বিস্কুটে লুকানো কোটি টাকার ব্যবসা! অলিম্পিকের অন্ধকার ইতিহাস! | Olympic Controversy | Business Mania
প্রিয় দর্শক অলিম্পিক নামটা শুনলেই আমাদের দেশের মানুষের মনে অলিম্পিক গেইমের পাশাপাশি আরেকটা যেই জিনিস এর নাম মাথায় আসে সেটা হলো অলিম্পিক এর পেন্সিল ব্যাটারীর (Pencil battery) কথা।
সেই ৮০ এর দশক থেকে শুরু করে এখন অব্দী বাংলাদেশের পেনসিল ব্যাটারীর ইন্ড্রাসির মোটামুটি পুরোটাই দখল করে রেখেছে এই অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রি।
৯০ এর দশকে আরো একটি জিনিস মোটামুটি বাজারে রাজত্ব চালাতো। সেটা হলো এনার্জি প্লাস বিস্কুট। মোটামুটি ওই সময়টাতে চায়েতে কিংবা গরম দুধের সাথে ডুবিয়ে এনার্জি প্লাস বিস্কুট খাওয়া ছিল একটা বেশ কমন ব্যাপার। সেই সময়টাতে ভালো নাস্তা বলতে দেশের গ্রাম বাংলার সাধারন মানুষ থেকে শুরু করে শহরে নিম্নবিত্ত মানুষেরা এটাকেই বুঝতো।
প্রিয় দর্শক আমাদের বিজিনেজ মিনিয়ার আজকের আলোচনা দেশের বিস্কুট ও ব্যাটারীর মার্কেটে রাজত্ব করা অলিম্পিক কোম্পনিকে নিয়েই। আলোচনার শুরুতেই বলে রাখি অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রির সাথে প্রয়াত বিখ্যাত চিত্র নায়ক সালমান শাহ এর একটা যোগসূত্র আছে। কিন্তু সেটা কি? তা আমরা আলোচনার একদম শেষের দিকে জানবো তাহলে চলুন আলোচনা শুরু করা যাক।
অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠা মোহাম্মদ ভাই এর হাত ধরে। এখন আপনাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে নামের সাথে ভাই কেন? আসলে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় তাদের পরিবার ঢাকায় চলে আসে ভারতের গুজরাট থেকে। তাদের পরিবার মূলত পারস্য বংশভূত। তারা “বাহাইয়ান” সম্প্রদায়ের লোক। তাই তাদের সকলের পুরুষ কিংবা মহিলাদের নামের শেষে “বাহাই” পদবিটা থাকতো। যা পরে এই উপমহাদেশের উচ্চারনে পরবর্তীতে “ভাই” হয়ে যায়।
তো মোহাম্মদ ভাই ১৯৭৯ সালে বেঙ্গল কার্বাইড নামের একটা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। যেটার মূল লক্ষ্য ছিল ব্যাটারি (Battery) উতপাদন করা। কিন্তু পরে তারা বিস্কুক উতপাদনের ব্যবসায় প্রবেশ করেন। আর সে সময়ই কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে রাখেন অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড। আর এভাবেই ১৯৯৬ সালে যাত্রা শুরু করে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রি।
ব্যাটারী দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে কোম্পানির মোট প্রফিট এর ৯৫% ই আসে এই বিস্কুট আর কুকিজ থেকে।
বাংলাদেশের বিস্কুট এর বাজারে মোটামুটি জনপ্রিয় প্রায় সব বিস্কুট ই অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রির।
বর্তমানে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রি বিস্কুটের মধ্যে এনার্জি প্লাস, নাটি টিপ, মিল্ক প্লাস, ফার্স্ট চয়েজ,বাটার বাইট, চকোলেট ক্রিম, চকলেট প্লায়া, কোকনাইট বাইট সিরিজ, ডাইজেস্টিভ, এলাইচি প্লাস,লেক্সাস, জি প্লাস, মেরী গোল্ড, রেক্সাস সহ প্রায় ৪৭টি ব্রান্ডের বিস্কুট উতপাদন করে থাকে। যার বেশির ভাগই ব্যাপক জনপ্রিয়।
এছাড়াও ডেইলি কুকিজ, প্রিমিয়াম টোস্ট, মাল্টি গ্রেইন কুকিজ, ডেইলি কেক রাক্স, ডিলাইট কেক, ডেইলি কাপ কাপ কেক স্ফট কেক ঘি, ডেইলী টোস্ট সহ টোটাল ১৮টি ব্রান্ডের টোস্ট ও কেক তৈরী করে থাকে।
