স্যামসাং-এর সাফল্যের রহস্য উন্মোচন | Unveiling the Secrets of Samsung’s Epic Journey to Success
একটি কোম্পানী কি একটি দেশ-অর্থনীতি-সমাজ-জীবন এমন কি সামগ্রিক চিত্র বদলে দিতে পারে?
এমনও কি সম্ভব যে দেশের প্রায় ২০% আয়, এমনকি সরকার পর্যন্ত নির্ভর করে একটি মাত্র কোম্পানীর উপর?
জেনে নিন দক্ষিণ কোরিয়ার সর্ববৃহৎ কোম্পানী “স্যামসাং” গড়ে ওঠার গল্প যা শুধু স্মার্টফোন নয়, বরং দেশের প্রতিটি ইন্ডাস্ট্রিতে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে ব্যাপকভাবে।
ধনাঢ্য জমিদার পিতার ছোট ছেলে লি বিয়ং–চুল। সিউলের একটি স্কুলে পড়ালেখা শেষে “ওয়াসেদা ইউনিভার্সিটি ইন টোকিও”তে অর্থনীতির উপর ডিগ্রি নিতে জাপানে যান।
ছাত্র অবস্থায়ই তিনি জাপানের সুনামধন্য “মিতসুবিসি” কোম্পানীতে কাজ করা শুরু করেন। তখন মিতসুবিসি কোম্পানীর ব্যবসা ট্রেডিং, ফিনান্স ও ম্যানুফ্যাকচারিং–সহ আরো বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে ছড়িয়ে ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় পড়ালেখা শেষ না করেই তাকে কোরিয়াতে ফিরে আসতে হয়। বাবার মৃত্যুর পর মাত্র ২০ বছর বয়সে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অর্থ দিয়ে তিনি তার প্রথম ছোট্ট রাইস মিলের কারাখানা গড়ে তোলেন–যা লাভের মুখ দেখতে ব্যর্থ হল। এরপর টেক্সটাইলের ব্যবসাতেও খুব একটা সুবিধা করতে না পারায় তা বিক্রি করে প্রস্তুতি নিতে থাকেন অন্য একটি ব্যবসার।
১৯৩৮ সালে গ্রীষ্ম, শরৎ, বরফ জমা শীত ও বসন্ত – এ চার ঋতুর দেশ দক্ষিণ কোরিয়াতে মানুষ যখন অভাবের তাড়নায় কৃষি কাজ, কাপড় বুনন ও মাছ ধরাকে জীবিকার উৎস হিসেবে বেছে নিয়েছিল, ঠিক এই সময়ে লি বিয়ং–চুল সেখানে “স্যামসাং” নামের একটি ট্রেডিং কোম্পানী গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। তার কোম্পানী স্থানীয়দের উৎপাদন করা সব্জি, শুকনো মাছ ও নুডুলস নিয়ে এসে চীন ও তার আশে পাশের দেশে সেগুলো উচ্চ মূল্যে রপ্তানী করতে থাকে। এই ব্যবসাটি বেশ ভালোভাবে জমে ওঠায় বাড়তে থাকে তার লোকবল ও স্থানীয়দের আয়ের উৎস।
১৯৫০ সালে কোরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হয়। টানা ৩ বছর ভয়াবহ যুদ্ধ চলার পর ১৯৫৩ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় আবারো স্বাভাবিক জীবন ফেরত আসে।
যুদ্ধ শেষে সরকার দক্ষিণ কোরিয়াকে নতুনভাবে গড়তে ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে নানা ধরণের ব্যবসায়িক সুবিধা ও ছাড় দেয়। সাথে Technology নির্ভর করে দেয় পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে।
