিজেদের একটা ভালো ভাবমূর্তি বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিল। কিন্তু এসবকিছুই ছিল বিশ্ববাসীর মনোযোগ সরানোর কৌশল মাত্র। ভেতরে ভেতরে চলছিল নাৎসি পার্টির একটা ভয়ংকর গোপন পরিকল্পনা যা বাকী বিশ্ব কল্পনা-ও করতে পারে নি।
১৯৩৩ সালে ডজলার ভাইদের জুতা কারখানার জন্য রাজনৈতিক ও আর্থিক সহযোগীতা পেতে দুই ভাই রুডি ও আডি নাৎসি পার্টিতে যুক্ত হয়। বড় ভাই রুডি নাৎসি পার্টিতে বেশ সক্রিয় ভূলিকা পালন করলেও ছোট ভাই আডির খুব একটা আগ্রহ দেখা যায় নি।
তারা ১৯৩৬ সালে অলিম্পিকে যোগ দিতে যাচ্ছে এমন এক আফ্রিকা-আমেরিকান দৌড়বিদ জেসি-ওয়েন্স কে তাদের বানানো একজোড়া জুতা উপহার দেয় এবং জুতাটি পায়ে দিয়ে জেসি-ওয়েন্স সে বছর দৌড় প্রতিযোগীতায় অলিম্পিকে ৪টি স্বর্ণ পদক জয় করে। এই ঘটনা বিশ্বের কাছে ডজলার ভাইদের কোম্পানীকে আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিতি পেতে সাহায্য করে। দিন দিন রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকলেও তাদের তৈরী জুতার বিক্রি ক্রমাগত বাড়তেই থাকে।
ধীরে ধীরে নাৎসি পার্টির ভয়ংকর পরিকল্পনা এবার সবার চোখের সামনে আসতে থাকে। ঘটনা পুরো ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে মোড় নেয়। খেলার মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থেকে বাকী বিশ্বকে বুঝতে না দিয়ে নাৎসি পার্টি নিরবে এতদিন যুদ্ধের জন্য জার্মান সৈন্যবাহিনীকে প্রস্তুত করছিল। এর পরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটতে থাকে। তারা কয়েকটি দেশে আক্রমণ চালিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সুচনা করে। যুদ্ধে পাঠানোর জন্য কমবয়সী তরুনদের জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এর মধ্যে ডজলার ভাইদের এক ভাই রুডিকেও জোর করে যুদ্ধে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অন্য ভাই আডি অজ্ঞাত কারণে যুদ্ধে যাওয়া থেকে অব্যহতি পায়। তাদের জুতা তৈরীর কারখানাকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এবং সেখানে অস্ত্র উৎপাদন করা শুরু হয়।
অজস্র নিরীহ মানুষের মৃত্যু, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মিত্রবাহিনীর সমন্বিত আক্রমণ, এবং খোদ জার্মানীর বিরোধিতার মুখে নাৎসি পার্টির পতন ঘটে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি হয়। ১৯৪৫ সালের ২রা সেপ্টেম্বরে পৃথিবী সংঘাতবিহীন নতুন একটি দিনের সূচনা করে।
বড় ভাই রুডি যুদ্ধের কঠোরতা ও বিভীষিকা থেকে প্রাণ নিয়ে বেঁচে ফিরে আসে। তাদের কোম্পানী আবার নতুন করে জুতা তৈরী করা শুরু করে। কিন্তু দুই ভাইয়ের সম্পর্ক আর আগের মতো থাকে না। কিছু একটা তাদের সম্পর্কের মধ্যে চিড় ধরিয়ে দেয়, এবং দিন দিন সে চিড় বাড়তেই থাকে। দেখা দেয় মত ও মূল্যবোধের বিভেদ এবং শুরু হয় সন্দেহ ও তিক্ততা।
