কৃষি থেকে ফার্মা: ACI-এর দখলে সবকিছু! ACI Market Control | Business Mania
ACI গ্রুপ, বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ এবং বৈচিত্র্যময় কনগ্লোমারেট (Diversified conglomerate), যাদের ব্যবসা ফার্মাসিউটিক্যালস থেকে এগ্রিবিজনেস পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে কীভাবে একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যে পরিণত হলো? এই অসাধারণ সাফল্যের পেছনে কি রয়েছে কঠোর পরিশ্রম ও সঠিক কৌশল, নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে আছে কর ফাঁকি, আর্থিক অনিয়ম, এবং বিতর্কের অন্ধকার অধ্যায়?
আজকের Business Maniar ভিডিওতে থাকছে ACI গ্রুপের উত্থান, সাফল্য, এবং বিতর্কিত অধ্যায়ের গল্প, সেই সাথে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিশ্লেষণ।
ACI গ্রুপের যাত্রা শুরু হয়েছিল এমন এক সময়ে, যখন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন খাত পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা তীব্র ছিল। তাদের শেকড় ১৯৬৮ সালে, যখন ব্রিটিশ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান Imperial Chemical Industries (ICI) তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তাদের শাখা স্থাপন করে। স্বাধীনতার পর, বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম নতুন করে শুরু হয়. শুরুটা ছিল ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে। দেশ যখযদ্ধবিধ্বস্ত, এবং জনগণের জন্য উন্নত ও সাশ্রয়ী মূল্যের ওষুধ সরবরাহ করা ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। স্বাধীনতার পর দেশের স্বাস্থ্য খাতের ঘাটতি পূরণে এই প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৯৯২ সালে, ICI তাদের বাংলাদেশ শাখার শেয়ার স্থানীয় ব্যবস্থাপনার হাতে বিক্রি করে। এর পর প্রতিষ্ঠানটি পরিচিতি পায় Advanced Chemical Industries (ACI) Limited নামে। নাম পরিবর্তনের এই অধ্যায়টি শুধু একটি কাগজপত্রের প্রক্রিয়া ছিল না, বরং এটি ছিল এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সূচনা। তাদের মিশন ছিল শুধু ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে সীমাবদ্ধ না থেকে বহুমুখী ব্যবসায় প্রবেশ করা। ACI বুঝতে পেরেছিল, একক খাতের উপর নির্ভরতা ব্যবসায়িক দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ। তাই তারা বিভিন্ন সেক্টরে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে শুরু করে।
ফার্মাসিউটিক্যালস থেকে এগ্রিবিজনেস, কনজিউমার পণ্য, সার, কীটনাশক, খাদ্যপণ্য, এমনকি ইলেকট্রনিক্স ও যানবাহনের মতো খাতে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম বিস্তৃত হয়। কৃষি ও কৃষকদের উন্নয়নে তারা উন্নত মানের সার, বীজ এবং কীটনাশক সরবরাহ করতে শুরু করে।
ACI কনজিউমার পণ্যের ক্ষেত্রে দেশের ঘরে ঘরে পৌঁছানোর কৌশল নেয়। টুথপেস্ট, সাবান, এয়ার ফ্রেশনার, এমনকি রান্নাঘরের পরিচ্ছন্নতার জন্য পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে তারা গ্রাহকদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে ওঠে।
Advanced Chemical Industries (ACI) বর্তমানে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় কনগ্লোমারেট। এর সাফল্যের পিছনে রয়েছেন চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আনিস উদ দৌলা, যিনি দেশের ব্যবসায়িক মহলে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। British Oxygen Group-এ ২৭ বছর এবং ICI-তে ৩২ বছরের অভিজ্ঞতা তাকে একটি দৃঢ় নেতৃত্বের ভিত্তি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। ১৯৮৭ সালে ACI-এর সাথে যুক্ত হওয়ার পর থেকে তিনি কোম্পানির পরিচালনা এবং সংস্কৃতিতে বহুজাতিক স্ট্যান্ডার্ড বজায় রেখেছেন। তার নেতৃত্বে ACI গুণগত মান, উৎপাদনশীলতা এবং গ্রাহক সেবার ক্ষেত্রে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে এগিয়ে যাচ্ছে।
চেয়ারম্যান ছাড়াও ACI-এর পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন বেশ কয়েকজন অভিজ্ঞ এবং প্রতিভাবান পরিচালক, যারা বিভিন্ন খাতে তাদের দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন। ডঃ আরিফ দৌলা, যিনি ২০০৫ সালে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ।
পর্ষদে আরও রয়েছেন শুশমিতা আনিস, যিনি ACI Formulations-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। তার পাশাপাশি আছেন গোলাম মইনুদ্দিন, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর চেয়ারম্যান এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবদুল মুইদ চৌধুরী।
এই বহুমুখী ব্যবসায় ACI গ্রুপ জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তারা করপোরেট ট্যাক্স, শুল্ক, এবং মূল্য সংযোজন করের মাধ্যমে জাতীয় কোষাগারে প্রায় ৪,৩১৮ মিলিয়ন টাকা প্রদান করে। তাদের বার্ষিক বিক্রি প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে । এছাড়া, ACI প্রায় ১০ হাজার কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে, যা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এক বিশাল অবদান।