ওদিকে স্যামসাং-এর প্রতিষ্ঠাতা লি বিয়ং–চুল স্বপ্ন দেখেন, স্যামসাং তার কোরিয়ান নামের অর্থ থ্রী স্টারের মতোই বিশাল, শক্তিশালী ও চিরায়ত কোম্পানীতে পরিনত হবে যা কিনা পুরো কোরিয়ার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ভূমিকা রাখবে এবং ব্যবসার প্রতিটি ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবে। তাই ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে দেওয়া সুবিধা ও Technology-এর শিক্ষাকে আরো ভালোভাবে কাজে লাগাতে স্যামসাং হাত মেলায় সরকারের সাথে ।
কোম্পানীটি সরকারের ঘনিষ্টজনদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। আর্থিক লেনদেন ও বোঝাপড়ার সম্পর্কটি এতটাই ঘনিষ্ট হয়ে যায় যে, বলা হয়ে থাকে যুদ্ধের পরে অ্যামেরিকা থেকে পাওয়া রিলিফও সরকার গোপনে স্যামসাং–এর হাতে তুলে দেয়। এতে একদিকে সাধারণ জনগণ যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয়, অন্যদিকে স্যামসাং টেক্সটাইল, ইন্সুরেন্স, ফুড ম্যানুফ্যাকচারিং এবং ইলেকট্রনিকস এন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশ করে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান তৈরী করে।
ঘটনা এখানেই থেমে থাকে নি, সরকারের সহায়তায় স্যামসাং কোরিয়াতে তার নিজেদের পক্ষে কিছু ব্যবসায়ীক নীতিমালাও বানিয়ে নেয়। স্থানীয় কোম্পানিগুলো এ সকল সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। যার জন্য স্যামসাং দীর্ঘ বছর ধরে কোরিয়ায় একচেটিয়াভাবে ব্যবসা করতে থাকে।
কোরিয়ায় টেকনোলজিতে দক্ষ ও শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা যখন বাড়তে বাড়তে ৫৯ শতাংশে গিয়ে পৌছালো, স্যামসাং তখন এ জনশক্তিকে কেন্দ্র করে টেকনোলজি নির্ভর পন্যের ব্যবসা করার আরো চার চারটি সুবর্ণ সুযোগ দেখতে পেল।
স্যামসাং ইলেক্ট্রনিক্স, ইন্সুরেন্স, ব্রডকাস্টিং, সিকিউটিরিস ও ডিপার্টমেন্টাল স্টোর এ চারটি ইন্ডাস্ট্রিতে একসাথে প্রবেশের মাধ্যমে ১৯৬০ সালে তার ব্যবসাকে বহুমুখী করে তোলে।
দেখতে দেখতে ছয় মাসের মধ্যে স্যামসাং রেডিও ও টেলিভিশন স্টেশন নির্মান শুরু করে এবং তার ইলেকট্রনিং ডিভাইস টিভি ও ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রের বিভিন্ন পার্টস তৈরী শুরু করে।
কয়েক বছর পর লি বিয়ং–চুলের ছোট ছেলে লি কুন–হি ও স্যামসাং-এ যুক্ত হন।
স্যামসাং ইঞ্জিনিয়ারিং সাউথ কোরিয়ার সিউলে একটি মাল্টিন্যাশনাল নির্মান কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করে-যেটার মূল কাজ হল তেল ও পানি পরিশোধনাগার, গ্যাস প্ল্যান্ট ও ইস্পাত প্ল্যান্ট সহ আরো নানা ধরণের অবকাঠামো গড়ে তোলা।
পৃথিবী তখনো জানে না সুবিশাল এক ব্যবসা-সম্রাজ্যের ছোট ছোট প্রস্তর তৈরী সবে শুরু হল মাত্র।
