চাকরিচ্যুত ১৫০০ কর্মী, টপ ফার্মা কোম্পানির লুকানো সত্য! | Drug International | Business Mania
এই মুহুর্তে যদি আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হয় পোষাক শিল্পের পর রপ্তানির দিক দিয়ে বাংলাদেশের সবথেকে সম্ভাবনাময় শিল্প কোনটি? উত্তরটি হবে ফার্মাসেটিকাল (Pharmaceutical) সেক্টর বা ওষধ শিল্প। ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশের বর্তমান ওষুধের বাজার প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। প্রতি বছরে প্রায় ১৫% হারে গ্রো করা এই ইন্ড্রাস্টির ২০২০-২১ অর্থ বছরে টোটাল রপ্তানির পরিমান ছিল প্রায় ১৬৯ মিলিয়ন ডলার। যা প্রায় ১৫০টি দেশে ওষুধ রপ্তানির মাধ্যমে আয় হয়েছে। আর ওষুধ রপ্তানির দিক থেকে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ পঞ্চম স্থানে রয়েছে। আর বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৫৭টির মতো ফার্মাসেটিক্যাল ম্যানিফ্যাকচারিং প্রতিষ্ঠান থাকলেও মার্কেট শেয়ার এর ৬০% ই দখল করে রয়েছে শীর্ষ ১০টি কোম্পানি।
আর এর মধ্যে বর্তমান সময়ে নানা কারণে একই সাথে সবথেকে আলোচিত ও সমালোচিত কোম্পানিটি হলো ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড।
প্রিয় দর্শক বিজিনেজ মিনিয়ার আজকের আলোচনা এই ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড কোম্পানির উপর। যেখানে আমরা জানার চেষ্টা করবো কোম্পানিটির একদম শুরুর দিককার ইতিহাস থেকে শুরু করে বর্তমান অবস্থা অব্দি। তাহলে চলুন ভিডিওটি শুরু করা যাক।
ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড এর যাত্রা শুরু হয় ১৯৮০ সালে ডা মীর মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন এর হাত ধরে। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যেকজন ব্যাবসায়ী অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছিলেন ডা মীর মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন তাদেরই একজন। ১৯৪৮ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশের পর তিনি ১৯৫০ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে যোগ দেন। পরে অবশ্য ১৯৫৩ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চট্রগ্রামে চলে আসেন এবং এখানেই ব্যাবসা শুরু করেন। ১৯৫৮ সালে চালু করেন রপ্তানিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘ পাকিস্তান গদি মিলস লিমিটেড’
১৯৬২ ও ১৯৬৭ সালে তিনি যথাক্রমে “আলহাজ টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড” ও “আলহাজ জুট মিলস লিমিটেড” প্রতিষ্ঠা করেন। দুটো প্রতিষ্ঠানেরই তিনি ছিলেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮০ সালে তিনি টঙ্গি শিল্প এলাকায় প্রতিষ্ঠা করে ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড। বর্তমানে যা বাংলাদেশের শীর্ষ ওষুধ কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটি।
প্রতিষ্ঠান তাদের যাত্রার একদম শুরু থেকেই একই সাথে মান সম্মত ও সহজলোভ্য ওষুধ উতপাদনের দিকে নজর দেয়। এরই লক্ষ্যে তারা ম্যানিফ্যাকচারিং নানা রকম উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে থাকে।
যেমন ১৯৮৫ সালে তারা ম্যানিফ্যাকচারিং এ একটি অত্যাধুনিক ওরাল সলিড ডোজেজ প্ল্যান্ট স্থাপন করে, যার ফলে সহজেই ওষুধের গুনগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। এরপরে ১৯৯০ সালেই তারা বাংলাদেশে সর্বপ্রথম সফট জেলেটি ক্যাপসুল ফর্মুলেশন এর প্রবর্তন করে যার ফলে ওষুধের ধারণ ও শোষণ দুই ক্ষমতাই বৃদ্ধি পায়।
এবং উন্নত মানের ওষুধ উতপাদনের কারনে যাত্রা শুরু মাত্র ২০ বছরের মাথাতেই কোম্পানিটি ২০০০ সাল থেকে ওষুধ রপ্তানি করা শুরু করে।
