প্রিন্স মুসা: বিলিয়ন ডলারের King নাকি প্রতারণার সম্রাট? | Datco Group | Business Mania
Moosa Bin Shamsher, একজন বিতর্কিত, রহস্যময় এবং বিত্তশালী ব্যবসায়ী। তাঁর নাম উচ্চারণ করলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিলাসিতা, কোটি কোটি টাকার সম্পদ, আর রহস্যে ঘেরা একটি জীবন। কিন্তু কীভাবে তিনি এই জায়গায় পৌঁছালেন? কীভাবে তৈরি হলো Datco Pvt. Ltd., এবং কেন আজ এই প্রতিষ্ঠান প্রায় হারিয়ে গেছে?
এক সময় বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ছিলেন তিনি। ‘Prince Moosa’ নামে খ্যাত এই ব্যক্তিত্বের জীবন নিয়ে রয়েছে অসংখ্য গল্প, সমালোচনা ও বিতর্ক। Datco Pvt. Ltd. একসময় দেশের অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি পেলেও, সময়ের সাথে এটি যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে।
Business maniar আজকের আলোচনায় আমরা জানবো Moosa Bin Shamsher-এর উত্থান এবং Datco Pvt. Ltd.-এর সফলতা ও পতনের আসল গল্প। তাহলে চলুন শুরু করা যাক!
মুসা বিন শমসের বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং ড্যাটকো প্রাইভেট লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তিনি বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি শিল্পের পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত এবং ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে আন্তর্জাতিক অস্ত্র ব্যবসায়ে জড়িত থাকার জন্যও আলোচিত ।
তাই জনশক্তি রপ্তানি জিনিসটা আসলে কি সেটি একবার বলে দেই,
জনশক্তি রপ্তানি হলো একটি দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে বিদেশে কাজের জন্য পাঠানো। সাধারণত উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে উন্নত বা শ্রমঘন দেশগুলোর চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন খাতে শ্রমিক পাঠানো হয়। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইনসহ অনেক দেশ জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে এবং অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে।
বাংলাদেশের জন্য জনশক্তি রপ্তানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখে, কারণ প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের উৎস। বাংলাদেশ থেকে সাধারণত মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক পাঠানো হয়। ড্যাটকো প্রাইভেট লিমিটেড ছিল বাংলাদেশের অন্যতম বড় জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান, যা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে লাখো কর্মী পাঠিয়েছে।
এবার আসি মূল আলোচনায়,
১৯৪৫ সালের ১৫ অক্টোবর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ফরিদপুরে, বর্তমান বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেন মুসা বিন শমসের। তিনি চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তৃতীয় সন্তান। তার পিতা শমসের আলী মোল্লা ব্রিটিশ সরকারের একজন সিভিল সার্ভেন্ট ছিলেন। শিক্ষাজীবনে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই মুসা বিন শমসের ব্যবসায়িক জগতে প্রবেশ করেন। তিনি ড্যাটকো প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন, যা মূলত জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৭০-এর দশকে মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে ড্যাটকো তাদের কার্যক্রম শুরু করে। পরবর্তীতে ১৯৮০-এর দশকে দক্ষিণ কোরিয়া, পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশ, উত্তর আফ্রিকা এবং ২০০০-এর দশকের শুরুতে ইউরোপের বাজারেও প্রবেশ করে। তাদের সংযোগ ও প্রভাব এতটাই বিস্তৃত ছিল যে, তারা অনেক বড় প্রতিষ্ঠান ও সরকারি সংস্থার সঙ্গে কাজ করত। তবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিযোগিতা এবং নীতিগত পরিবর্তনের ফলে তাদের বাজার সংকুচিত হয়ে আসে।
ড্যাটকো প্রাইভেট লিমিটেডের অধীনে বিভিন্ন সহায়ক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেমন ড্যাটকো রিক্রুটিং, ড্যাটকো ল্যান্ড হোল্ডিংস, ড্যাটকো ট্রেডিং, সিইসি কনসাল্টিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন এবং এম্পিরিয়ান এডুকেশন প্ল্যাটফর্ম ইত্যাদি। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মুসা বিন শমসেরের দর্শন ও নীতিমালা অনুসরণ করে পরিচালিত হয়।
মুসা বিন শমসের ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে আন্তর্জাতিক অস্ত্র ব্যবসায়ে জড়িত থাকার জন্য আলোচিত হন। ১৯৯৮ সালে লন্ডনের সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকা তাকে নিয়ে “ম্যান উইথ দ্য গোল্ডেন গানস” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে । যেখানে তার বিলাসবহুল জীবনযাপন ও অস্ত্র ব্যবসার বিষয়ে আলোচনা করা হয়।
মুসা বিন শমসের কানিজ ফাতেমা চৌধুরীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ এবং তাদের তিন সন্তান রয়েছে। তাদের মধ্যে পুত্র ববি হাজ্জাজ একজন শিক্ষক ও রাজনীতিবিদ, এবং জুবি মুসা একজন আইনজীবী। তাদের কন্যা শেখ ফজলে ফাহিমের সাথে বিবাহিত, যিনি শেখ ফজলুল করিম সেলিমের পুত্র।