টিভি স্টেশন ও ইলেক্ট্রনিক্স পার্ট দু’টিই প্রস্তুত থাকায় ১৯৭০ সালে এ সম্পর্কিত পন্যগুলো তারা নিজেরাই বানাতে শুরু করে। বানাতে থাকে সাদা কালো টিভি, ওয়াশিং মেশিন এবং ফ্রিজ।
ইস্পাতের প্ল্যান্ট প্রস্তুত থাকায় শুরু হয় ইস্পাত তৈরী। আরো তৈরী করতে থাকে নানা ধরণের বড় বড় জাহাজ। কয়লা, শস্য, তেল ও খনিজ বহনের জন্য ,ফ্যাক্টরী ও ব্রিজ তৈরীতে ব্যবহার্য মেটালের জিনিস বহনের জন্য এবং মেটাল কনটেইনার বহনের জন্য এইসব জাহাজ তৈরী হতে থাকে।
১৯৭৮ সালে স্যামসাং তাদের মহাকাশ বিভাগ চালু করে। এটি স্যামসাং ইলেকট্রনিক্সের একটি শাখা যেটা মহাকাশ বিজ্ঞান এবং উপগ্রহ নিয়ন্ত্রণ সিস্টেম উন্নয়নের কাজ করে থাকে।
এবার স্যামসাং তার কোম্পানীকে গ্লোবালি নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে আরো ব্যাপকভাবে কাজ শুরু করে এবং ইলেকট্রনিক্স পন্যের মার্কেট গবেষণায় প্রচুর পরিমান অর্থ ব্যয় করে।
স্যামসাং তার দু’টি বিজনেস ইউনিট ইলেকট্রনিক্স ও সেমিকন্ডাক্টরস -কে টেলিকমিউনিকেশনের সাথে যুক্ত করে নিয়ে টেক ইন্ডাস্ট্রিতে ঝুঁকে পড়ে ।
ধীরে ধীরে পর্তুগাল, নিউইয়র্ক, টোকিও-তেও তাদের টিভি অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্ট গড়ে ওঠতে থাকে এবং পাশাপাশী প্রস্তুত হতে থাকে তাদের ডাটা সিস্টেম (SDS)।
১৯৮৭ সালের কোরিয়ান মার্কেট পুরোটাই তাদের হাতের মুঠোয়। স্যামসাং-এর টিভি অ্যাসেম্বলি ফ্যাসিলিটি ইংল্যান্ড পর্যন্ত গড়ায়। কিন্ত সাফল্যের এই চূড়ান্ত মুহুর্তে এত বছরের অবাধ নেতৃত্বের অবসান ঘটিয়ে মারা যান স্যামসাং-য়ের প্রতিষ্ঠাতা লি বিয়ং–চুল।
লি বিয়ং–চুলের মৃত্যুর পর তার বড় দুই ছেলের ব্যবসার প্রতি আগ্রহ না থাকার কারণে তৃতীয় ছেলে লি কুন–হি স্যামসাং গ্রুপের পুরো দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। নতুন নেতার হাত ধরে শুরু হয় তাদের এক নতুন যুগ।
লি কুন–হি কোম্পানীটিকে ইলেকট্রনিক্স, ইঞ্জিনিয়ারিং, কনস্ট্রাকশন এবং হাইটেক প্রোডাক্ট –এই চারটি ডিভিশনে ভাগ করেন।
১৯৯০ সালে লি কুন-হি UHD TV, mobile ও নতুন হাইটেক গ্যাজেট প্রস্তুত ও পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য “স্যামসাং ডিজিটাল সিটি” নামের একটি ব্যতিক্রম ধর্মী শহর গড়ার কাজে হাত দেন। ৩৯০ একর জমি, ৩৮টি ফ্লোর ও ১৩৮টি ছোট বিল্ডিং-এর সমন্বয়ে তৈরী অফিস, ল্যাব, ও নানা বিনোদনের পরিকল্পনার ছাঁচে স্যামসাং ডিজিটাল সিটি তৈরীর কাজ শুরু হয়।
বাবার মতো একই নীতি মেনে লি কুন-হি প্রথমে মোবাইলের মেমোরি চিপ এবং এলসিডি ডিসপ্লে তৈরি করা শুরু করেন। এবং তারপর মোবাইল ফোন হ্যান্ডসেট তৈরী করা শুরু করেন।
মোবাইল ফোনের মার্কেট তখন দখল করে রেখেছিল অ্যাপল, মোটোরোলা, এলজির মতো কোম্পানীগুলো। বর্তমান বাজারের অধিকাংশই এখন স্যামসাং ও অ্যাাপেলের দখলে।
