দেশি মেধা দিয়ে বিশ্বজয়, পরিত্যক্ত হেড অফিস! Ananda Group Rise & Fall | Business Mania
প্রিয় দর্শক আমরা মোটামুটি সকলে জানি যে, বিশ্বজুড়ে পুরনো জাহাজ ভেঙে পুনঃব্যবহারযোগ্য ধাতু ও যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করার কাজটিকে বলা হয় শিপ ব্রেকিং (Ship Breaking)। এটি একদিকে পরিবেশবান্ধব পুনর্ব্যবহারযোগ্য পদ্ধতি হলেও অন্যদিকে শ্রমিক নিরাপত্তা এবং পরিবেশ দূষণের জন্য সমালোচিত। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো—বিশেষত বাংলাদেশ, ভারত, এবং পাকিস্তান—এই শিল্পের প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। বাংলাদেশে এই শিল্পের কেন্দ্রীভূত এলাকা হলো চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপকূল, যেখানে শতাধিক ইয়ার্ডে হাজার হাজার শ্রমিক দিনরাত কাজ করেন। এই শিল্প দেশের রড-লোহার চাহিদা পূরণে মুখ্য ভূমিকা রাখে। প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ২০-২৫ লক্ষ মেট্রিক টন স্ক্র্যাপ লোহা উৎপাদিত হয় এই শিল্প থেকে।
আমাদের বিজিনেজ মিনিয়ার আজকের আলোচনায় এমনই এক শিপ ব্রেকিং কোম্পানিকে নিয়ে, যেটা কিনা একদম তাদের যাত্রার শুরু থেকেই এই শিল্পের মোটামুটি একটা রাজত্য করে আসছে। যদিও বর্তমানে তাদের অবস্থা বেশ সংকীর্ন।
তাহলে চলুন তাদের সম্পর্ক আরো বিস্তারিতভাবে জানতে আমরা আজকের আলোচনাটি শুরু করি।
বাংলাদেশে শিপ ব্রেকিং শিল্প মূলত গড়ে ওঠে ১৯৬০-এর দশকের শেষে, তবে এটি বাণিজ্যিকভাবে বিস্তার লাভ করে ১৯৮০ সালের পরে। এখানে কাজের জন্য নির্ভর করা হয় কমদামী শ্রমিকশক্তির ওপর, যার ফলে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম প্রতিযোগিতামূলক দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
এমন একটা পরিস্থিতেই আনন্দ গ্রুপ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৩ সালে, প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আবু তাহের। প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয় মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং (Marine Engineering) ও নির্মাণ সেবার মাধ্যমে। আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজ লিমিটেড (ASSL) আনন্দ গ্রুপের প্রধান অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯৮৭ সালে কার্যক্রম শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটি প্রথমদিকে দেশীয় জাহাজ নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ কাজে যুক্ত থাকলেও ২০০৮ সাল নাগাদ তারা বিদেশে জাহাজ রপ্তানি করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করে। তাদের নির্মিত জাহাজ মালয়েশিয়া, ডেনমার্ক, জাম্বিয়া ও মোজাম্বিকে রপ্তানি হয়।
তাদের একসময়কার স্লোগান ছিল “দেশে তৈরি জাহাজ, বিদেশে রপ্তানি”। ASSL বাংলাদেশের প্রথম প্রতিষ্ঠান যারা বিদেশে বানিজ্যিকভাবে জাহাজ রপ্তানি করে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তারা জাহাজ নির্মাণের পাশাপাশি শিপ ব্রেকিং খাতে পা রাখে। কারণ এতে কম মূলধনে লাভের সম্ভাবনা ছিল বেশি।