তিক্ততা থেকে ১৯৪৮ সালে রুডি “রুডা” নামের আলাদা একটি কোম্পানী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। যা পরবর্তিতে “পুমা” নামে পরিচিতি লাভ করে। এক বছর পর ছোট ভাই আডি “ এডিডাস” নামের কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করে।
সেই থেকে দু’টি কোম্পানীই বর্তমান বিশ্বে সাফল্যের চূড়ান্তে পৌছে দাপিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। জুতার সাথে সাথে তারা স্পোর্টস সংক্রান্ত আরো কিছু পন্য নিয়ে আসে। সারা বিশ্বে নাইক এর পরেই ২য় স্থানে যে স্পোর্টসওয়্যার প্রস্তুতকারক কোম্পানীটি রয়েছে তার নাম এডিডাস, যা কিনা ইউরোপের সবচেয়ে বৃহত্তম কোম্পানীর স্থান দখল করে রেখেছে। এবং অ্যাথলেটিক পোষাক বিক্রয়ের ক্ষেত্রে পুমা বিশ্বের ৭ম-তম স্থান দখল করে রেখেছে।
২০২০ সালে এডিডাসের নেট আয় হয় ৬৭৪ বিলিয়ন ইউরো এবং পুমার নেট আয় হয় ২২৯ মিলিয়ন ইউরো।
জার্মানের সে ছোট্ট শহরতলীতে গড়ে ওঠা “এডিডাস” ও “পুমা” খেলার জগতে এখন পর্যন্ত অতি পরিচিত দু’টি নাম।
কিন্তু যুদ্ধের এত বড় ধকল কিভাবে সামাল দিল তারা? কিভাবে শত্রুতার পিছু নিয়ে এল এই সাফল্য? ঘটনাগুলো বেশ চাঞ্চল্যকর।
প্রথম দিকে যখন জার্মান সরকার কারখানাগুলোকে পুনরায় চালু করার জন্য আর্থিক, ঋণ ও সম্পদ সহায়তা দিয়েছিল, তখনই দুই ভাই তাদের কারখানা আবার চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়।
তারপর যখন তাদের কোম্পানী ভাগ হয়ে যাচ্ছিল এবং সকল কর্মীদের যে কোন একটি কোম্পানী বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বলা হল, সকল বিক্রয় কর্মীরা চলে গেল রুডির কোম্পানীতে এবং আডির কাছে বাকি রয়ে গেল জুতার সকল কারিগর। অর্থ্যাৎ একজনের কাছে জুতা বানানো লোক আছে কিন্তু বিক্রির দক্ষ লোক নেই। এবং একজনের কাছে বিক্রির লোক আছে কিন্তু বিক্রি করার পন্য নেই। তাই সমস্যায় পড়ে গেল দুই কোম্পানীই। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে দু’টি কোম্পানীই নিজেদের দূর্বলতা কাটিয়ে উঠলো।
কিন্তু শত্রুর কাছ থেকেই বোধহয় সবচেয়ে ভালো শেখা যায়। তাই শত্রুর সাথে প্রতিযোগীতা করতে গিয়ে তারা একে অপরকে জবাব দিল নিজেকে উন্নয়ন ও সাফল্যের মাধ্যমে।
দুই কোম্পানীই মূল পন্য খেলার জুতার সাথে সাথে সম্পর্কিত আরো কিছু পণ্য বাজারে নিয়ে এল।
একদিন খেলার মাঠে আডি দেখতে পেল খেলোয়াড়দের পায়ের জুতাগুলো দেখতে সব একই রকম। বোঝার কোনো উপায় নেই যে কোনটা কার কোম্পানীর জুতা। তাই নিজের জুতাগুলো যেন আলাদা করে চেনা যায় সেজন্য আডি তখনই তার একটি জুতায় আঙ্গুলের ছোয়ায় সাদা রংয়ের তিনটি দাগ দিয়ে দিল। এই দাগই পরবর্তিতে এডিডাসের লোগো হিসেবে পরিচিতি পায়। এই তিনটি দাগ খেলোয়াড়দের খেলার মাঠের সংগ্রামগুলোরই প্রতিনিধিত্ব করে এবং সহজবোধ্য হওয়ায় চেনা ও মনে রাখা সহজ হয়।