বর্তমানে ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড বিভিন্ন ক্যাটাগরির ওষুধ উতপাদন করে থাকে। যেমন: এন্টিবায়োটিক এর মধ্যে অ্যামক্সিসিলিন (Amoxicillin),আজিথ্রোমাইসিন (Azithromycin), সিপ্রোফ্লক্সাসিন (Ciprofloxacin)। ব্যথানাশক ও এন্টি-ইনফ্লেমেটরি (Anti-inflammatory) এর মধ্যে ,প্যারাসিটামল (Paracetamol), ডাইক্লোফেনাক (Diclofenac), আইবুপ্রোফেন (Ibuprofen)। হার্ট ও ডায়াবেটিসের ওষুধ এর মধ্যে, অ্যাটোরভাস্টাটিন (Atorvastatin) ,গ্লিমিপেরাইড (Glimepiride), মেটফরমিন (Metformin)। স্নায়ুবিক ও মানসিক চিকিৎসার ওষুধ এর মধ্যে অলানজাপিন (Olanzapine), গ্যাবাপেন্টিন (Gabapentin),ফ্লুওক্সেটিন (Fluoxetin)।গ্যাস্ট্রিক ও হজমজনিত সমস্যার ওষুধ এর মধ্যে ওমেপ্রাজল (Omeprazole), এসোমেপ্রাজল (Esomeprazole), রেনিটিডিন (Ranitidine)। ভিটামিন ও হেলথ সাপ্লিমেন্ট এর মধ্যে মাল্টিভিটামিন, ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট আয়রন ট্যাবলেট তৈরী করে থাকে।
এছাড়াও ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল হারবাল ও উনানী ক্যাটাগরীর ও ওষুধ তৈরী করে থাকে।
পরবর্তীতে ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠাতা ডা. এম এম আমজাদ হোসেন মৃত্যুবরণ করলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন নেন তার পুত্র এম এ হায়দার হোসেন।
এম এ হায়দার এর দায়িত্ব গ্রহনের পর ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল এর কার্যক্রম যেন নতুন একটা মাত্রা পায়। ২০১৯ ও ২০২০ সাল এসময় টানা দুই বছর তাদের সেল প্রায় ৫০% হারে বৃদ্ধি পায়।
বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে জানা যায় ২০১৯ সালে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিক্রীত ওষুধের মধ্যে নবম স্থানে ছিল অ্যান্টিলেউক অ্যান্টি-অ্যাজম্যাটিক্স (Antileukemic anti-asthmatics) ওই বছর ওষুধটি বিক্রি হয়েছে ৫৭৮ কোটি টাকার। এই ওষুধের তৃতীয় শীর্ষ বিক্রেতা ছিল ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল। একই বছরে বহুল বিক্রীত আরেকটি ওষুধ ছিল সালফোনাইলুরিয়া এ-ডায়াবস (Sulfonylurea A-Diabes)। ওষুধটির ৩৮৮ কোটি টাকার বাজারে দ্বিতীয় শীর্ষ বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ছিল ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল। একইভাবে বহুল বিক্রীত প্লাটিলেট এগ্রেগ ইনহিবিটরস (Platelet Aggregate Inhibitors) বিক্রিতে প্রথম, সিস্ট অ্যান্টিফাঙ্গাল এজেন্টস (Cyst Antifungal Agents) জাতীয় ওষুধ বিক্রিতে দ্বিতীয় এবং বেটা ব্লকিং এজেন্ট প্লেইন বিক্রিতে তৃতীয় শীর্ষ প্রতিষ্ঠানও ছিল ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল।
এবিষয়ে বণিক বার্তার একটা সাক্ষাৎকারে ড্রাগ ইন্টারন্যাশনালের ব্যবসা দ্রুত বৃদ্ধির পেছনের কারণ জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির জেনারেল ম্যানেজার (ফ্যাক্টরি) মাহবুবুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠান কার্ডিয়াক (Cardiac) পণ্যের উৎপাদন বেশি করেএর সঙ্গে নতুন যুক্ত হয়েছে অ্যান্টি-ক্যান্সার (Anti-cancer) ওষুধ। স্থানীয় বাজারে বিক্রির পাশাপাশি রফতানিও হয় ওষুধটি। কার্ডিয়াকের ক্ষেত্রেও নতুন নতুন পণ্য যোগ হয়েছে। সেল বৃদ্ধির মূল কারণ এ দুটি ওষুধ পণ্য। আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, সেটি হলো আমাদের সরবরাহ চেইন বেশ নিরবচ্ছিন্ন।
আর এর ফলেই ২০২১-২২ কর বছরে সেরা করদাতা সম্মাননা ও জাতীয় ট্যাক্স কার্ড পান ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের পরিচালক ও এমডি এম এ হায়দার হোসেন ও হেড অব অপারেশন আনোয়ারা হোসেনসহ একই পরিবারের সাতজন। এনবিআর-এর তালিকায় যারা ‘কর বাহাদুর পরিবার’ নামেও পরিচিত।
পরিবারের সাত সদস্য হলেন- ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের এমডি এবং খাজা ইউনুস আলী মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান এম এ হায়দার হোসেন। ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ডা. এম এম আমজাদ হোসেনের স্ত্রী, কোম্পানির অন্যতম পরিচালক ও এমডি এম এ হায়দার হোসেনের মা খাজা তাজমহল, ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের হেড অব অপারেশন আনোয়ারা হোসেন, একই কোম্পানির পরিচালক ও খাজা ইউনুস আলী মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য মোহাম্মদ ইউসুফ, রুবাইয়াৎ ফারজানা হোসেন, হোসনে আরা হোসেন ও লায়লা হোসেন।
