২০০ বছরের সাম্রাজ্য কি ভাঙতে চলেছে? | ইস্পাহানি গ্রুপ | Ispahani Group | Business Mania
চা খেতে ভালোবাসেন? অথবা এক প্লেট মুড়ি চানাচুরের সাথে সন্ধ্যার আড্ডা? কিংবা সকালে ব্রেড, বিস্কুট? এগুলোর মধ্যে কিছু না কিছু নিশ্চয়ই আপনার প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় আছে। কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছেন, এসব পণ্যের পেছনে যে কোম্পানির নাম সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে, সেটি কী?
বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো এবং সুপ্রতিষ্ঠিত গ্রুপ ইস্পাহানি গ্ৰুপ ! প্রায় দুই শতকের পুরোনো এই প্রতিষ্ঠান শুধু চায়ের ব্যবসা নিয়েই নয়, ব্যবসাকে বিস্তৃত করেছে খাদ্যপণ্য, টেক্সটাইল, শিক্ষা ও সমাজসেবামূলক বিভিন্ন খাতে । ‘ইস্পাহানি মির্জাপুর চা’ তো প্রায় প্রতিটি ঘরেই পাওয়া যায়। কিন্তু শুধু চা-ই নয়, বিস্কুট, চানাচুর, নুডলস থেকে শুরু করে নানা ধরনের ভোগপণ্যেও ইস্পাহানির বিশাল দাপট। তবে এখানেই কি শেষ? না, এই কোম্পানি টেক্সটাইল, শিপিং, রিয়েল এস্টেট, এমনকি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতেও রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
তবে এত সফলতার পেছনে আছে দীর্ঘ ইতিহাস, কৌশলী ব্যবসায়িক পরিকল্পনা এবং কিছু বিতর্কও। কীভাবে পারস্যের এক ব্যবসায়ী পরিবার ব্রিটিশ আমলে এসে ব্যবসা শুরু করে এবং ধীরে ধীরে বাংলাদেশের অন্যতম ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যে পরিণত হয়? কীভাবে তারা দীর্ঘকাল ধরে বাজারে টিকে রয়েছে?
তাই Business Maniar আজকের আলোচনায় ইস্পাহানি গ্রুপের উত্থান, বর্তমান বাজার প্রভাব, এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার গল্প নিয়ে।
ইস্পাহানি গ্রুপের যাত্রা শুরু হয় ১৮২০ সালে হাজী মোহাম্মদ হাশেম ইরানের হাত ধরে। তিনি ইসফাহান থেকে ভারতের বর্তমান মুম্বাইয়ে আসেন ব্যবসার উদ্দেশ্যে । পরবর্তীতে, তার বংশধররা ব্যবসা সম্প্রসারণ করে কলকাতা, মাদ্রাজ এবং বার্মা পর্যন্ত বিস্তৃত করে।
মির্জা মোহাম্মদ ইস্পাহানি ১৯০০ সালে কলকাতায় এম এম ইস্পাহানি অ্যান্ড সন্স প্রতিষ্ঠা করেন এবং একই বছরে লন্ডনে একটি শাখা অফিস খোলেন। তার পুত্র মির্জা আহমদ ইস্পাহানি ১৯১৮ সালে পার্টনারশিপে যোগ দেন এবং ১৯৩৪ সালে তার দুই ভাই মির্জা আবুল হাসান ইস্পাহানি ও মির্জা মাহমুদ ইস্পাহানির সাথে মিলে এম এম ইস্পাহানি লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন। বলা যায় পুরো ইস্পাহানি পরিবারই এর সাথে যুক্ত ছিল।
ভারত বিভাগের পর, ১৯৪৭ সালে কোম্পানিটির সদর দপ্তর চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত হয়। এই সময়ে, ইস্পাহানি গ্রুপ চা, পাট, টেক্সটাইল, জাহাজ চলাচল এবং অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ শুরু করে।
মির্জা আহমদ ইস্পাহানির পুত্র মির্জা মেহেদী ইস্পাহানি ১৯৪৯ সালে কোম্পানির চেয়ারম্যান হন এবং ২০০৪ সাল পর্যন্ত এই পদে ছিলেন। তার নেতৃত্বে, ইস্পাহানি গ্রুপ চা শিল্পে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে এবং অন্যান্য খাতেও ব্যবসা সম্প্রসারণ করে।
বর্তমানে, ইস্পাহানি গ্রুপ চা, খাদ্য, টেক্সটাইল, পাট, রিয়েল এস্টেট, পোল্ট্রি এবং শিপিং সহ বিভিন্ন খাতে কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং প্রায় ১০,০০০ কর্মী এই গ্ৰুপের অধীনে কর্মরত রয়েছে । দীর্ঘ এই যাত্রায়, ইস্পাহানি গ্রুপ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ইস্পাহানি গ্রুপের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদে মির্জা সালমান ইস্পাহানি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানটি সাফল্যের সাথে পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া, ইরাজ ইস্পাহানি লন্ডনভিত্তিক ইস্পাহানি অ্যাডভাইজরি লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী এবং এম এম ইস্পাহানি লিমিটেডের পরিচালক ও পর্ষদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ইস্পাহানি গ্রুপের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও ভিশন প্রতিষ্ঠানটির দীর্ঘমেয়াদী সাফল্য ও সম্প্রসারণের উপর ভিত্তি করে গঠিত। তারা বিভিন্ন খাতে তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত করার পাশাপাশি, টেকসই উন্নয়ন ও সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতিও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সম্প্রতি, ইস্পাহানি গ্রুপ এবং এবিসি লিমিটেডের মধ্যে একটি যৌথ আবাসন প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। “দ্য অর্চার্ড অ্যাট ইস্পাহানি কলোনি” নামের এই প্রকল্পটি আধুনিক নগর জীবনের চাহিদা ও সবুজ পরিবেশকে বিবেচনায় রেখে নকশা করা হয়েছে।
এছাড়া, শ্রমিক ও পরিবেশবান্ধব কর্মপরিবেশ নিশ্চিতের স্বীকৃতি হিসেবে ইস্পাহানি গ্রুপের ৩টি চা-বাগান ও ১টি রপ্তানিমুখী টেক্সটাইল মিল ২০২৪ সালে গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড পর্যন্ত লাভ করে ।
পাশাপাশি,১৯৪৬ সালে মির্জা আহমদ ইস্পাহানি ও আদমজি হাজী দাউদ কলকাতায় ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স (পিআইএ) এর সাথে একীভূত হয়।
মির্জা আহমদ ইস্পাহানি ঢাকায় ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল নামে একটি চক্ষু হাসপাতালও প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান চক্ষু হাসপাতাল।
ইস্পাহানি গ্রুপ বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও সুপ্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপরিচিত। তবে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন challenge এর মুখোমুখি হতে হয়েছে ।
ইস্পাহানি গ্রুপের চা পণ্য বাংলাদেশের বাজারে অত্যন্ত জনপ্রিয়। ফলশ্রুতিতে চা পণ্যের সরবরাহের চাহিদা মেটানো কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এ ধরনের সরবরাহ সংকটের পেছনে উৎপাদন সমস্যার পাশাপাশি সরবরাহ চেইনে জটিলতা এবং পরিবহনজনিত বাধা থাকতে পারে। যদিও প্রতিষ্ঠানটি এই সমস্যাগুলো সমাধানে পদক্ষেপ নিয়েছে ।
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা এবং স্থানীয় বাজারের প্রতিযোগিতা তো আছেই, বিশেষ করে, চা শিল্পে আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্য হ্রাস এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির ফলে তাদের লাভের পরিমাণও কমে গিয়েছে।
আর এতো বাধা মোকাবেলা করেই ইস্পাহানি গ্রুপ বাংলাদেশের ব্যবসায়িক জগতে তাদের শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। তারা প্রতিনিয়ত নিজেদের উন্নত করতে এবং ভোক্তাদের সন্তুষ্টি অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ইস্পাহানি গ্রুপের যাত্রা শুরু হয় ব্রিটিশ আমলে, আর ধাপে ধাপে তারা আজ বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ও সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। চা শিল্প থেকে শুরু করে আবাসন, টেক্সটাইল, খাদ্যপণ্যসহ বিভিন্ন খাতে তাদের প্রভাব সুস্পষ্ট। দীর্ঘ ইতিহাস, বাজারে আধিপত্য, ব্যবসায়িক নীতিমালা, এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার মাধ্যমে তারা নিজেদের শক্ত অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
আপনার মতামত কী? আপনার কি মনে হয় ইস্পাহানি গ্রুপ তাদের আধিপত্য ধরে রাখতে পারবে? নাকি নতুন প্রতিযোগীরা তাদের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে? কমেন্টে জানাবেন আপনার মতামত!