২০০০-এর দশকের শুরুর দিকে আনন্দ গ্রুপ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এলাকায় শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড স্থাপন করে। তারা ইউরোপ, জাপান, কোরিয়া, এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন পুরনো জাহাজ কিনে এনে বাংলাদেশে ভাঙত। প্রতিটি জাহাজ ভাঙার জন্য ২-৩ মাস সময় লাগতো এবং এতে ২০০-৩০০ শ্রমিক সরাসরি যুক্ত থাকতেন।
এদের অনেক জাহাজ ছিল oil tanker, cargo ship এবং container carrier শ্রেণির। আনন্দ গ্রুপ ভাঙা জাহাজ থেকে শুধু লোহা নয়, বরং পুনঃব্যবহারযোগ্য যন্ত্রাংশ যেমন – মোটর (Motor), জেনারেটর (Generator), কনটেইনার ফ্রেম (Container Frame), কেবিনের আসবাব সংরক্ষণ করে নিজের অন্যান্য শিল্পে কাজে লাগাত। এ ছাড়া স্ক্র্যাপ লোহা সরবরাহ করত দেশের বিভিন্ন রি-রোলিং মিলে।
আনন্দ গ্রুপ ২০১০ সালের আগ পর্যন্ত ৭০টিরও বেশি বড় জাহাজ ভেঙেছে, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি ছিল ১০,০০০ টন ওজনের বেশি। তাদের নিজস্ব ইয়ার্ডে ক্রেন, কাচি, অক্সি কাটার সহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি থাকলেও, আধুনিকতা ও নিরাপত্তা মান ছিল তুলনামূলকভাবে বেশ কম । যে কারণে শ্রমিকদের একটা নিরাপত্তাজনিত ঝুকি সব সময়ই ছিল।
আর একারণেই আনন্দ গ্রুপ শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে কাজগুলো মূলত করাত গরিব ও অশিক্ষিত যুবকদের মাধ্যমে, এমনকি তাদের বয়স অনেক সময় ১৫ বছরের নিচেও হতো। তাদের দৈনিক মজুরি ৩০০-৫০০ টাকা হলে।
একটি জাহাজ ভাঙার সময় আগুন লাগা, গ্যাস বিস্ফোরণ, ভারী বস্তু পড়ে যাওয়া—এই ধরনের দুর্ঘটনা নিত্যদিনের ব্যাপার ছিল। বহু শ্রমিক পঙ্গু হয়েছেন, কেউ কেউ প্রাণ হারিয়েছেন। ২০০৯ সালে আনন্দ গ্রুপের এক জাহাজ ভাঙার সময় এক বড় বিস্ফোরণে তিনজন শ্রমিক মারা যান, যা জাতীয় পত্রিকায় শিরোনাম হয়।
তাদের ইয়ার্ডে সুরক্ষা সরঞ্জাম যেমন—গ্লাভস, নিরাপত্তা জুতা, ফায়ার স্যুট—তুলনামূলকভাবে সীমিত ছিল। শ্রমিকদের অধিকাংশকেই কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই সরাসরি কাজের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। শ্রমিকদের আবাসন ব্যবস্থা ছিল জরাজীর্ণ, এবং অনেক সময় বিশুদ্ধ পানির অভাবও ছিল।
এছাড়াও জাহাজ ভাঙার সময় জাহাজের ফুয়েল ট্যাংক, ইঞ্জিন অয়েল, অ্যাসবেস্টস, পলিক্লোরিনেটেড বাইফিনাইল (PCB), সীসা, পারদ ইত্যাদি বিষাক্ত উপাদান সরাসরি সমুদ্রে মিশে যায়। এর ফলে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয় এবং স্থানীয় জেলেরা কম মাছ ধরতে পারেন।
আনন্দ গ্রুপ তাদের শিপ ব্রেকিং কার্যক্রমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো সুসংহত ব্যবস্থা রাখেনি। বিভিন্ন এনজিও যেমন BELA (Bangladesh Environmental Lawyers Association) এবং Greenpeace তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে। ২০১০ সালে Greenpeace-এর একটি প্রতিবেদনে আনন্দ গ্রুপের ইয়ার্ডের পরিবেশগত ঝুঁকি উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়।