এখানেই শেষ নয় রয়েছে ম্যাজিক ক্যান্ডি, হাজমি ক্যান্ডি, পালস, টোফেল মিল্ক, ডিলাইট ক্যান্ডি, পিনাট ক্যান্ডি, ম্যাজিক ক্যনাডি, জুসি লুচি, চুকিও লাভ বার, ওয়াইফান ওয়েফার, ওলিনো ওয়াফার সহ প্রায় ৩৫ রকমের ক্যান্ডি আর ওয়েফার।
এছাড়াও নিমকি মিক্স, টেস্টি নুডুলস, লাচ্ছা সেমাই, ফানডুলস নুডুলস, ফুডি নুডুলস, ক্রিস্পো সহ প্রায় ১৬টি ব্রান্ড এর নুডুলা আর চিপস।
সেই সাথে রয়েছে সিপ্নো টেস্টি নামের নিজস্ব স্যালাইন (Saline)।
বর্তমান দেশের চাহিদা মিটিয়ে আরো ৩২টি দেশে অলিম্পিক তাদের বিস্কুট রপ্তানি করে থাকে।
বর্তমানে যদি অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রির দিক তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে ব্যবসা সম্প্রসারণ সহ পণ্যের গুনগত মান উল্লখের লক্ষ্যে কোম্পানিটি শুধু মাত্র গত ছয় বছরে প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই)এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কোম্পানিটি জমি কিনার জন্য বিনিয়োগ করেছে প্রায় ১৮১ কোটি টাকা। এর মধ্যে বসুন্ধরায় ১১০.২৬ কোটি, তেজগাঁওয়ে ৫২.৬২কোটি, পূর্বাচলে ৮.৯১কোটি এবং নারায়ণগঞ্জে ৮.৫৯কোটি টাকা ব্যয় করেছে ।
কারখানা কার্যক্রম সম্প্রসারণে ১৭৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে অলিম্পিক। এর মধ্যে চানাচুর উৎপাদনের জন্য ২২.৭১ কোটি,নুডুলসের জন্য ২৪.৭৫কোটি, চকোলেটের জন্য ১২ কোটি, কেকের জন্য ২৫.কোটি, বিস্কুটের জন্য ৬৪ কোটি এবং অবকাঠামো ও প্যাকেজিংয়ের জন্য ২৮.৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
এছাড়াও কোম্পানিটি বসুন্ধরায় নিজস্ব কর্পোরেট অফিস (Corporate office) এবং পূর্বাচলে কর্মচারীদের আবাসন সুবিধার জন্য জমি কিনেছে। তেজগাঁওয়ের জমিটি বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য রাখা হয়েছে। আর নারায়ণগঞ্জের বেশিরভাগ জমি কারখানা সম্প্রসারণে ব্যবহার হবে বলে জানান তিনি।
ইবিএল সিকিউরিটিজের আরেকটি প্রতিবেদনে থেকে জানা যায়, অলিম্পিক ইন্সট্যান্ট নুডুলস, ড্রাই কেক, সফট কেক, চকোলেট ওয়েফার, ক্যান্ডি, টফি, টোস্ট, রাস্ক এবং স্যাভরি স্ন্যাকসের মতো বিভিন্ন পণ্যে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছে। এই বিনিয়োগগুলো কোম্পানির সম্প্রসারণ কৌশলকে স্পষ্ট করে তুলে ধরে।
আর কোম্পানিটির বৈচিত্র্যকরণের কৌশলের কারণেই গেল ২০২২-২৩ অর্থবছরে তারা প্রায় রেকর্ড পরিমান ২৫৭৮ কোটি টাকার রাজস্ব প্রদান করে,হিসান করলে দেখা যায় যা গত ছয় বছরে প্রায় ১০০%বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও, কোম্পানিটি গেল ২০২৩ অর্থবছরে শেয়ারহোল্ডারদের ৬০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ প্রদান করেছে।
যদিও ২০২৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে, অলিম্পিকের রাজস্ব সামান্য কিছুটা হ্রাস পেলেও প্রফিট ঠিকই বেড়েছে।
সব মিলিয়ের বর্তমানে বাংলাদেশ অটো বিস্কুট ও ব্রেড প্রস্তুতকারক সমিতি এবং বাংলাদেশ ব্রেড বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতির একটা প্রতিবেদন অনুযায়ী, অলিম্পিক বর্তমানের স্ন্যাকস ও বিস্কুট শিল্পের দেশের এক নাম্বার প্রতিষ্ঠান এর মধ্যে স্ন্যাকস শিল্পে ২২%এবং অটো বিস্কুট উৎপাদনে ২৫ থেকে ৩০% বাজার শেয়ার দখল করেছে রেখেছে।
