অ্যাপেক্স: ৪০ বছরের সাফল্যের আড়ালে লুকানো সংগ্রাম! | Apex Footwear Limited | Business Mania
বাংলাদেশের জুতা শিল্পের শীর্ষে দাঁড়িয়ে থাকা এক উজ্জ্বল নাম অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড (Apex Footwear Limited)।
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় জুতোপ্রস্তুতকারক, বিক্রেতা এবং রপ্তানিকারক।
সময়ের সাথে সাথে মানুষের ফ্যাশন সচেতনতা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে প্রয়োজনের সাথে মিশে থাকা গুণগত মানের জুতার চাহিদা। ঠিক এ জায়গায় এপেক্স নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে একটি নির্ভরযোগ্য ব্র্যান্ড হিসেবে।
১৯৯০-এর দশকে যখন বাংলাদেশের জুতা বাজার আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে শুরু করে, এপেক্স সেই সময় থেকেই দেশের মাটিতে আধুনিক ও সৃজনশীল ডিজাইন নিয়ে হাজির হয়। শুধু দেশেই নয়, এপেক্সের রপ্তানিযোগ্য পণ্য আজ পৌঁছে গেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে।
তাদের বিস্তৃত পণ্যের ভাণ্ডারে যেমন সাধারণ মানুষের জন্য রয়েছে প্রতিদিনের জুতা, তেমনি আছে প্রিমিয়াম কোয়ালিটির লাক্সারি কালেকশন।
বিজনেস ম্যানিয়ায় আজ আমরা জানব অ্যাপেক্স ব্র্যান্ডের শুরু থেকে সফলতার গল্প, ব্যবসায়িক কৌশল এবং কীভাবে এপেক্স দেশের ফ্যাশন জগতকে প্রভাবিত করেছে এবং কীভাবে এটি হয়ে উঠে বিশ্বের অন্যতম ফুটওয়্যার ব্র্যান্ড ।
এপেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী ছিলেন এক অভিজাত পরিবার এর সন্তান ছিলেন । তিনি ভারতের কলকাতায় বেড়ে উঠেন, যেখানে তার বাবা ছিলেন উচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি এবং নাইট উপাধি প্রাপ্ত। ১৯৬২ সালে এলাহী ঢাকায় অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। দু’বছর পরে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে করাচিতে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোতে যোগ দেন।
তবে এলাহী সবসময় নিজের ব্যবসা শুরু করার স্বপ্ন দেখতেন। ফ্রান্সের এক ব্যবসায়ীর সাথে একটি আকস্মিক সাক্ষাৎ, যিনি ঢাকার বিখ্যাত “বেঙ্গল ব্ল্যাক কিড” চামড়া সংগ্রহ করতেন । ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই, নিজের ৩০তম জন্মদিনে, তিনি স্থায়ী চাকরি ছেড়ে ফ্রেঞ্চ প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন।
বাংলাদেশে লেদার ইন্ডাস্ট্রি এক বড় রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। তৎকালীন সরকার চামড়া শিল্পকে রাষ্ট্রায়ত্ত করেছিল। পরে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এই খাত বেসরকারি মালিকানায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এই সুযোগেই মঞ্জুর এলাহী একটি বড় সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭৫ সালে, বাংলাদেশের সরকার জাতীয়করণকৃত ট্যানারি বেসরকারি খাতে ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে, এলাহী “ওরিয়েন্ট ট্যানারি” কিনে নেন। এটি ছিল তখন প্রায় দেউলিয়া হওয়া এক প্রতিষ্ঠান। ১.২২ মিলিয়ন টাকা দিয়ে এটি কেনার পর, তিনি এর নাম পরিবর্তন করে রাখেন “এপেক্স ট্যানারি,” যা তার সফলতার শীর্ষে পৌঁছানোর স্বপ্নের প্রতিফলন। উল্লেখ্য তখনকার ১.২২ মিলিয়ন টাকা সেই সময়ে প্রায় ১লাখ ইউএস ডলার এর সমান ছিল।
১৯৮২ সালে এপেক্স ট্যানারি শেয়ারবাজারে অন্তর্ভুক্ত হয়, যেখানে এলাহী উন্নতমানের চামড়া উৎপাদনের লক্ষ্যে ইতালির প্রযুক্তি ও মেশিন আমদানি করেন।
আর এরপরই আসে তাদের বর্তমান সফলতার চূড়ান্ত ধাপ, প্রতিষ্ঠিত হয় এপেক্স ফুটওয়্যার।
১৯৯০ সালে এপেক্স ফুটওয়্যার প্রতিষ্ঠা করে তারা সরাসরি জুতা উৎপাদনে প্রবেশ করে। শুরুতে তারা জার্মানি থেকে মেশিন ও ডিজাইন এনে ইউরোপের জন্য জুতা তৈরি করে। মান ও উৎপাদন দক্ষতার অভাবে তারা প্রথমদিকে সমস্যার মুখোমুখি হয়। কিন্তু আমেরিকার এক আন্তর্জাতিক সংস্থা International Executive Service Corps এর সহায়তায়, মানোন্নয়ন এবং উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে সক্ষম হয়।
১৯৯৩ সালে এপেক্স ফুটওয়্যার পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৯৬ সালে ইতালির এক সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তির মাধ্যমে তাদের উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ করে।
আস্তে আস্তে এপেক্স তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরির দিকে মনোনিবেশ করে।
