ফ্যাশন নাকি একচেটিয়া ব্যবসা? | Aarong & BRAC Power | Business Mania
ইদ উল ফিতরকে সামনে রেখে গত ২২শে ফেব্রুয়ারিতে নোয়াখালীতে উদ্বোধন করা হয় আড়ং এর ৩০তম আউটলেট। বর্তমানে দেশের যে কয়েকটি লিডিং ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ব্রান্ড রয়েছে তার মধ্যে আড়ং শীর্ষস্থানীয়।
দেশের কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে সঙ্গী করে, কারু ও হস্তশীল্পকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌছে দেওয়ার মাধ্যমে গ্রাম বাংলার সাধারণ নারীদের দারিদ্র্যতা দূরীকরণের লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করে আড়ং। যার নামের অর্থ হল গ্রাম্য মেলা।
তবে যাত্রা শুরুর পর আড়ং কেবল আর দেশেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। পৌছে গিয়েছে দেশের বাইরের। ২০১৭ সালেই যাদের পণ্য বিক্রির পরিমান ছিল প্রায় ৮৫০ কোটি টাকা। যা গড়ে প্রতি বছরে ১৫% করে বাড়ছে।
এত কিছুর পরেও আড়ংকে ঘিরে সমালোচনাও কম হয় নি। অতিরিক্ত দামে পণ্য বিক্রি সহ , বিধর্মীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নসহ নানা কারণে আড়ং সমালোচনা ফেইস করতে হয়েছে। ফেইস করতে হয়েছে বয়কট আড়ং এর মতো মুভমেন্ট ও।
আজকের আলোচনায় আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করবো আড়ং এর ইতিহাস, বর্তমান অবস্থা সেই সাথে আড়ংকে নিয়ে তৈরী হওয়া কন্ট্রভার্সিগুলো নিয়েও। তাহলে চলুন ভিডিও শুরু করা যাক।
আড়ং ব্রাকের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। যার অফিসিয়াল (Official) যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর। তবে এর বেশ আগে থেকেই ব্রাকের এমন একটা প্রজেক্ট (Project) চলে আসছিল।
সাল ১৯৭৬। সে সময় মানিকগঞ্জ এ মাত্র ৫ জন দুস্ত নারীকে সাথে নিয়ে কারুশিল্পের কাজ শুরু করেন ব্রাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ এর স্ত্রী আয়েশা আবেদ। পরবর্তীতে জামালাপুরেও এর বিস্তার ঘটে। সে সময় মানিকগঞ্জ ও জামালপুরে নিজেদের কারুশিল্পীদের হাতে তৈরী করা পণ্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করতো ব্রাক৷
এই প্রকল্পকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ১৯৭৭ সালে ব্রাক এমসিসির সাথে একটা চুক্তিও করে। ১৯৭৭ থেকে ৭৮ এই এক বছর যৌথিভাবে কারুপন্যের একটা বিপনি পরিচালনা করে ব্রাক। এরপর ১৯৭৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর এসে একটা পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আড়ং আত্মপ্রকাশ করে। আড়ং নামটি অবশ্য দিয়েছিলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদের চাচি ফরিদা হাসান।
এদিকে ১৯৮১ সালে এক দুর্ঘটনায় আয়েশা আবেদ মারা যান। পরে ১৯৮৩ সালে মানিকগঞ্জে আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন নামে একটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ।
পরবর্তী সময়ে আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন ধীরে ধীরে জামালপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, শেরপুর, ঝিনাইদহ, রাজবাড়ী, নীলফামারী ও কুড়িগ্রাম এও বিস্তার লাভ করে৷ বর্তমানে সারাদেশে এই ফাউন্ডেশনর ১৪টি শাখা রয়েছে।
