ভাই বন্ধু চক্র ভয়াবহ দুর্নীতির বিষবৃক্ষ | HAMID GROUP | Business Mania
দেশের অর্থনৈতিক বিকাশে অবদান রাখা অসংখ্য কোম্পানির মধ্যে হামিদ গ্রুপ একটি ব্যতিক্রমী নাম। এই গ্রুপের সূচনা হয় এক সংকল্প ও স্বপ্নের মাধ্যমে, যা পরবর্তীতে হয়ে ওঠে শিল্প ও ব্যবসার এক অদম্য শক্তি। তবে, প্রতিটি সাফল্যের পেছনে যেমন থাকে নিরলস প্রচেষ্টা, তেমনি থাকে কিছু প্রশ্নবিদ্ধ অধ্যায়ও । বাংলাদেশের শিল্প ইতিহাসে হামিদ গ্রুপের উত্থান যেমন চমকপ্রদ, তেমনই রয়েছে কিছু বিতর্ক।আজকের আলোচনায় আমরা জানবো এই গ্রুপের শুরুর দিনগুলোর কথা, সাফল্যের গল্প, এবং সেই সব ঘটনা যা হামিদ গ্রুপকে পরিণত করেছে আজকের অবস্থানে।
১৯৫৮ সালে এই গ্রুপের যাত্রা শুরু হয় “ইনল্যান্ড সাপ্লাই অ্যান্ড কোম্পানি” প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কয়লার বিশাল চাহিদা পূরণে প্রতিষ্ঠানটি দ্রুত সফলতা অর্জন করে এবং পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় কয়লা সরবরাহকারী হিসেবে পরিচিত হয়। ১৯৬২ সালে, হামিদ গ্রুপ গড়ে তোলে “GWC ব্রিকস”। এটি সেই সময়ের সবচেয়ে আধুনিক ইট তৈরির কারখানা ছিল, যা দেশের নির্মাণ শিল্পে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। তবে, হামিদ গ্রুপের দৃষ্টি কেবল এক শিল্পে সীমাবদ্ধ ছিল না। ১৯৬৪ সালে তারা “গ্রিন ওয়েজ কর্পোরেশন” প্রতিষ্ঠা করে বরফ উৎপাদন ও কোল্ড স্টোরেজ খাতে প্রবেশ করে।
১৯৮৯ সালে হামিদ গ্রুপ নির্মাণ শিল্পে আরও বড় পরিসরে প্রবেশ করে “হামিদ কনস্ট্রাকশন লিমিটেড” প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। পরের বছর, ১৯৯০ সালে, “হামিদ রিয়েল এস্টেট কনস্ট্রাকশন লিমিটেড” চালু হয়। এই প্রতিষ্ঠানের “প্রিয় প্রাঙ্গন” ব্র্যান্ড দ্রুত বিলাসবহুল আবাসন প্রকল্পের প্রতীক হয়ে ওঠে। আধুনিক ডিজাইন, নান্দনিকতা এবং উচ্চমানের জীবনযাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে “প্রিয় প্রাঙ্গন” দেশীয় রিয়েল এস্টেট খাতে এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করে।
হামিদ গ্রুপের সবচেয়ে বড় অগ্রগতি আসে ১৯৯১ সালে, যখন তারা গার্মেন্টস শিল্পে প্রবেশ করে। ফতুল্লাহ, নারায়ণগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত “হামিদ ফ্যাশন লিমিটেড” ছিল বাংলাদেশের প্রথম রপ্তানিমুখী সোয়েটার কারখানা। এ প্রতিষ্ঠানটি দ্রুতই আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে। ২০০০ সালে “হামিদ সোয়েটার লিমিটেড” এর মাধ্যমে এই খাতের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো হয়। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করে তারা বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে এক নতুন মাত্রা যোগ করে।
হামিদ গ্রুপ ২০০৪ সালে পোশাক সরবরাহ প্রতিষ্ঠান “হামিদ সোর্সিং লিমিটেড” এবং ২০১০ সালে আসবাবপত্রের শোরুম “কিউব” চালু করে।
পরবর্তীতে তারা “প্রিয় প্রাঙ্গন সিটি” নামে ২৩৫ একরের একটি আধুনিক আবাসিক প্রকল্প শুরু করে। এটি ছিল ভূমি উন্নয়ন খাতের প্রথম বড় প্রকল্প।
২০১৪ এবং ২০১৬ সালে হামিদ গ্রুপ আন্তর্জাতিক আসবাব ব্র্যান্ড “ক্যামেরিচ” এবং “ইউরো” এর শোরুম চালু করে। বারিধারার হলিউড টাওয়ারে তাদের শোরুম গ্রুপটির আধুনিক চিন্তাধারা এবং উচ্চমানের জীবনযাপনের প্রতিশ্রুতিকে তুলে ধরে।