পুমাও তার আলাদা ব্র্যান্ড ও লোগো নিয়ে আসে যেখানে তার লোগোতে একটি পুমাকে ইংরেজী অক্ষর ডি-এর মধ্যে লাফ দিতে দেখা যায়। লোগোর এই পুমাটি বাধা অতিক্রম করার শক্তি ও ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। পরবর্তিতে এই লোগোর কয়েকটি নতুন সংস্করণ আসে। কিন্তু পুমার লাফ দেওয়ার ছবিটি লোগোতে রয়ে যায়। পুমা ব্র্যান্ড তার লোগোর মাধ্যমে সাহস, আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তাকে ফুটিয়ে তোলে।
লোগোর পরে এডিডাস খেলোয়াড়দের জন্য আরো উন্নত প্রযুক্তির জুতা তৈরীর কাজে পূর্ণ মনোযোগ দিল। আর পুমা মনোযোগ দিল বিক্রির কৌশল উন্নত করায়।
প্রতিযোগীতায় এগিয়ে থাকতে এডিডাস খেলোয়াড় থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের জন্য খেলা সম্পর্কিত পণ্যের বিশাল সমাহার নিয়ে এল। এবং সেলিব্রেটি, ডিজাইনার ও শিল্পীদের সহযোগীতায় স্টোরি টেলিং বা গল্প বলার মাধ্যমে অভিনব এবং আকর্ষনীয়ভাবে পণ্যের প্রচার শুরু করলো। তার পন্যগুলো প্রায় ১০০০ জন অ্যাথলেটিক দ্বারা অনুমোদন পায়- যা কিনা পন্যের মানগত শ্রেষ্ঠত্বকেই প্রমাণ করে।
ওদিকে প্রতিযোগীতায় টিকে থাকতে পুমাও পণ্যের সমাহার নিয়ে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশ করে এবং ঘড়ি, আইওয়্যার ও পারসোনাল কেয়ার সম্পর্কিত নানা পন্য বাজারে নিয়ে আসে। সে সেলিব্রেটি, ডিজাইনার ও শিল্পীদের সাথে নিয়ে ক্রেতার নিজস্ব ফ্যাশন সেন্স প্রকাশ করার ভিন্নধর্মী আবেদনকে ফুটিয়ে তোলে।
প্রথমদিকে মার্কেটিং-এর জন্য দুই কোম্পানীই তাদের শহরের ফুটবল ক্লাবগুলো স্পন্সর করে, সেরা খেলোয়াড়দের সাথে চুক্তি সম্পন্ন করে এবং পরবর্তিতে বিশ্বের বিভিন্ন স্পোর্টস ক্লাব ও বিশ্বমানের খেলোয়াড়দের সাথে চুক্তি সম্পন্নের মাধ্যমে তারা দু’জনই আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করে।
এডিডাস লিওনেল মেসি, জেমস হার্ডেন ও নেওমি ওসাকার মতো খেলোয়াড়দের সাথে পার্টনারসীপ স্থাপন করে। এবং পুমা ইউসেইন্ট বোল্ট, নেইমার জুনিয়র এবং লুয়েস হ্যামল্টন-এর মতো খেলোয়াড়দের সাথে পার্টনারসীপ গড়ে করে।
দুই কোম্পানীই বিভিন্ন স্পোর্টস ইভেন্ট স্পন্সরের মাধ্যমে এবং বিভিন্ন রিটেইলার কোম্পানীর সাথে কোলাবোরেশনের মাধ্যমে তাদের ব্রান্ডকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরে।
১৯২০ সালের ওয়ার্ল্ড কাপ- দুইটি কোম্পানীর জন্যই ছিল চাঞ্চল্যকর। একদিকে এডিডাস টুর্নামেন্টের জন্য অফিসিয়াল ম্যাচ বল সরবরাহ করে। অন্যদিকে পুমা পেলের সাথে ১ লক্ষ ২০ হাজার ডলারের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। চুক্তি অনুযায়ী পেলে মাঠের মাঝ পর্যন্ত হেটে যায় এবং বলে কিক করার আগে পায়ে দেওয়া পুমা কোম্পানীর তৈরী জুতার ফিতাটি বেঁধে নেয়। এই অভিনব মার্কেটিং প্রক্রিয়া পুমার সে বছরের বিক্রি দারুন ভাবে বাড়িয়ে দেয় এবং ব্যাপক হারে বিশ্ববাসীর কাছে পুমা ব্র্যান্ড পরিচিত পায়।