এদিকে ২০০৯ সালের দিকে ASSL (আনন্দ শিপইয়ার্ড) প্রায় ১০টি বেসরকারি ব্যাংক থেকে প্রায় ১,২০০ কোটি টাকার ঋণ নেয়, যার বেশিরভাগই ছিল বিনা জামানতে এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নেওয়া। ঋণ নেওয়ার পর অনেক প্রকল্প সময়মতো শেষ না হওয়ায় এবং বিদেশি ক্রেতাদের অনেকে জাহাজ নিতে অস্বীকৃতি জানানোয় ASSL বিশাল আর্থিক সমস্যায় পড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংক এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে উঠে আসে যে ASSL ভুয়া দলিল এবং অতিরঞ্জিত তথ্য ব্যবহার করে ঋণ নিয়েছিল। ২০১১ সালে ASSL-এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং ব্যাংকগুলোও তাগাদা দিতে থাকে। এতে করে তাদের শিপ ব্রেকিং ইউনিটেও বিনিয়োগ কমে যায় এবং শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয়।
একটা সময় আনন্দ গ্রুপ একসময় বাংলাদেশের শিপ ব্রেকিং খাতের শীর্ষ ৫ ইয়ার্ডের মধ্যে ছিল। তবে PHP Group, KSRM, Kabir Steel-এর মতো কোম্পানি একদিকে আধুনিক প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উন্নত হয়েছে, অন্যদিকে আনন্দ গ্রুপ প্রশাসনিক জটিলতা, অনিয়ম এবং বিনিয়োগ সংকটে পড়ে পিছিয়ে পড়ে।
যেখানে অন্যান্য কোম্পানি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা মান (যেমন ISO 30000, HKC) অনুসরণ করে ইয়ার্ড পরিচালনা করে, সেখানে আনন্দ গ্রুপ তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ফলে বিদেশি ক্রেতারাও তাদের এড়িয়ে যেতে শুরু করে।
কিন্তু এখন বর্তমানে আনন্দ গ্রুপের শিপ ব্রেকিং কার্যক্রম প্রায় বন্ধ। কিছু নির্দিষ্ট জমি এখন অন্যান্য শিল্প বা গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ASSL-এর সদর দপ্তরও অনেকটা পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে। শ্রমিকদের অনেকেই অন্যান্য ইয়ার্ডে চলে গেছেন। বিভিন্ন মামলা এখনো চলমান, এবং ব্যাংকগুলো তাদের পাওনা আদায়ের চেষ্টা করছে।
আনন্দ গ্রুপ এখন ছোট পরিসরে কিছু সাবসিডিয়ারি ব্যবসা (যেমন- ছোট ইঞ্জিন রিপেয়ারিং, কিছু হালকা ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রডাক্ট) পরিচালনা করছে। তবে তাদের সেই অতীত ঐতিহ্য আর নেই। ২০২3 সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ASSL-এর কাস্টমার অর্ডার ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ প্রায় শূন্য পর্যায়ে নেমে এসেছে।
আনন্দ গ্রুপ বাংলাদেশের প্রথম দিককার কোম্পানিগুলোর একটি যারা শিপ নির্মাণ থেকে শুরু করে শিপ ব্রেকিং পর্যন্ত পুরো চক্রটি পরিচালনা করেছে। তারা দেখিয়েছে যে দেশীয় মেধা ও শ্রম ব্যবহার করেও আন্তর্জাতিক মানের পণ্য তৈরি সম্ভব। তবে তাদের পতনের মধ্যে দিয়ে শিল্প খাতে স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব বুঝা যায়।
তাদের অনেক পুরনো প্রকৌশলী এবং টেকনিশিয়ান পরবর্তীতে অন্য প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেশের শিল্প উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন। আনন্দ গ্রুপের ইন্টারনাল ক্রাইসিস (Internal Crisis) ছিল শিক্ষা ও সততার অভাবের একটা ভালো উদাহরণ।
প্রিয় দর্শক আমাদের আজকের আলোচনাটি এই অব্দি। আলোচনাটি ভালো লাগলে আমাদের জানাতে ভুলবেন না। সেই সাথে লাইক কমেন্ট আর শেয়ার করে আমাদের সাথেই থাকবেন।