৩ হাজার টাকার চাকরি থেকে ৩,৭০০ কোটি টাকার জালিয়াতি! | হলমার্ক কেলেঙ্কারি | Business Mania
হলমার্ক গ্রুপ, দেশের ব্যাংকিং খাতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারির প্রতীক। ২০১২ সালে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে প্রায় ৩,৭০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ ও চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।
তদন্তে উঠে আসে, ভুয়া প্রতিষ্ঠান ও নথিপত্রের মাধ্যমে এই অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছিল। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে ২০২৪ সালের মার্চ মাসে আদালত তানভীর মাহমুদ, জেসমিন ইসলামসহ নয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অন্যান্য আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করেন।
এই ঘটনা দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুর্বলতা ও নজরদারির অভাবকে স্পষ্ট করে তুলে । আজকের business Maniar আলোচনায় থাকছে হলমার্ক কেলেঙ্কারির বিস্তারিত বিশ্লেষণ এবং কিভাবে এটিই হয়ে উঠে দেশের সবচেয়ে বড় স্ক্যাম গুলোর একটি।
তানভীর মাহমুদ,একজন সাধারণ দোকানি থেকে হাজার কোটি টাকার সাম্রাজ্যের মালিক হন। রাজধানীর আগারগাঁও তালতলা বাজারে একটি ছোট মুদি দোকান চালাতেন তিনি। তবে পারিবারিক আর্থিক সংকটের কারণে মাত্র তিন হাজার টাকা বেতনের একটি গার্মেন্টস চাকরি নিতে বাধ্য হন। গার্মেন্টস ব্যবসা সম্পর্কে ধারণা নিয়ে ২০০৬ সালে সোনালী ব্যাংক রূপসী বাংলা হোটেল শাখা থেকে ঋণ নিয়ে শুরু করেন নিজের পোশাক কারখানা। ধীরে ধীরে, সাভারে গড়ে তোলেন ৪০টি কারখানা, ব্যক্তিগত সম্পদ দাঁড়ায় ৩,০০০ কোটি টাকা, মিরপুরে বিলাসবহুল বাড়ি ও ২৭টি গাড়ির মালিক হন।
গার্মেন্টস ব্যবসার কারণে প্রায়শই সোনালী ব্যাংক রূপসী বাংলা হোটেল শাখায় যাতায়াত করতেন তানভীর। সেখানেই ব্যাংকের তৎকালীন শাখা ব্যবস্থাপক এ কে এম আজিজুর রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এরপর ২০০৮ সাল থেকে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দামি দামি উপহার দিয়ে নেটওয়ার্ক তৈরি করতে থাকেন। সূত্র অনুসারে, তানভীর মাহমুদ ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের ৩০টিরও বেশি বিলাসবহুল গাড়ি উপহার দেন।
২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে হলমার্ক গ্রুপে আরও পাঁচটি প্রতিষ্ঠান ভুয়া নথি ব্যবহার করে সোনালী ব্যাংক থেকে ৩,৫৪৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। একমাত্র হলমার্ক গ্রুপই নেয় ২,৬৮৬ কোটি টাকা, বাকি টাকা পারাগন গ্রুপ , টি অ্যান্ড বি ব্রাদার্স , নকশী , ডিএন স্পোর্টস , ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান আত্মসাৎ করে।
প্রতারণার মূল অস্ত্র ছিল ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ট্রেডের লেটার অব ক্রেডিট , ,LC পদ্ধতি। ২০১২ সালের ২৮ মার্চ, আজিজুর রহমানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে, হলমার্ক গ্রুপ আনোয়ার স্পিনিং মিলস, ম্যাক্স স্পিনিং মিলস ও স্টার স্পিনিং মিলসের নামে ৫০০ কোটি টাকার এলসি খোলে। আশ্চর্যের বিষয়, এই প্রতিষ্ঠানগুলিও একই ব্যাংক শাখার গ্রাহক ছিল। ব্যাংক একই দিনে এলসির পুরো অর্থ প্রদান করে এবং ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর অ্যাকাউন্টে জমা করে।
কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই পুরো অর্থ স্থানান্তর করা হয় হলমার্ক গ্রুপের অ্যাকাউন্টে, এবং সেখান থেকে “সেঞ্চুরি ইন্টারন্যাশনাল” নামের আরেকটি অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে তদন্তে উঠে আসে, আনোয়ার স্পিনিং মিলস, ম্যাক্স স্পিনিং মিলস, স্টার স্পিনিং মিলস এবং সেঞ্চুরি ইন্টারন্যাশনাল নামে কোনো প্রতিষ্ঠান আদৌ ছিল না। এগুলো ছিল সম্পূর্ণ কাল্পনিক নাম। ব্যাংকে দাখিল করা নথিও জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছিল।
সোনালী ব্যাংকের নিজস্ব অডিট রিপোর্টে দেখা যায়, হলমার্ক গ্রুপ মোট ৪২টি প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলন করেছিল, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪-তে। সোনালী ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে কমপক্ষে ২০টি প্রতিষ্ঠানকে নিশ্চিতভাবে ভুয়া বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে, এই কেলেঙ্কারির বেশি দিন চালিয়ে যেতে পারে নি তারা।
বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বড় এই আর্থিক কেলেঙ্কারিতে, সোনালী ব্যাংক ঋণ জালিয়াতি মামলায় আদালতের রায় ঘোষণা করা হয়। ১২ বছর পর এই মামলায় হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ, তাঁর স্ত্রী ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামসহ ৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১ এর বিচারক আবুল কাসেম।
রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন তানভীর মাহমুদ। হুইলচেয়ারে বসা এই শিল্পপতি রায়ের ঘোষণা শোনার পর দীর্ঘ ৩০ মিনিট মাথা নিচু করে নিস্তব্ধ ছিলেন। তাঁর স্ত্রী জেসমিন ইসলামও ছিলেন হতবিহ্বল। তবে রায় ঘোষণার পর আদালত থেকে পালিয়ে যান এ মামলার অন্যতম আসামি, সাভারের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. জামাল উদ্দিন সরকার। তিনি আদালতে উপস্থিত থাকলেও রায় ঘোষণার পর দ্রুত কৌশলে পালিয়ে যান ।
এই মামলায় শুধু হলমার্ক গ্রুপের কর্মকর্তারাই নয়, সোনালী ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও শাস্তি পেয়েছেন। ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবিরসহ আরও সাতজনকে ১৭ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
২০১২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে উঠে আসে, সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখা থেকে হলমার্ক গ্রুপ ভুয়া নথিপত্র ব্যবহার করে ২,৬৮৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। এই জালিয়াতির সঙ্গে ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সরাসরি জড়িত ছিলেন। তদন্তের ভিত্তিতে ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর দুদক রমনা থানায় মামলা করে এবং ২০১৩ সালে ২৬ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট (charge sheet) দেয়।
রায়ে আদালত বলেন, হলমার্ক গ্রুপের এই প্রতারণা কেবল একটি ব্যাংক জালিয়াতি নয়, এটি দেশের আর্থিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র। তিনি আরও উল্লেখ করেন, “যারা জনগণের আমানত লুট করে, তাদের মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আইনের সর্বোচ্চ সীমা হওয়ায় তাঁদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো।”
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তানভীর দাবি করেন, “আমি কোনো টাকা আত্মসাৎ করিনি।”
তবে আদালতের পর্যবেক্ষণ স্পষ্ট করেছে, এই দুর্নীতির সঙ্গে তানভীর মাহমুদ ও তাঁর সহযোগীদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল।
হলমার্ক কেলেঙ্কারির এই রায় দেশের অর্থনৈতিক অপরাধ দমনে গুরুত্বপূর্ণ এক নজির হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে জামাল উদ্দিন সরকারের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠে।
বিলম্বে হলেও অপরাধীরা শাস্তি পেয়েছেন।
হলমার্ক কেলেঙ্কারির হোতাদের বিচার আর্থিক খাতে দুর্নীতি কমাবে কি না, সেটা নির্ভর করছে সরকারের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। ব্যাংকিং খাতে যদি একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারি ঘটতে থাকে, তাহলে দু একটি ঘটনার বিচার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাবে না।
হলমার্ক কেলেঙ্কারি বাংলাদেশের আর্থিক খাতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলেও একমাত্র নয়। হলমার্কের আগে ও পরে আরও অনেক ঋণ–কেলেঙ্কারি ঘটেছে। বিশেষ করে আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু চেয়ারম্যান থাকতে বেসিক ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হলেও তাঁর বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এখন প্রশ্ন হলো, এত বছর পরেও আসলে কী বিচার হয়েছে?
হলমার্ক গ্রুপের এমডি তানভীর মাহমুদ গ্রেপ্তার হলেও, এই কেলেঙ্কারির মূল হোতারা কি সত্যিই শাস্তি পেয়েছে? সাম্প্রতিক কালে এসকে সুর চৌধুরীর গ্রেপ্তার, লকার থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধারের ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে, দুর্নীতির শেকড় অনেক গভীরে। কিন্তু আমরা কি নিশ্চিত যে, এই ধরনের আরও অনেকেই এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে নেই?
হলমার্ক কেলেঙ্কারি আমাদের জন্য একটা শিক্ষা হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, একটার পর একটা দুর্নীতির ঘটনা ঘটে, কিছুদিন আলোচনা হয়, কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়, কিন্তু পরে বিষয়টি চাপা পড়ে যায়।
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সুরক্ষিত করতে হলে, এ ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। আপনার মতামত কী? আপনি কি মনে করেন, এই কেলেঙ্কারির আসল হোতারা শাস্তি পাবে? নাকি এটি আরও একটি ভুলে যাওয়ার মতো ঘটনা হয়ে থাকবে?কমেন্টে আপনদের মতামত অবশ্যই জানান!