চিরুনি প্রস্তুতকারক থেকে ২০টি কোম্পানির মালিক | Anwar Group | Business Mania
আনোয়ার গ্রুপ, প্রায় ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্যবসা করে আসা এই গ্রুপ কীভাবে সময়ের সাথে টিকে থেকেছে, সেটাই একটা রহস্য! এক সময় ছোট্ট একটা ব্যবসা থেকে শুরু হয়ে আজ দেশের অন্যতম বৃহত্তম কনগ্লোমারেটটির (The conglomerate) যাত্রাটা কিন্তু সহজ ছিল না।
টেক্সটাইল (Textile), স্টিল (Steel), সিমেন্ট (Cement), ফার্নিচার (Furniture) থেকে শুরু করে ফাইন্যান্স, আনোয়ার গ্রুপের হাত নেই এমন খাত খুব কম! কিন্তু কীভাবে একটা ব্যবসায়িক পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সফল হয়ে আসছে?
Business Maniar আজকের আলোচনায় আমরা জানবো, আনোয়ার গ্রুপের উত্থান, ব্যবসায়িক কৌশল, বাজারে তাদের প্রভাব এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা! ব্যবসার জগতে একটা লিগ্যাসি (Legacy) তৈরি করা মানে শুধুই টাকা কামানো নয়, বরং একটা পরিবর্তনের ছাপ রেখে যাওয়া, আনোয়ার গ্রুপ কি সেটা করতে পেরেছে?
আনোয়ার গ্ৰুপের যাত্রা আজ থেকে নয়, প্রায় ১৮৮ বছর আগের ব্রিটিশ শাসনামল থেকে! আনোয়ার গ্রুপের আনোয়ার হোসেনের দাদা, লাক্কু মিয়া চকবাজারে মাত্র ১ টাকায় বার্ষিক ভাড়ায় একটি দোকান নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন।
লাত মিয়ার মূল ব্যবসা ছিল গরু ও মহিষের শিং থেকে চিরুনি ও বোতাম তৈরি করে তা বিক্রি করা। ধীরে ধীরে তার ব্যবসার প্রসার ঘটে, এবং তিনি এই শিল্পকে আরও সম্প্রসারিত করেন। ভারত থেকে ট্রেনে করে মহিষের শিং নিয়ে আসতেন এবং স্থানীয় কারিগরদের দিয়ে চিরুনি বানিয়ে পুনরায় কলকাতা, মাদ্রাজ, মুম্বাইসহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানি করতেন।
তবে ৮৪ বছর বয়সে তার মৃত্যুর পর ব্যবসা ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে, কারণ তার ছেলেরা তখনো অনেক ছোট ছিল।
লাত মিয়ার ছেলে রহিম বখশ তার বাবার ব্যবসার পরিধি বাড়াতে থাকেন। শুধু চিরুনি ও বোতামের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে, তিনি কাপড়সহ অন্যান্য পণ্যের ব্যবসায়ও নামেন। কিন্তু ১৯৪৫ সালে রহিম বখশ মারা গেলে পরিবার বড় সংকটে পড়ে। কারণ তখন আনোয়ার হোসেনের বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর! বাবার মৃত্যুতে ব্যবসার দায়িত্ব নেওয়ার মতো কেউ ছিল না, ফলে ব্যবসা প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়।
পরিবারের আর্থিক অবস্থার অবনতি দেখে মাত্র ৮ বছর বয়সেই আনোয়ার হোসেন ব্যবসার হাল ধরেন। তখন অনেক বিশ্বস্ত কর্মচারীও প্রতারণা করে টাকা আত্মসাৎ করেছিল, ফলে তাকে শূন্য থেকে শুরু করতে হয়।
মাত্র ৩৬০ টাকা পুঁজি নিয়ে ১৯৫০-এর দশকে চকবাজারে ‘আনোয়ার ক্লথ স্টোর’ নামে নিজের প্রথম ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু এখানেই থেমে থাকেননি। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে মাত্র তিন বছরের মাথায়, মাত্র ১১ বছর বয়সেই, তার হাতে ছিল ১ লাখ টাকা!