আজ এপেক্স শুধুমাত্র বাংলাদেশের বৃহত্তম জুতা বিক্রেতা নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাজারেও একটি সম্মানজনক নাম।
শুরুর বছরগুলো ছিল অত্যন্ত কঠিন। প্রায় সাত থেকে আট বছর মঞ্জুর এলাহীকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয় ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। তার মতে, “যদি কেউ সৎভাবে ব্যবসা করতে চায়, তাহলে তাকে পরিশ্রম করতে হবে।”
এই ধাপে ধাপে সংগ্রাম এবং ঝুঁকির ফলেই অ্যাপেক্স গ্রুপ বাংলাদেশের অন্যতম বড় ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যে পরিণত হয়, যা শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও প্রশংসিত।
বর্তমানে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার বাংলাদেশের বৃহত্তম জুতা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি, যা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে সমানভাবে সমাদৃত।
যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ১৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা মুনাফা লাভ করে , যা গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগের বছর মুনাফা ছিল ১৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা, অর্থাৎ মুনাফা বাড়ে প্রায় ৫.৫৬%।
অ্যাপেক্সের এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে তাদের মানসম্মত পণ্য ও সেবার প্রতিশ্রুতি। ঢাকার বসুন্ধরা সিটি শপিং মলে ২২,৫০০ বর্গফুট আয়তনের দেশের সবচেয়ে বড় ফুটওয়্যার স্টোর উদ্বোধন করে তারা তাদের বাজারে শক্ত অবস্থানকে প্রতিফলিত করে।
বহুজাতিক কোম্পানি বাটা অ্যাপেক্সের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাটা লোকসানের সম্মুখীন হলেও অ্যাপেক্স মুনাফা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে, যা দেশীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন।
অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের এই সাফল্য ও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ক্ষমতা প্রমাণ করে যে, সঠিক পরিকল্পনা ও মানসম্মত পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানও আন্তর্জাতিক মানের প্রতিযোগিতায় সফল হতে পারে।
অ্যাপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী মনে করেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সামাজিক কল্যাণে অবদান রাখার সেরা উপায় হলো ব্যবসায় বিনিয়োগ। তার মতে, “যদি কেউ একটি পরিবারের কিংবা পুরো দেশের অর্থনীতি পরিবর্তন করতে চায়, তাহলে তাকে উদ্যোক্তা হতে হবে।”
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর এই দর্শন শুধুমাত্র তার নিজের জীবনের গল্প নয়, বরং এটি হাজারো তরুণ উদ্যোক্তার জন্য একটি অনুপ্রেরণা। তিনি দেখিয়েছেন যে, সৎ মানসিকতা, কঠোর পরিশ্রম এবং সঠিক পরিকল্পনা থাকলে ব্যবসা শুধু ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, বরং পুরো সমাজের উন্নয়নের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।
তার বিশ্বাস, উদ্যোক্তা মানে শুধু নিজের জন্য লাভ তৈরি করা নয়। উদ্যোক্তা মানে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান, তাদের জীবনে পরিবর্তন আনা এবং একটি দেশের অর্থনীতির ভিতকে শক্তিশালী করা। এই চেতনা থেকে তিনি অ্যাপেক্স গ্রুপকে এমন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন, যা শুধু ব্যবসায়িক সাফল্য নয়, বরং দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে
প্রতিষ্ঠার প্রাক-ইতিহাস থেকে শুরু করে ব্যবসার যাত্রার প্রতিটি ধাপই উদাহরণস্বরূপ। ট্যানারি কেনা থেকে শুরু করে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে অবস্থান শক্তিশালী করা, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার এর সাফল্যের এক একটি ধাপ মাত্র ।
অ্যাপেক্সের সাফল্য যেখানে অনুপ্রেরণা জোগায়, সেখানে তাদের প্রতিযোগিতা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তরুণ উদ্যোক্তাদের শেখায় কীভাবে বাজারের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে হয়।
অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার এর সাফল্য ও দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় জুতো রপ্তানিকারক হয়ে ওঠার গল্প ভালো লেগে থাকলে শেয়ার করতে ভুলবেন না। আপনার মূল্যবান মতামত এবং ভবিষ্যতে আরও কোন কোন দেশী-বিদেশী কোম্পানি গুলোর সাফল্যের গল্প শুনতে চান তা কমেন্টে অবশ্যই জানাবেন, ধন্যবাদ।