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে, কম্পিটিটর হওয়া সত্ত্বেও অ্যাপল তাদের আইফোনে স্যামসাংয়ের মেমরী চিপই ব্যবহার করে থাকে।
ওদিকে সদর্পে ফ্যাশন ও মেডিকেল ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশ করে স্যামসাং। আগের টেক্সটাইল ও পেট্রোকেমিক্যালের সাথে এবার যুক্ত হল সি এ্যান্ড সি ফ্যাশন গ্রুপ এবং Samsung Medical Center নামের একটি মাল্টি ডিসিপ্লিনারি হাসপাতাল। স্যামসাং-এর এই হাসপাতালে কয়েকটি হাসপাতালের সমন্বয়ে লাইফ সায়েন্স নিয়ে উন্নত গবেষণাও চলতে থাকে ।
১৯৯৫ সালে যখন রপ্তানি ১০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাচ্ছিল, তখন কোম্পানীটি Samsung Motor, LCD plant এবং liquid crystal display screen তৈরী করা শুরু করে।
আর এই বছরেই লি কুন-হি রাষ্ট্রপতি রোহ তাই-উকে ঘুষ দেওয়ার জন্য দোষী সাব্যস্ত হন। তবে সরকারের ঘনিষ্টজন হওয়ায় তিনি সহজেই ক্ষমা পেয়েও যান।
TFT-LCD বাজারের শীর্ষ শেয়ারে থাকার সময়কালে তারা ফ্ল্যাট স্ক্রিনের টিভি বাজারে নিয়ে আসে এবং পর্যায়ক্রমে আসে ওয়্যারলেস স্মার্টফোন।
প্রতিযোগিতার বাজারে পন্যকে আরো সুন্দর করতে ১৯৯৬ সালে স্যামসাং চেয়ারম্যান লি কুন–হি ডিজাইনকে কেন্দ্র করে তার প্রতিষ্ঠানে একটি নতুন কালচার গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন যা কোম্পানীকে বিশ্বমানের উদ্ভাবন করতে অনুপ্রেরনা জোগাবে। উদ্যোগটির অংশ হিসেবে তিনি টোকিওতে একটি ডিজাইন স্কুল গড়ে তোলেন যেখানে ডিজাইনারদের অত্যাধুনিক ডিজাইনের কৌশল শেখানো হয়। এখানেই স্যামসাংয়ের ডিজাইনের সক্ষমতা পরিপক্ক হয়।
ওদিকে মোবাইল ও হাইটেক গ্যাজেট তৈরী ও পরীক্ষার জন্য ২০০০ সালে “স্যামসাং ডিজিটাল সিটি”র কাজ শেষ হয়। সারা বিশ্ব থেকে এখানে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ ও দক্ষ কর্মীরা জড়ো হতে থাকে যার সংখ্যাটা একটা সময় দাঁড়ায় প্রায় ৩৫ হাজার। এই ডিজিটাল সিটির ভেতরে রয়েছে খাবার, জিম, সুইমিংপুল ও বাচ্চাদের ডে কেয়ারের ব্যবস্থাসহ আরো নানা সুবিধা। এছাড়াও কর্মীদের যে কেউ চাইলে শেয়ার করতে পারেন নতুন আইডিয়া। স্যামসাং তার সেরা কর্মীদের প্রতিটি সুবিধা অসুবিধার কথা খেয়াল রাখে খুব ভালো ভাবে। কোম্পানীর সমস্ত ইনোভেশন ও পরিচালনার কাজ এখান থেকেই করা হয়ে থাকে।
এই সময়ে স্যামসাং তার গ্যালাক্সি সিরিজের স্মার্টফোন বাজারে নিয়ে আসা শুরু করে যা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
এর মধ্যেই ২০০৪ সালে কোম্পানীটি কনস্ট্রাকশনের ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে থাকে এবং বুর্জ খলিফা তৈরী করে ফেলে। বূর্জ খলিফা দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থিত একটি মেগাস্ট্রাকচার স্ক্র্যাপার ইউনিট যা বিশ্বের সবচেয়ে উচু দালানের মধ্যে একটি।