আর এই ফাউন্ডেশনই হলো আড়ং এর পন্য তৈরির কারখানা। যার মূল কারখানাটি রয়েছে মানিকগঞ্জ এ। এছাড়াও ৫টি মূল শাখার তত্ত্বাবধানে রয়েছে ৮০টি সাব সেন্টার। যেখানে টেইলারিং (Tailoring), ব্লক প্রিন্ট (Block Print), ক্রিন প্রিন্ট (Crean Print), টাই ডাই ক্যামিকেল (Tie DYe Chemicals), বাটিক, হ্যান্ড প্রিন্ট (Hand Print) তাত সহক গার্মেন্টস এর সকল কাজ করা হয়৷ এর মধ্যে শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, পাঞ্জাবি ও শার্টের কাজ করা হয় মানিকগঞ্জ এ আর নকশীকাঁথার কাজ করা হয় জামালপুর, শেরপুর, কুষ্টিয়া আর যশোরে। বর্তমানে সারা দেশে এমন সাব সেন্টার এর সংখ্যা টোটাল ৬৬০টি।
বর্তমানে আড়ং এর অধীনে রয়েছে বেশ কয়েকটি সাব-ব্র্যান্ড। একদম শিশু থেকে শুরু করে পুরুশ এবং মহিলা সবাইকে টার্গেট করেই আড়ং এর রয়েছে আলাদা আলাদা সাব সেক্টর। যেমন
Taaga (টাগা) হল মূলত আধুনিক ও ট্রেন্ডি পোশাকের ব্র্যান্ড Taaga Man (Taaga Man) হলো শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য আধুনিক পোশাক এর ব্রান্ড Herstory by Aarong হলো বিলাসবহুল ও এক্সক্লুসিভ ডিজাইনের পোশাকের ব্র্যান্ড আর
Aarong Earth হলো পরিবেশবান্ধব ও সাসটেইনেবল ফ্যাশনের ব্রান্ড।
তবে আড়ং শুধু তাদের কার্যক্রম পোষাকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে নি হস্তশিল্প জাত পোষাক ছাড়াও বিভিন্ন ধরণের গহনা ও অ্যাক্সেসরিজ,চামড়ার পণ্য (ব্যাগ, ওয়ালেট, বেল্ট),ঘর সাজানোর সামগ্রী (শো-পিস, পাটি, ওয়াল হ্যাংগিং),সিরামিক ও মৃৎশিল্প,কাঠ ও ধাতব কাজের সামগ্রী,নকশিকাঁথা ও অন্যান্য হস্তশিল্পজাত সামগ্রী ও আড়ং তৈরী ও সেল করে থাকে। সেই হিসেব অনুযায়ী প্রায় ১০০+ ক্যাটাগরির পন্য আড়ং সেল করে থাকে।
বর্তমানে সারাদেশ মিলিয়ে আড়ং এর রয়েছে প্রায় ৩০টি আউটলেট। এর মধ্যে ঢাকা শহরেই রয়েছে ১৪টি আউটলেট ও চট্রগ্রাম শহরে ২টি আউটলেট। এছাড়াও রাজশাহী, রংপুর, বগুড়া,কুমিল্লা, সিলেট, যশোর, টাংগাইল,মায়মানসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, ফেনি, ফরিদপুর এও রয়েছে আড়ং এর নিজস্ব আউটলেট (Outlet)।
এসব আউটলেট এ কাজ করা কর্মীদের মধ্যে প্রায় ৪৫% ই নারী কর্মী। এছাড়াও প্রায় ৬৫ হাজার কারিগরি সরাসরি তাদের পন্য আড়ং এ সেল করে থাকে।এছাড়াও আড়ং এর সাথে যুক্ত রয়েছে ৬৫০ জন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। এছাড়া আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনের মাধ্যম আরো ৩ লক্ষ ২৫ হাজার জন মানুষের জীবনে আড়ং সরাসরি প্রভাব ফেলে।
তবে আড়ং তাদের কার্যক্রম শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে নি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও আরব আমিরাতেও আড়ং তাদের পন্যের ডেলিভারি দিয়ে থাকে।
এতকিছুর পর ও আড়ংকে নিয়ে সামলোচনার শেষ নেই। আড়ং এর মেইন টার্গেট সমাজের একটু উচ্চ মধ্যবিত্ত থেকে এলিট শ্রেনীর মানুষেরা হওয়ায়। এর পন্যের দাম সাধারণের তুলনায় একটু বেশি থাকে। এছাড়াও মাঝে মাঝে বেশ চড়া মূল্যে আড়ং তাদের পন্য বাজারে সেল করে থাকে। যে কারণে তাদেরকে নিয়ে সামলোচনাও কম হয় না।