এই দীর্ঘ ইতিহাস কেবল হামিদ গ্রুপের সাফল্যের নয়, বরং এটি বাংলাদেশের শিল্প ও অর্থনীতির অগ্রগতির প্রতিচ্ছবি।
বাংলাদেশের এই প্রভাবশালী পারিবারিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, এর পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি। গ্রুপটির মালিক নসরুল হামিদ, যিনি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করার আগে গ্রুপের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।
তার ছোট ভাই, ইন্তেখাবুল হামিদ, বর্তমানে হামিদ গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া, পরিচালনা পরিষদে রয়েছেন তাদের মামা মো. কামরুজ্জামান চৌধুরী, যিনি পাওয়ারকোর জয়েন্ট রেজিস্ট্রার পদে আছেন। নসরুল হামিদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু নাবিল খানও একই পদে রয়েছেন।
হামিদ গ্রুপের বর্তমান সিইও হচ্ছেন মো. মুরাদ হাসান, যিনি ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে পাওয়ারকোতে পার্টনার হিসেবে যুক্ত হন।
হামিদ গ্রুপ শুরু থেকেই বিভিন্ন খাতে নিজেদের কার্যক্রম বিস্তার করেছে, যার মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন, রিয়েল এস্টেট, গার্মেন্টস, ফার্নিচার, আইস প্ল্যান্ট, এবং হোম ডেকোর। আজকের দিনে, হামিদ গ্রুপের বিভিন্ন শাখা তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে গার্মেন্টস রপ্তানি, প্রতিটি শাখায় গ্রুপটির বিশাল প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যণীয়।
গ্রুপটির মূল আয়ের উৎস হচ্ছে গার্মেন্টস এবং রিয়েল এস্টেট। হামিদ ফ্যাশন এবং হামিদ সোয়েটার লিমিটেডের মাধ্যমে গ্রুপটি আন্তর্জাতিক বাজারে গার্মেন্টস রপ্তানি করে বছরে কোটি কোটি টাকা আয় করে। এছাড়া, হামিদ রিয়েল এস্টেট কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের মাধ্যমে আবাসন প্রকল্প, অফিস স্পেস এবং বাণিজ্যিক জমির উন্নয়নেও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।
অন্যদিকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই গ্রুপের শাখাগুলোর মধ্যে কিছু অস্বচ্ছতা এবং দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, যা তাদের ব্যবসায়িক শাখাগুলোর পরিবেশকে কিছুটা ম্লান করেছে। তবুও, হামিদ গ্রুপের শক্তিশালী ব্যবসায়িক অবস্থান এবং তার বিস্তৃত ব্যবসায়িক শাখা আগামী দিনে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে সহায়ক হবে।
হামিদ গ্রুপ, বাংলাদেশের বৃহত্তম এবং প্রভাবশালী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি, প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানা ধরনের সাফল্য অর্জন করেছে। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন বিতর্ক এবং অভিযোগ গ্রুপটির সুনামকে ক্ষুণ্ণ করেছে। নসরুল হামিদ, যিনি বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে কাজ করছেন, গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নেতা। তাঁর নেতৃত্বে গ্রুপটি দেশের বিভিন্ন খাতে অবদান রাখলেও, তাঁর নামও নানা দুর্নীতির অভিযোগে জড়িত.