চলুন এবার জানা যাক কোম্পানিটির বর্তমান মালিকানা ব্যাপারে । জীবিত থাকা অবস্থাতেই মোহাম্মদ ভাই তার দুই পুত্র, আজিজ মোহাম্মদ ভাই এবং রাজা মোহাম্মদ ভাই, পাশাপাশি তার কন্যাদের কোম্পানির মালিকানায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। আর কোম্পানি পরিচালনার জন্য ভাই মুবারক আলীকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিযুক্ত করেছিলেন।
কিন্তু ২০১৮ সালে মারা যান অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ভাই ২০১৮ এবং পরে ২০২৩ সালে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুবারক আলী মারা যান । মারা যাওয়ার পর এই দুটি পদ শূন্য ছিল।
এদিকে ২০২৩ সালের জুনে, আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের ছেলে ও ভাতিজা বোর্ডে পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার মাধ্যমে এ পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্ম অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের বোর্ডে প্রবেশ করে। মুবারক আলীর ছেলে, মুনির আলী, এর আগেই কোম্পানিতে পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।
এরপর গত বছর ২০২৪ এর জুলাইয়ে, আজিজ মোহাম্মদ ভাই কোম্পানিটির চেয়ারম্যান (Chairman) হিসেবে নিযুক্ত হন। এছাড়া, তার বোন, নূরজাহান হুদাকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান।
তবে প্রিয় দর্শক অলিম্পিক কোম্পানিটিকি নিয়ে তেমন কোন অভিযোগ না থাকলেও বর্তমান চ্যায়ারম্যান আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে নিয়ে রয়েছে ব্যাপক অভিযোগ ও সমালোচনা। ভিডিও শুরু তেই বলেছিলাম প্রয়াত বিখ্যাত অভিনেতা সালমান শাহ এর সাথে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রির একটা কানেকশন রয়েছে।
পুলিশ ও অনেকের ভাষ্যমতে অভিযোগ আছে ১৯৯৬ সালে জনপ্রিয় অভিনেতা সালমান শাহকে হত্যার পিছনে হাত রয়েছে আজিজ মোহাম্মদ ভাই এর । যদিও আজিজ মোহাম্মদ ভাই এর পরিবারে ভাষ্যমতে তিনি ওই সময় থাইল্যান্ড এ ছিলেন। বর্তমানে এখনো আজিজ মোহাম্মদ ভাই তার পরিবারে নিয়ে থাইল্যান্ডেই থাকেন। এবং সেখান থেকেই ব্যবসা পরিচালনা করেন।
এছাড়াও সালমান শাহের মৃত্যুর দুই বছর পর ১৯৯৮ সালে ঢাকা ক্লাবে খুন হয় আরেক চিত্র নায়ক সোহেল চৌধুরী কে। এ হত্যাকাণ্ডেও আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও তার পরিবারের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে।
এছাড়াও আজিজ মোহাম্মদ ভাই এর নামে মাদকের সাথে জড়িত থাকার ও অভিযোহ উঠে, ২০০৭ সালে তাকে ইয়াবা ট্যাবলেট তৈরির জন্য অভিযুক্ত করা হয়। এবং এই একই অপরাধে ২০১৩ সালে তার ভাতিজা আমিন হুদার ৭৯ বছরের জেল হয়েছে। ।
এমনকি ২০১৯ সালের অক্টোবরে ঢাকার গুলশান এলাকায় ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বাড়িতে মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে মাদ্রকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মদের বোতল, সীসা ও ক্যাসিনো সামগ্রী উদ্ধার করে। যদিও সেসময় তিনি দেশে ছিলেন না।
যাই হোক, প্রিয় দর্শক আমাদের আজকের আলোচনা এই অব্দি। আলোচনাটি ভালো লাগলে আমাদের জানাতে ভুলবেন না। সেই সাথে লাইক কমেন্ট আর শেয়ার করে আমাদের সাথেই থাকবেন।
(সোর্স: কালাবেলা, TBS, অলিম্পিকের নিজস্ব ওয়েবসাইট, উইকিপিডিয়া)