বর্তমান হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের একটা বিরাট অংশই দখল করে রেখেছে ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড। ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী কোম্পানির বার্ষিক আয় প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। এছাড়াও প্রায় ৪ হাজার এরো বেশি মানুষ প্রতিষ্ঠানক্টির সাথে সরাসরি যুক্ত।
তবে এতকিছুর পরেও ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড এর কিছু কালো দিক ও রয়েছে। জানা যায় ফ্যাসিস্ট (Fascist) সরকাররের আমলে শেখ হাসিনার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকায় বিভিন্ন সময় নানা ধরনের অবৈধ সুযোগ সুবিধা পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি৷
এর মধ্যে জমি দখল, ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষকে ভয় ভীতি দেখানোর মতো অভিযোগ ও রয়েছে। সেই সাথে নানা সময়ে প্রতিষ্ঠানটি অনেক তুচ্ছ করে অনেককেই চাকরিচ্যুত করেছে। যাদের বকেয়া বেতন এখন অব্দি।
এসব প্রকাশ পায় শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাবার পরে।৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে চলে গেলে, ২০ আগস্ট রাজধানীর ঢাকার গ্রীন রোডে ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড এর চাকুরীচ্যুত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বকেয়া বেতন-ভাতা ও চাকরীতে পুনঃ বহালের দাবিতে হেড অফিস খাজা ইউনুছ আলী টাওয়ার ঘেরাও মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। মানববন্ধন শেষে একটা বিক্ষোভ মিছিল বের করে তারা।
এসময় ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড এর নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে তারা। জানা যায় ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের পরিচালক বর্তমান এমডি এম এ হায়দার হোসেন ও তাঁর সহধর্মিণী হেড অব অপারেশন আনোয়ারা হোসেন স্বৈরচারিতায় এবং বৈষম্যের কারণে সারাদেশ থেকে প্রায় ১৫০০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কোন প্রকার নোটিশ ছাড়াই চাকুরীচ্যুত করা হয়। শুধু তাই নয় কোম্পানির হেড অব অপারেশন আনোয়ারা হোসেন সদ্য বিদায়ী পালাতক প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয় ফরিদপুর-৪ আসনের এমপি নিক্সন চৌধুরী আপন ছোটবোন। বক্তারা এসময় অভিযোগ করেন যে অনেকেই অফিসিয়ালী মানসিক নির্যাতন রাজনৈতিক ভয়ভীতি ও প্রেশার ক্রিকেট করে চাকরী ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল এবং সপদে বহাল থাকা অবস্থায় অন্য কর্মচারি সেখানে পাঠিয়ে বেতন বন্ধ করে দেওয়া হয়। অনেক কর্মচারী দীর্ঘ আট নয় বছর চাকরি করার পর শুধুমাত্র সামান্য বকেয়া বেতন ছাড়া কিছুই পাইনি বলে অভিযোগ করেন। বেতন-ভাতা না পেয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। এ সময় দ্রুত সময়ের মধ্যে বকেয়া পরিশোধের জন্য দাবিও জানান চাকুরীচ্যুত এই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। একইসঙ্গে তারা বকেয়া বেতন ভাতাসহ পুনঃ নিয়োগে দাবি জানান।
এ সময় সারা দেশথেকে অসা ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড এর সাবেক জিএম এএসএম জোনাল ম্যানেজ, ম্যানেজার, এমপিও সহ প্রায় ৬০০ জন চাকুরীচ্যুত ভুক্তভোগী উপস্থিত ছিলেন।
বর্তমানে এই হলো ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড এর অবস্থা। যেই সমস্যার সুরাহা এখনো হয় নি। প্রিয় দর্শক আমাদের আজকের আলোচনাএই অব্দি, ভালো লাগলে আমাদের জানাতে ভুলবেন না। সেই সাথে লাইক কমেন্ট আর শেয়ার করে আমাদের সাথেই থাকবেন।