২০০৮ সালে লি কুন-হিকে কর ফাঁকি এবং বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগে ১০৯ মিলিয়ন ডলার জরিমানা ও কারাদন্ড প্রদান করা হয়। এর মধ্যে জরিমানা গুনতে হলেও তাকে আর জেলে যেতে হয় নি। সরকারের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে এবার জনগণের কাছে শুধুমাত্র ক্ষমা চেয়েই পার পেয়ে যান । এ ঘটনার পর তিনি স্যামসাং গ্রুপের চেয়ারম্যানের আসন থেকে পদত্যাগ করেন এবং CEO হিসেবে স্যামসাং পরিচালনা করতে থাকেন।
এর দুই বছরের মধ্যেই লি কুন–হি স্যামসাং-এ আবারো চেয়ারম্যান পদে ফিরে আসেন। সে বছর কোম্পানীটি ২২৭ বিলিয়ন ডলার আয় করে।
এরপর লি কুন-হি হার্ট অ্যাটাকের ফলে হসপিটালে ভর্তি হলে তার ছেলে লি জে-ইয়ং স্যামসাং গ্রুপের দায়িত্ব নেন।
ডিজিটাল সিটির কল্যানে বাজারে তখন গ্যালাক্সি সিরিজ ও টেক গ্যাজেটের ছড়াছড়ি। যুক্ত হয় ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ডিভাইস।
এরই মধ্যে লি জে-ইয়ং ই Samsung Innovation Museum নামের একটি জাদুঘরও গড়ে তোলেন। Samsung electronics-এর বিপ্লব সহ ১৫০টি আবিষ্কারের অনন্য প্রদর্শনী ও তাদের আদ্যোপান্ত জানার সুযোগ তৈরী করা হয় এই ঐতিহাসিক জাদুঘরটিতে।
কিন্তু এবার এমন কিছু একটা ঘটে যা স্যামসাং-এর ইতিহাসে এর আগে কখনোই ঘটে নি।
২০১৬ সালের আগস্টে স্যামসাং Galaxy Note 7 বাজারে নিয়ে আসে। কিন্তু ফোনটির ত্রুটিপূর্ণ ব্যাটারীর কারণে বেশ কয়েকটি অগ্নিকান্ডের অভিযোগ আসতে থাকে। US Product Safety Commission সমস্ত Galaxy Note 7 ব্যবহারকারীদের তাৎক্ষনিকভাবে মোবাইলটির ব্যবহার বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। এরপর স্যামসাং ২০ লাখ ৫০ হাজার মোবাইল বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেয়।
তারা বুঝতে পারে তাদের অভ্যন্তরীন যোগাযোগ ব্যবস্থা ধীরগতি থাকায় তৎক্ষণাৎ জরুরী পদক্ষেপ নিতে পারে নি । এই ঘটনার জন্য তারা জনগনের কাছে ক্ষমা চেয়ে দুর্ঘটনার দায়ভার স্বীকার করে এবং বিষয়টি সমাধানের লক্ষ্যে তারা “লিডারশিপ ফ্রেমওয়ার্ক” নামের একটি প্রোগ্রাম চালু করে।
এই ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমেই স্যামসাং কর্মীদের strategy তৈরী, communication ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে দক্ষ করে তোলে।
ব্যাটারীকে আরো নিরাপদ করতে একটি নিরাপত্তার প্রোটোকল এবং উন্নত কোয়ালিটি কন্ট্রোল সিস্টেম যুক্ত করে নেয়। তারা আগের থেকেও অনেক বেশী উন্নত ও নিরাপদ প্রযুক্তির মোবাইল বাজারে নিয়ে এসে ঘটনার রেশ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে।
কিন্তু বিধি বাম!