ACI-এর সাফল্যের গল্প কঠোর পরিশ্রম, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত, এবং বাজার বিশ্লেষণের ফল। একটি ক্ষুদ্র ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি থেকে তারা আজ দেশের অন্যতম বৃহৎ কনগ্লোমারেটে পরিণত হয়েছে।
এগ্রিবিজনেস খাতে উন্নত বীজ, সার, ও কীটনাশকের মাধ্যমে ACI দেশের কৃষি ব্যবস্থাকে আধুনিক করেছে এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। কনজিউমার পণ্যে তাদের মান বজায় রেখে গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করেছে, যা দেশের বাজারে আধিপত্য তৈরি করেছে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও স্বীকৃতি পেয়েছে।
পণ্যের বৈচিত্র্য ও কৌশলী পরিকল্পনার মাধ্যমে ACI দেশের অন্যতম প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে, যা শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক উন্নয়নেরও উদাহরণ।
তবে ACI গ্রুপের সাম্প্রতিক বিতর্ক তাদের Tk 1,831 কোটি আন্তঃপ্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়ে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (BSEC) অভিযোগ তুলেছে, এই ঋণ ২০০৬ সালের নিয়ম লঙ্ঘন করেছে। নিয়ম অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো অনুমোদিত মূলধনের ৫০% এর বেশি কোনো ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে পারে না। ACI-এর মূলধন Tk ৫৭.৩৭ কোটি, অথচ তারা Tk 1,831.৮৯ কোটি ঋণ দিয়েছে তাদের ১২টিরও বেশি সাবসিডিয়ারিকে।
ACI কর্মকর্তারা দাবি করেন, এই ঋণ ব্যবসার সম্প্রসারণে সহায়ক হলেও ঋণের সুদ বাবদ বিপুল অর্থ ব্যয় তাদের মুনাফাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। গত এক দশকে তাদের ব্যবসা Tk ৫০০ কোটি থেকে Tk ১০,০০০ কোটিতে পৌঁছালেও লোকসান অব্যাহত রয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তারা Tk ৪৯ কোটি লোকসান করেছে। এর প্রধান কারণ ঋণের উচ্চ সুদ, শক্তির ব্যয় বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি এবং ডলারের মান বৃদ্ধি।
ACI-এর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো লোকসান ঘটে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে, Tk ৭৭.৫ কোটি। পরবর্তী বছর এই পরিমাণ বেড়ে Tk ১০৫.৯ কোটিতে পৌঁছায়। তবে ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার ৯% সুদের ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করলে ACI সাময়িকভাবে লাভে ফেরে।
২০২৩ অর্থবছরে ACI লিমিটেড ৪৯৩.৯৬ কোটি টাকা সম্মিলিত লোকসান মোকাবিলা করে, যা প্রধানত ACI হেলথ কেয়ার ও ACI লজিস্টিকসের ক্ষতির কারণে। দুইটি সাবসিডিয়ারি যথাক্রমে ২২৪ কোটি এবং ১৫২ কোটি টাকা লোকসান করে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঋণের উচ্চ সুদের কারণে এই ক্ষতি হয়েছে।
শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ৪০% নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করলেও ACI এখনও ঋণের ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল। শপনো ব্র্যান্ড এবং অন্যান্য সেগমেন্টও ঋণের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। তবুও, কোম্পানিটি “Kori Digital Plc” নামে একটি ডিজিটাল ব্যাংকে বিনিয়োগ এবং একটি এভিয়েশন সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছে।
ACI-এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিতর্ক ও অভিযোগের কারণে জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই মনে করেন, ACI-এর পণ্য ও সেবা দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে কৃষি, স্বাস্থ্য এবং ভোগ্যপণ্যে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। তবে, কিছু ব্যক্তি তাদের ব্যবসায়িক কৌশল এবং সাবসিডিয়ারি কোম্পানির ঋণভারের কারণে তাদের পরিচালনা পদ্ধতির সমালোচনা করেছেন। বিশেষত, কিছু সাবসিডিয়ারি কোম্পানির ক্ষতির কারণে পুরো গ্রুপের লাভের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, যা অনেক শেয়ারহোল্ডারের জন্য উদ্বেগের সৃষ্টি করছে। এই মিশ্র প্রতিক্রিয়া ACI-এর ভবিষ্যত পরিকল্পনা এবং সিদ্ধান্তের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে।
ACI কি তাদের বিতর্ক পেরিয়ে দেশের অর্থনীতিতে আরও বড় ভূমিকা রাখতে পারবে, নাকি তাদের সাফল্যের গল্প বিতর্কেই ঢাকা পড়ে যাবে?
দর্শক হিসেবে আপনার মতামত কী? ACI-এর উত্থান এবং বিতর্ক নিয়ে আপনার মন্তব্য আমাদের জানাবেন । আপনি কি মনে করেন তাদের এ বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে, নাকি এটি তাদের সাফল্যের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে? ভবিষ্যতে তাদের উন্নতির জন্য আপনার পরামর্শ দিতে ভুলবেন না। আমাদের কমেন্টে আপনার মূল্যবান মতামত শেয়ার করুন।