১৯৫৩ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে তিনি আরও ছয়টি দোকান কিনে নেন এবং ব্যবসার পরিধি আরও বাড়িয়ে দেন। তখন থেকেই তার ব্যবসায়িক প্রতিভার পরিচয় মেলে।
আনোয়ার হোসেন শুধু ছোটখাট ব্যবসায় সীমাবদ্ধ থাকতে চাননি। তাই তিনি ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে ঢাকার বাইরেও ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে শুরু করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি প্রথম কারখানা কিনে ‘আনোয়ার সিল্ক মিলস’ প্রতিষ্ঠা করেন। তার ব্র্যান্ড ‘মালা শাড়ি’ রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যা তখনকার বাংলাদেশে প্রথম ব্র্যান্ডেড শাড়ি হিসেবে পরিচিতি পায়।
শাড়ির পাশাপাশি আনোয়ার হোসেন আরও একধাপ এগিয়ে বাংলাদেশের প্রথম বৈদ্যুতিক কেবল উৎপাদন কারখানা কিনে নেন। পাশাপাশি তিনি স্টিল মিল চালু করেন এবং দেশের প্রথম স্টেইনলেস স্টিল কাটলারি উৎপাদনকারী হয়ে ওঠেন।
কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তার ব্যবসার জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ (Challenge) নিয়ে আসে। যুদ্ধের সময় অনেক ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তার বেশ কিছু উদ্যোগও বাধার সম্মুখীন হয়।
যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে বাংলাদেশ পুনর্গঠনের সময় আনোয়ার হোসেন দেশের অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৮ সালে তিনি ‘খালেদ আয়রন অ্যান্ড স্টিলস লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ধাপে ধাপে আনোয়ার টেক্সটাইল, আনোয়ার স্টিল, আনোয়ার সিমেন্ট চালু করেন, যা বাংলাদেশের শিল্প খাতের ভিত্তি মজবুত করতে সাহায্য করে।
১৯৮০-এর দশকে তিনি উপলব্ধি করেন যে ব্যবসায়ীদের জন্য সরকারি ব্যাংকের জটিলতা কমানোর প্রয়োজন রয়েছে। তাই ১৯৮৩ সালে তিনি ‘দ্য সিটি ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এটি দেশের অন্যতম বৃহত্তম বেসরকারি ব্যাংকগুলোর একটি।
আনোয়ার হোসেনের বড় ছেলে মানোয়ার হোসেনের মতে, আনোয়ার হোসেনের সাফল্যের মূল রহস্য ছিল তার কঠোর পরিশ্রম এবং মায়ের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা। পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তিনি যে ধৈর্য ও একাগ্রতার পরিচয় দিয়েছেন, সেটাই তাকে বাংলাদেশের অন্যতম সফল উদ্যোক্তায় পরিণত করেছে।
আনোয়ার গ্রুপের যাত্রা শুধুই ব্যবসা সম্প্রসারণের গল্প নয়, বরং এটি একটি পরিবারের সংগ্রাম, পরিশ্রম ও দূরদর্শিতার প্রতিচ্ছবি। ছোট্ট এক দোকান থেকে শুরু হয়ে আজ দেশের অন্যতম বড় কংগ্লোমারেট হয়ে ওঠার পেছনে আনোয়ার হোসেনের মতো একজন দূরদর্শী নেতার অবদান অনস্বীকার্য।
যার ফলশ্রুতিতে, বর্তমানে আনোয়ার গ্রুপ বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ও সফল ব্যবসায়িক গ্রুপ হিসেবে পরিচিত। ২০টিরও বেশি কোম্পানি এবং ১৪,০০০ এরও বেশি কর্মী নিয়ে তাদের বিশাল সাম্রাজ্য এখন শুধুমাত্র দেশে নয়, বিদেশেও পরিচিত। আনোয়ার গ্রুপ বিভিন্ন খাতে তাদের ব্যবসা চালাচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে ভোক্তা পণ্য, রিয়েল এস্টেট, সিমেন্ট, টেক্সটাইল, স্টিল, এবং অটোমোটিভ প্রোডাক্টস।
গত কয়েক বছরে করোনাভাইরাস মহামারি, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট এবং দেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকটের কারণে ব্যবসার জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ এসেছে। তবে আনোয়ার গ্রুপ এইসব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ১৫-১৬% প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়, যা তাদের সাফল্যের কথাই নির্দেশ করে।তাদের মূল সাফল্য এসেছে টেক্সটাইল, সিমেন্ট শিট, পলিমার এবং কনস্ট্রাকশন সেক্টরে।
তবে, সিমেন্ট এবং স্টিল ব্যবসায় কিছুটা স্থবিরতা দেখা গেছে, যা মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতির কারণে।
আনোয়ার গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান মানোয়ার হোসেন, যিনি পুরো গ্রুপের কৌশলগত দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। তার সঙ্গে রয়েছেন ভাইস-চেয়ারম্যান হোসেন মাহমুদ এবং গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর হোসেন খালেদ, যারা ব্যবসার সম্প্রসারণ ও পরিচালনায় মূল ভূমিকা রাখছেন।
এছাড়া, এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হোসেন আখতার ও আনোয়ার টেকনোলজিসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ফুরকান হোসেন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের দিকটি তত্ত্বাবধান করছেন। পাশাপাশি, ইউসুফ আমান এজি অটোমোবাইলসের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
আনোয়ার গ্রুপের head office অবস্থিত ঢাকার মতিঝিল এলাকার বায়তুল হোসেন বিল্ডিংয়ে, যেখানে সমস্ত পরিচালনা কার্যক্রম চালানো হয়।
আনোয়ার গ্ৰুপের ভবিষ্যত পরিকল্পনা খুবই দূরদর্শী। যার প্রতিফলনে আনোয়ার গ্রুপ ডেনিম ও স্টিলসহ কয়েকটি নতুন প্রকল্পে কাজ শুরু করেছে। চেয়ারম্যান মানোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে এসব প্রকল্প সম্পন্ন হলে ৬,০০০-এর বেশি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
তিনি বলেন, ” ডেনিম খাতে ১,৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে, যার উৎপাদন শুরু হবে ২০২৫ সালে।”
মানোয়ার হোসেন আশা প্রকাশ করেন, ২০৩০ সালের মধ্যে আনোয়ার গ্রুপে কর্মী সংখ্যা ২৫,০০০ ছাড়িয়ে যাবে।
আনোয়ার গ্রুপ শুধু একটা কর্পোরেট ব্র্যান্ড নয়,এটা বাংলাদেশের শিল্প, বাণিজ্য এবং অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ। প্রায় দুই শতাব্দীর ঐতিহ্য আর দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে এই প্রতিষ্ঠান আজকের জায়গায় পৌঁছেছে। বৈশ্বিক সংকট, বাজারের চ্যালেঞ্জ, সবকিছু মোকাবিলা করেও তারা সামনে এগিয়ে চলেছে।
তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা দেখলেই বোঝা যায়, আনোয়ার গ্রুপ শুধু বর্তমানেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আগামী দশকের জন্য বড় বড় ভাবনা নিয়ে এগোচ্ছে।
আপনার মতামত কী? আনোয়ার গ্রুপের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি বাংলাদেশে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে? কমেন্টে জানাবেন আপনার মতামত! আসসালামুয়ালাইকুম!