ক্রেতার সর্বচ্চ আরাম, ব্যবহারযোগ্যতা ও সুবিধা-অসুবিধাগুলোকে খেয়াল রেখে এডিডাস ও পুমা তাদের প্রতি পণ্য তৈরী করে। পন্য উৎপাদনকে সহজ ও সাশ্রয়ী করতে তারা জুড়ে নিয়েছে যাবতীয় আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তি।
এডিডাস তার পন্যকে বেশী টেকসই ও পরিবেশবান্ধব করার জন্য সেগুলোতে Prime Blue ও Prime Green recycled plastic এর মতো পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ ব্যবহার করে। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহারের উপযোগী করার জন্য এতে sustainable cotton বা স্থিতিশীল তুলা ব্যবহার করা হয়। তারা “End Plastic Waste” নামের একটি চমৎকার উদ্যোগ নিয়েছে যেখানে ২০২৪ সালের মধ্যে তাদের পণ্যগুলোতে শতভাগ রিসাইকেলড পলিয়েস্টার ব্যবহার করার মাধ্যমে তারা পৃথিবীতে কার্বনের নিঃসরণের পরিমান কমিয়ে আনতে ভূমিকা রাখবে।
অন্যদিকে পুমা ভলকানাইজেশন টেকনিক নামের একটি অনন্য প্রযুক্তি সর্বপ্রথম বাজারে নিয়ে আসে যা জুতার উপরের ও নীচের অংশ একে অপরের সাথে শক্তভাবে আষ্টে পৃষ্ঠে জুড়ে রাখে। কোম্পানীটি তার দৌড়ানোর জুতাগুলোর মাঝামাঝি স্থানে নাইট্রো-ফোম ব্যবহার করেছে যা দৌড়ানোর সময় ব্যবহারকারীকে একটা হালকা ও আরামদায়ক অনুভূতি দেয়। এর তলদেশে পুমা-গ্রিপ নামের একধরণের বিশেষ প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছে যা ব্যবহারকারিকে দৌড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত ট্র্যাকশন সরবরাহ করে এবং বিভিন্ন গ্রাউন্ডে তাকে সহজে চলাফেরা করতে সহযোগীতা করে। নারী খেলোয়াড়ের সংখ্যাবৃদ্ধির দিকে খেয়াল রেখে পুমা তাদের জন্য আলাদা একটি Exclusive কালেকশন নিয়ে আসে।
কিন্তু পৃথিবীজুড়ে এই পন্যগুলো তারা ক্রেতার কাছে কিভাবে পৌছে দেয়?
এডিডাস তার পন্যগুলো ক্রেতার কাছে পৌছে দেওয়ার জন্য আকাশ, সাগর ও স্থল এই তিনটি পথই বাছাই করে নিয়েছে। বিশ্বজুড়ে তার ২,৮০০ টি রিটেল স্টোর রয়েছে। এছাড়াও তাদের রয়েছে মাল্টি ব্র্যান্ড সো-রুম যেখানে এডিডাসের পন্যের আলাদা ডিসপ্লে রাখা আছে। এডিডাসের পণ্য রাখার তাকগুলো খুব বিশেষভাবে ডিজাইন করা থাকে যেন সহজেই কাস্টমাররা তা দেখে চিনে নিতে পারে। পন্য প্রস্তুত, অর্ডার নেওয়া ও ডেলিভারীর সম্ভাব্য প্রতিটি জায়গায় প্রযুক্তির প্রয়োগ দৃশ্যমান। অনলাইনের মাধ্যমে সহজেই ক্রেতারা কিনে নিতে পারেন তাদের যেকোনো পণ্য। রিটেইলার ইনভেন্টরি কমে গেলেই অনলাইনে জানাতে পারেন এবং দ্রুততম সময়ে তাদের স্টোরে পন্য পৌছে দেওয়া হয়।
প্যাকেজিং করাতেও এডিডাস তার আলাদা যত্নের ছোঁয়া দিতে একদম ভোলে নি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি ও সামর্থ্য বুঝে মূল্যকে সামঞ্জস্যতায় নিয়ে এসে প্রতিযোগীতায় টিকে থাকতেও তার কোনো তুলনা নেই। অর্থ্যাৎ পন্যের উৎপাদন থেকে শুরু করে প্রচার ও ক্রেতার হাতে পৌছানো পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়েই এডিডাস সমান ও বিশেষভাবে নজর দিয়েছে।