যেমন ২০১৯ সালের জুন মাসের ৩ তারিখে নির্ধারিত দামের দ্বিগুণ দামে পণ্য বিক্রির অভিযোগ আসে আড়ং এর উত্তরার শাখার বিরুদ্ধে। অভিযোগের প্রমাণ পেয়ে আড়ংয়ের উত্তরার এই শাখাকে চার লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সেই সাথে একদিনের জন্য এই শাখাটি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত।
আবার ২০১৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারিতে ভবনের কমন স্পেস শো-রুমের কাজে ব্যবহার করায় পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠান ‘আড়ং’কে দুই লাখ টাকা জরিমানা করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। যদিও এই জরিমানা করার ২৪ ঘণ্টার মাঝেই কোন এক অজানা কারণে সেই ম্যাজিস্ট্রেটকেই বদলি করা হয়।
তবে আড়ং তাদের প্রথম সবথেকে বড় ধাক্কাটা খায় ২০২১ সালের শুরুতে এসে। ২০২১ সালের মার্চ মাসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা ভিডিও বেশ ভাইরাল হয়। সেই ভিডিওতে এক যুবককে আড়ং এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করত্র দেখা যায়। ভিডিওতে সেই যুবক নিজেকে আড়ং এর একজন বিক্রয়কর্মী হিসেবে দাবী করেন। সেই সাথে এও অভিযোগ তুলেন দাঁড়ি কাটতে রাজি না হওয়ায় তাকে চাকরি পাওয়া থেকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। এবিষয়টি নিয়ে আড়ং ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পরে।
সেই সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয় ‘বয়কট আড়ং’ নামের একটা হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড ও অনলাইন মুভমেন্ট। যদিও পরবর্তীতে চাকরিপ্রার্থীর নেতিবাচক অভিজ্ঞতার ব্যাপারটি দুঃখজনক বলে ঘোষণা দিয়ে সেই যাত্রায় রক্ষা পায় আড়ং।
তবে সেই যাত্রায় রক্ষা পেলেও ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক আসিফ মাহতাব সপ্তম শ্রেণির পাঠ্য বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ট্রান্সজেন্ডার ও সমকামীতাবিরোধী প্রতিবাদ প্রদর্শন করলে, সেই ঘটনার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ ব্রাক তাকে চাকরিচ্যুত করে। পরবর্তী সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ঘটনাটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘আড়ং’ বয়কটের আহ্বান জানান।
সেই সময় গোটা দেশেই ব্যাপক সমালোচনার মুখে পরে আড়ং। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাড়াও ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই এই ঘটনার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে৷ যদিও পরবর্তীতে সময়ের সাথে সাথে এই অনলাইন মুভমেন্টটিও ঝিমিয়ে পরে।
এবং বর্তমানে আড়ং তাদের পূর্বের জনপ্রিয়তা আবারো ফিরে পেয়েছে।
প্রিয় দর্শক আমাদের আজকের আলোচনা এই অব্দি। আড়ং এর কোন পন্য আপনি ব্যবহার করলে সেটা আমাদের নিচে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না। সেই সাথে সমকামীতা ও ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুতে ব্রাকের কার্যক্রম নিয়ে আপনার মতামত ও জানাতে পারেন।