মুসা বিন শমসেরের প্রতিষ্ঠান, ড্যাটকো প্রাইভেট লিমিটেড বাংলাদেশের একটি পরিচিত বহুমুখী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, যা বিভিন্ন শিল্পে সেবা প্রদান করে আসছে। প্রতিষ্ঠানটি জনশক্তি রপ্তানি, তথ্যপ্রযুক্তি, পরামর্শ, রিয়েল এস্টেট এবং শিক্ষা খাতে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। ড্যাটকো প্রায় পাঁচ দশক ধরে সফলভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাদের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক নেতৃত্ব অর্জন করা, বিশেষ করে পণ্য, রিয়েল এস্টেট এবং জনশক্তি রপ্তানি খাতে।
ড্যাটকো প্রাইভেট লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন: ড. মুসা বিন শমসের, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, মিসেস কানিজ ফাতেমা চৌধুরী, পরিচালক, যিনি পূর্ববর্তী বাংলার অন্যতম প্রধান জমিদার পরিবারের সদস্য এবং সামাজিক ও দাতব্য কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন।
এছাড়াও বিভিন্ন পরিচালক ও দক্ষ কর্মী এ কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত।
ড্যাটকো প্রাইভেট লিমিটেডের প্রধান কার্যালয় ঢাকার বনানীতে অবস্থিত, এবং এটি দেশের অন্যতম আলোচিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। যদিও প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে, এর কার্যক্রম নিয়ে সময়ে সময়ে বিতর্কও সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মুসা বিন শমসেরকে ঘিরে নানা আলোচনা রয়েছে। ড্যাটকো প্রাইভেট লিমিটেড ও এর পরিচালনার সঙ্গে জড়িত বিতর্কিত বিষয় যেমন, বিদেশে অর্থ পাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ সবচেয়ে আলোচিত।
২০১৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন, দুদক মুসা বিন শমসেরের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করে। তিনি দাবি করেন, সুইস ব্যাংকে তার ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ৯০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের অলংকার জমা রয়েছে। তবে সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সেখানে তার নামে কোনো হিসাব নেই। এ নিয়ে দুদক তাকে একাধিকবার তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ২০১৬ সালে তিনি শারীরিক অসুস্থতা ও ‘মৃত্যু-আতঙ্কে’ ভুগছেন বলে হাজিরা থেকে বিরত থাকার আবেদন করেন।
আবার, ২০১৭ সালে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর মুসা বিন শমসেরের বিরুদ্ধে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা বিলাসবহুল রেঞ্জ রোভার গাড়ি অবৈধভাবে ব্যবহারের অভিযোগে মামলা দায়ের করে। গাড়িটি আনুমানিক চার কোটি টাকা মূল্যের এবং শুল্ক করের পরিমাণ ছিল ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা। মামলাটি দায়েরের পর সাড়ে পাঁচ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও তদন্ত শেষ হয়নি। শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর মামলাটিকে ‘জটিল প্রকৃতির’ বলে উল্লেখ করেছে এবং তদন্তের জন্য বারবার সময় চেয়েছে।
উপরোক্ত ঘটনাগুলো ড্যাটকো প্রাইভেট লিমিটেড এবং মুসা বিন শমসেরের কার্যক্রম নিয়ে বিভিন্ন সময়ে উত্থাপিত বিতর্কের উদাহরণ। তবে, এসব অভিযোগের অনেকগুলোরই চূড়ান্ত প্রমাণ বা ফলাফল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়না।
ড্যাটকো প্রাইভেট লিমিটেড ভবিষ্যতে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণ এবং বৈশ্বিক নেতৃত্ব অর্জনের লক্ষ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তাদের মিশন হলো ২০৩০ সালের মধ্যে জনশক্তি, তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষা প্রযুক্তি, ডিজিটাল মার্কেটিং ইত্যাদি খাতে উদ্ভাবনী সমাধান ও সেবা প্রদানের মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতায়ন করা। এছাড়া, প্রতিষ্ঠানটি তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে এবং সংশ্লিষ্ট শিল্পগুলোর ভবিষ্যৎ রূপায়ণে অবদান রাখতে চায়।
ড্যাটকো প্রাইভেট লিমিটেড, মুসা বিন শমসেরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বহুমুখী এই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানটি, বাংলাদেশে জনশক্তি রপ্তানিসহ বিভিন্ন খাতে সাফল্য অর্জন করেছে। তবে এই সাফল্যের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন সময়ে বিতর্ক ও সমালোচনার মুখোমুখিও হয়েছে, বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ, শুল্কমুক্ত সুবিধায় বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি, এবং সুইস ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ সম্পদের দাবি এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
পাশাপাশি ড্যাটকোর পতনের পেছনে রয়েছে ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং আধুনিক প্রযুক্তি ও নতুন বাজারের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারা। বিশেষ করে ২০০০-এর দশকে বৈশ্বিক চাকরির বাজারের পরিবর্তন এবং কঠোর নিয়মনীতির কারণে প্রতিষ্ঠানটি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে।
তবে ড্যাটকোর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তারা বিশ্বমানের হাসপাতাল, উন্নত পরামর্শ সেবা, এবং জনশক্তি রপ্তানির নতুন দিগন্ত উন্মোচনের মাধ্যমে আরও শক্তিশালী হতে চায়। এই প্রতিষ্ঠান কি সত্যিই বাংলাদেশকে বিশ্ববাজারে আরও বড় করে তুলতে পারবে, নাকি বিতর্কের ছায়ায় ঢাকা পড়ে যাবে?
আপনার মতামত কী? আপনি কি মনে করেন ড্যাটকো তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে? কমেন্টে অবশ্যই জানাবেন।