ঠিক এই সময়ে মরার উপর খরার ঘা-য়ের মত স্যামসাং-য়ের উপর নেমে আসে আরেক দূর্যোগ।
বাবার মতো লি জে-ইয়ং কেও ঘুষ, কর ফাঁকি এবং টাকা আত্মসাতের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তার বাবা দুই বার একই অপরাধে পার পেয়ে গেলেও লি জে-ইয়ং কে ঠিকই পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। কোরিয়ার নিয়মনীতিতে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা চলে আসায় সরকারও এবার নিরুপায় হয়ে ওঠে। তাই বাদ যায় না এ ঘটনার সাথে যুক্ত থাকা দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট পার্ক গিউন-হাই-ও। তাকেও ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
এই সব ঘটনা মিলে স্যামসাং-য়ের যথেষ্ট বদনাম হয়। এবং সুনামকে ফিরিয়ে আনতে এবার সে ভিন্নপথ ধরে।
আগে মানুষ স্যামসাং-কে চিনতো উন্নতমানের স্মার্টফোন প্রস্তুতকারী হিসেবে। কিন্তু এবার তারা পণ্যের মান ঠিক রাখার পাশাপাশী বিশ্বের কাছে তাদের ব্র্যান্ডকে অন্যভাবে উপস্থাপন করতে চাইলো।
স্যামসাং “কালচার অফ চেঞ্জ” নামে একটি বৈশ্বিক কালচার গড়ে তোলে। কালচারটি তাদের বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা কর্মীদেরকে প্রতিষ্ঠানের ভেতরেই ঝুঁকি, দায়িত্ব ও নতুন নতুন উদ্ভাবনের উদ্যোগ নিতে অনুপ্রাণিত করে তোলে। কর্মক্ষেত্রে তারা তাদের নানা জাত, বর্ণ ও গোত্রের কর্মীদের মধ্যে সম-অধিকার ও সুযোগ সুবিধার বিষয়টি নিশ্চিত করেই থেমে থাকে না, বরং নারী, শারিরীক প্রতিবন্ধী ও উচ্চ মাধ্যমিক যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষদের স্যামসাং-এ কর্মী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া শুরু করে।
শুধু তাই নয়। স্যামসাং আন্তর্জাতিক নারী দিবস, বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস এবং এ ধরণের দিবসগুলো উদযাপন করা শুরু করে দেয় এবং ব্যাপকভাবে সচেতনতা তৈরী করতে থাকে।
তাদের এ ব্যতিক্রম ধর্মী গ্লোবাল ব্র্যান্ডিং চমৎকারভাবে কাজে লাগে এবং সে বছর স্যামসাং-এর ব্র্যান্ড ভেল্যু ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
সবমিলিয়ে আবারো স্যামসাং সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে এবং হারানো জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়।
ওদিকে স্যামসাং-এর ৩য় কর্ণধার জে-ইয়ং কে কারাগারে এবং তার বাবা রয়েছেন হাসপাতালে। এখন স্যামসাং-এ নেতৃত্ব দেবেন কে?