বিশেষত নসরুল হামিদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও পদমর্যাদা হামিদ গ্রুপের ওপর গভীর ছাপ ফেলেছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে তার অবস্থান গ্রুপটির বিভিন্ন খাতে অনৈতিক সুবিধা এনে দিয়েছে বলেই অনেকের অভিযোগ। এ ঘটনাগুলো কেবল গ্রুপটির সুনাম নষ্ট করেনি, বরং নসরুল হামিদের রাজনৈতিক ভাবমূর্তিকেও কালিমালিপ্ত করেছে।
নসরুল হামিদের রাজনীতিতে প্রবেশের পর হামিদ গ্রুপে তার প্রভাব বৃদ্ধি পায়। অভিযোগ রয়েছে, তার পদ ব্যবহার করে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে হামিদ গ্রুপকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তবে এসব প্রকল্পে স্বচ্ছতার অভাব এবং নিম্নমানের কাজের কারণে জনগণের ক্ষোভ বেড়েছে। বিদ্যুৎ খাতে তার অধীনস্থ প্রকল্পগুলোতে বারবার অনিয়ম এবং ব্যয় বৃদ্ধির অভিযোগ ওঠায় এই খাতটি নৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
নসরুল হামিদের ক্ষমতা-নির্ভর পরিচালনা কৌশল এবং তার পরিবারিক ব্যবসার প্রতি অগ্রাধিকারের অভিযোগগুলো হামিদ গ্রুপের কর্মীদের মধ্যেও অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। তার নেতৃত্বে নেওয়া কিছু সিদ্ধান্ত কেবল গ্রুপটির সুনাম নষ্ট করেনি, বরং দেশের কর্পোরেট খাতেও অনাস্থার পরিবেশ তৈরি করেছে।
বিশেষভাবে, হামিদ গ্রুপের বিভিন্ন প্রকল্প, বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও নির্মাণ খাতে, ব্যাপক আকারে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ২০২০ সালে, ইন্তেখাবুল হামিদ, গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, তাঁর নেতৃত্বে একাধিক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতে কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প জিতেছিলেন। এসব প্রকল্পে গ্রুপটির সংশ্লিষ্টতা নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে, বিশেষত পাওয়ারকো ও অন্যান্য বিদ্যুৎ সংস্থার সঙ্গে জড়িত কাজগুলোকে কেন্দ্র করে।
এছাড়া, হামিদ গ্রুপের অন্যান্য ব্যবসায়িক শাখাতেও শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শুটিং ফেডারেশন ও ক্রীড়া সংস্থাগুলোর সঙ্গে গ্রুপটির সম্পর্কও অনেক সময় বিতর্কিত হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ইন্তেখাবুল হামিদ শুটিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তার নেতৃত্বে নানা অভিযোগ ওঠে, যেমন স্বেচ্ছাচারিতা এবং অব্যবস্থাপনা। এসব অভিযোগের ফলে, গ্রুপটির পরিচালনা এবং কর্মপরিধি সম্পর্কে বেশ কিছু নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে।
হামিদ গ্রুপের প্রাক্তন সাফল্য এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসা হিসেবে তার অবদান সত্ত্বেও, এসব বিতর্ক ও অভিযোগ প্রতিষ্ঠানটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের জনগণ এবং ব্যবসায়িক মহল এই পরিস্থিতি থেকে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা প্রত্যাশা করছে।
এখন, হামিদ গ্রুপের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো নিজেদের ব্যবসায়িক এবং রাজনৈতিক সম্পর্কগুলোতে স্বচ্ছতা আনা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।
ভবিষ্যতে নসরুল হামিদ এবং তার পরিবারের ক্ষমতার অপব্যবহার যদি চলতেই থাকে, তাহলে তাদের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের পতন অবশ্যম্ভাবী। দেশের অর্থনীতি এবং ব্যবসায়িক পরিবেশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার পরিবর্তে, তারা যদি নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির পথেই অগ্রসর হন, তবে এ ধরনের বিতর্ক এবং অনিয়ম কেবল তাদের সুনাম ধ্বংস করবে না, বরং জনগণের আস্থাও সম্পূর্ণভাবে নষ্ট করবে।
হামিদ গ্রুপের ইতিহাস, সাফল্য এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমাদের এই আলোচনার পর, এখন আপনার মতামত জানানোর সময়। আপনি কী মনে করেন, হামিদ গ্রুপ সত্যিই বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলে যে ভূমিকা রাখছে, তা যথাযথ? অথবা তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোর পেছনে কি কিছু সত্যতা রয়েছে? আপনার মতামত আমাদের কমেন্ট সেকশনে শেয়ার করবেন। ভবিষ্যতে আরও বিস্তারিত এবং তথ্যসমৃদ্ধ ভিডিও পেতে আমাদের সাথেই থাকবেন।