অপরদিকে পুমা বেশী মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য এবং পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে পন্য সহজলভ্য করার জন্য পাইকারি ও খুচরা বিক্রয় কেন্দ্রসহ বিভিন্ন ডিস্ট্রিবিউটরদের সাথে পার্টনারশিপ করেছে। এছাড়া পুমার রয়েছে নিজস্ব রিটেইল স্টোর। ই-কমার্স স্টোরের মাধ্যমেও ক্রেতার দ্বারপ্রান্তে পন্য পৌঁছে দিচ্ছে পুমা। পুমার সবচেয়ে কার্যকরী মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে- পুমা সুনির্দিষ্টভাবে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, অ্যামেরিকা, এশিয়া প্যাসিফিক ও চায়নায় ক্রেতাদের টার্গেট করে। অর্থ্যাৎ ভৌগলিক বিষয়কে মাথায় রেখে সে উৎপাদন ও বিক্রয় করে। যেমন ক্রিকেট উপকরণ সে তৈরী করে ইন্ডিয়াতে, আর সকারের জার্সি তৈরি করে আমেরিকায়। যার ফলে পুমা অন্য ব্র্যান্ডের চেয়ে কম মূল্যে তার উৎপাদিত পণ্যগুলো ক্রেতার কাছে পৌছে দিতে পারে এবং ডিসকাউন্ট ও লয়ালটি বেনিফিট সহ নানা ধরনের সুবিধা দিয়ে তার ক্রেতাকে ধরে রাখতে পারে। এভাবে ২০১২ সালে পুমার বিক্রি ৩ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ইউরো তে পৌছে যায়।
কিন্তু এডিডাস ও পুমার প্রতিষ্ঠাতা দুই ভাইয়ের এই ৭০ বছরের পারিবারিক শত্রুতার কারণে কি প্রভাব পড়েছে তাদের শহরতলীর উপর? তাদের শক্রতার জের ধরে হার্জাগো-নরিক নামের এই শহরতলীর অধিবাসীরা যাদের বড় একটি অংশ তাদের কর্মচারি- তারা দুই দলে ভাগ হয়ে যায়। একটি দল এডিডাস সাপোর্ট করে ও অন্যদল সাপোর্ট করে পুমা। এক দল অন্য দলের সাথে সব রকমভাবে আলাদা হওয়ার প্রতিযোগীতায় মেতে ওঠে। তাদের মধ্যে সব রকম সৌহার্দ্য, বন্ধুত্ব এমন কি বিয়েও বন্ধ হয়ে যায়। তাদের পরবর্তি প্রজন্মদের মধ্যেও এই শত্রুতা ও প্রতিযোগীর মনোভাব ছড়িয়ে পড়ে। তাই আডি ও রুডি –এই দুই পরিবারের, কোম্পানীর ও তাদের কর্মীদের মধ্যেকার তিক্ততা কমিয়ে আনতে ২০০৯ সালে তারা একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করে যেখানে দুই পরিবারের সদস্যরা ও কোম্পানীর কর্মীরা অংশ নেয়। “পিস ওয়ান-ডে” হিসেবে পরিচিত এই ম্যাচের উদ্দেশ্য ছিল তুমুল প্রতিযোগীতা থাকা সত্ত্বেও যেন কোম্পানী দু’টির জন্য একতা ও শান্তির সাথে কাজ করার একটি সুযোগ তৈরী করা যায়।
শত্রুতার জবাবও যে ব্যবসায়িক ভাষা তথা নতুনত্ব, কৌশল ও সাফল্যের মাধ্যমে দেওয়া যায় এডিডাস ও পুমাই তার প্রমান। কেমন লাগলো আমাদের ব্লগ এবং পরবর্তিতে কোন কোম্পানীর গল্প পরতে চান ? আপনাদের কমেন্টের উপর নির্ভর করে চেষ্টা করবো নিত্যনতুন গল্প উপহার দিতে। ভালো লাগলে সাবস্ক্রাইব করুন নিউজলেটার।