এই ব্যাপারে স্যামসাং ইলেকট্রনিক্স বিভাগ প্রথমবারের মতো এমন একটি সিদ্ধান্ত নিল যা বিশ্বকে পুরোপুরি চমকে দিল।
স্যামসাং তার বোর্ডের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী Chairman and Chief of Finance পজিশনটিকে দুইটি আলাদা পজিশনে ভাগ করে দিল- যে দায়িত্ব দু’টি আগে একজন মানুষই পালন করতেন।
শুধু তাই নয়, স্যামসাং তাদের প্রধান তিনটি বিজনেস ইউনিটের জন্য নতুন তিনজন CEO নিয়োগ দিল। সিনিয়র লিডারদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ২০১৭ সালে এম বি এ লিডারশিপ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামও চালু করে ফেললো।
এই নতুন লিডারশীপ ব্যবস্থার সময়কালেই সেলফ–ড্রাইভিং গাড়ি পরীক্ষা করার অনুমতি পেয়ে যায় স্যামসাং।
এর সাথে সাথে স্যামসাং চালু করে ফেলে Samsung School, Samsung Smart School, Educational Technology Solutions যা বর্তমান প্রযুক্তির পরিবর্তন ও চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তির যোগান দিতে পারবে।
২০২০ সালে লি কুন-হি মারা যান। যার মধ্য দিয়ে তার ২০ বছরের কালজয়ী নেতৃত্বের অবসান ঘটে।
পরের বছর ছেলে লি জে-ইয়ং কারাগার থেকে মুক্তি পান।
ওদিকে স্যামসাং তার জাহাজ তৈরি, পেট্রোকেমিক্যাল, টিভি ও টেবিল ক্যালকুলেটরের ফ্যাক্টরী তৈরীর কাজ শেষ করে এবং বিমানের ইঞ্জিন তৈরীর ব্যবসাকে আরো বিস্তৃত করতে থাকে।
২০২২ সালে লি জে-ইয়ং-কে আনুষ্ঠানিকভাবে স্যামসাং গ্রুপের নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। স্যামসাং-য়ের হেভি ইন্ডাস্ট্রি বা জাহাজের ব্যবসা দীর্ঘ ৮ বছর লোকসান গোনার পর লাভের মুখ দেখা শুরু করে।
হাসপাতাল ও পেট্রোকেমিকেলের পর কোম্পানিটি Samsung Biologics নামের আরো একটি কোম্পানী গঠন করে। বর্তমানে স্যামসাং ২০২৫ সালের মধ্যে Plant 5 নামের একটি বায়োলজি প্ল্যান্ট নির্মানের প্রকল্প হাতে নিয়েছে যেখানে মূলত ওষুধ ও চিকিৎসা সংক্রান্ত উপকরণ তৈরী করা হবে।
খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা; অর্থ, কর্ম, বিনোদন, যোগাযোগ ; জল, স্থল ও আকাশ পরিবহন, এমন কি মহাকাশ সব জায়গায় আজ স্যামসাং-এর উপস্থিতি বিদ্যমান। সে তার নামের তিনটি তারকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। নক্ষত্র হয়ে ওঠা তার একেকটি ব্যবসা অজস্র ব্যবসার সমন্বয়ে রুপান্তরিত হয়ে চলেছে একটি পূর্ণ গ্যালাক্সীতে। তাদের গ্যালাক্সী সিরিজ-এর নামকরণ হয়তো এই স্বপ্নেরই প্রতিফলন।
তাই নানা পন্য, নানা শিল্প ও নানা দেশের মানুষ মিলে স্যামসাং শুধু একটি ব্র্যান্ড নয়। স্যামসাং দক্ষিণ কোরিয়াকে কেন্দ্র করে ৮০টি কোম্পানীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি বিপ্লবের নাম। স্যামসাং সত্যিকার অর্থেই তার দেশকে বদলে দিতে পেরেছে। প্রতিষ্ঠাতা লি বিয়ং–চুল-এর স্বপ্নকে সত্যি করে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ইন্ড্রাস্ট্রিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই একটি কোম্পানী দিয়েই পৃথিবী দক্ষিণ কোরিয়াকে নতুনভাবে চিনেছে। তাই দূর্নীতির কালো দাগ থাকা সত্ত্বেও কোরিয়ার মানুষের রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে স্যামসাং একটি সাফল্যের নাম যা মিশে আছে তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে।
এই ছিল ২০২৩ সাল পর্যন্ত স্যামসাং বৃত্তান্ত। ব্লগটি কেমন লাগলো তা জানার অপেক্ষায় থাকবো। ভালো লাগলে আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন, বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। আর কোন কোন কোম্পানীর কাহিনী শুনতে চান তা আমাদেরকে অবশ্যই কমেন্টে জানান।