ইউনিলিভারের দাপট: কিভাবে গড়ে উঠল একটি কর্পোরেট সাম্রাজ্য? | Unilever Empire | Business Mania
আপনি যদি ব্যবসা, বিজনেস, ট্রেড এসব নিয়ে আগ্রহী কেউ একজন হয়৷ তাহলে অবশ্যই আপনার মাথাতে এই চিন্তাটা অবশ্যই এসেছে যে, আসলেই কি এমন কোন প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি এক্সিস্ট করে, যাদের কোন না কোন পণ্য কম বেশি দেশের সব মানুষই ব্যবহার করে থাকে। কিংবা এমন কোন প্রতিষ্ঠান আসলেই কি আছে যাদের পণ্যের বিস্তার বিশ্বের প্রায় সবকটি দেশ জুড়েই রয়েছে৷
জি অবশ্যই আছে। আর ইউনিলিভার এমনই একটা প্রতিষ্ঠান। আসলে ইউনিলিভার এর পণ্য আমাদের কাছেই এতটাই পরিচিত যে, অনেকেই ইউনিলিভারকে বাংলাদেশি কিংবা ভারতের কোম্পানি ভেবে ভুল করে থাকে। কিন্তু এটা সত্য নয়।
১৮৮০ সালে যাত্রা শুরু করা এই ব্রিটিশ আমেরিকান কোম্পানিটির ব্যবসা বিশ্বের প্রায় সবগুলো দেশ, ১৯০টি দেশ জুড়েই রয়েছে।
Business Maniar আমাদের আজকের ভিডিওটি এই ইউনিলিভারকে নিয়েই৷ যেখানে আমরা আলোচনা করবো এই প্রতিষ্ঠানটির শুরুর দিকের ইতিহাস, বাংলাদেশে তাদের বিস্তার আর তাদের পণ্যের ব্যাপারে। তাহলে চলুন শুরু করা যাক।
৮০ এর দশকে আমেরিকাতে উইলিয়াম লিভার নামে এক সেলসম্যান এর বাস ছিল। একজন সেলসম্যান হলেও তিনি ছিলেন ভীষণ রকমের উদ্যমী আর পরিশ্রমী একজন মানুষ। ওই সময়টাতে আমেরিকাতে সাবানের বেশ চাহিদা ছিল, আর মার্কেট ও দিন দিন বাড়ছিল।
এই বিষয়টাকে সামনে রেখেই উইলিয়াম লিভার ১৮৮০ সালে সাবান প্রস্তুত করা শুরু করেন। ১৮৮৪ সালে উইলিয়াম সানলাইট নামে তাদের প্রথম সাবান বাজারে ছাড়ে। একই বছরের শেষের দিকে উইলিয়াম লিভার এর নিজের ভাই জেমস লিভার ও এই ব্যবসায় যোগ দেয়। এরপর থেকেই তারা লিভার ব্রাদার্স এই নামে সাবান প্রস্তুত করে সেটা বাজারজাত করতে শুরু করে।
ওইসময়টাতে তারা সানলাইট বাদ দিয়েও আরো বিভিন্ন নামে আর সাইজে সাবান বাজারে ছাড়তে শুরু করে। দেখতে দেখতে ১৯১০ সালের দিকে তারা আমেরিকার মোট সাবান মার্কেটের চার ভাগের এক ভাগ দখল করে নেন।
পাশাপাশি এই সময়টাতে তারা আমেরিকা বাদেও ব্রিটেন ও তার আশে পাশের দেশগুলোতে তাদের ব্যসার পরিধি বাড়াতে থাকে।
কিন্তু ১৯১৪ সালের দিকে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হলে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। সে সময় বাজারে মার্জারি আর বাটারের ব্যাপক চাহিদা দেখা দেয়। ফলে ব্রিটিশ সরকারের অনুরোধে লিভার ব্রাদার মার্জারি আর বাটার প্রডিউস করতেও শুরু করে। আর এর সাথে সাবানের উৎপাদন তো চলছিলই।
১৯১৭ সালের দিকে এসে লিভার ব্রাদার্স পিয়ার সোপ নামে আরেকটি সাবানের কোম্পানি কিনে ফেলে আর ১৯২২ সালে ওয়ালিস নামের একটা সসেজ তৈরীর কোম্পানি কিনে। একই বছরে তারা একটা আইসক্রিমের কোম্পানি কিনেও তাদের সাথে যুক্ত করে৷
১৯২৯ সালে এসে লিভার ব্রাদার্স যুক্ত হয় মার্জিন ইউনিয়ন নামের আরেকটা প্রতিষ্ঠানের সাথে, যাদের ও মূল পণ্য ছিল মার্জারি, বাটার আর সাবান।
আসলে মার্জিন ইউনিয়ন ও একক কোম্পানি ছিল না। এটা ছিল কতগুলো কোম্পানির একটা জয়েন্ট ভেঞ্চার (Joint Venture)। যাদের মূল শাখা ছিল নেদারল্যান্ডস এ। ৮০ এর দশকের শেষের দিকে নেদারল্যান্ডস এ মার্জারী আর বাটার এর মার্কেট অনেকটা স্যাচুরেটেড হতে শুরু করে, ফলে টিকে থাকার তাগিদে জারজেন্ট আর ভ্যান্ডারবার্গ নামের দুটি বাটার আর মার্জারী ম্যানিফ্যাকচার করা প্রতিষ্ঠান এক সাথে যুক্ত হয়। পরবর্তীতে আরো কিছু ছোট খাটো প্রতিষ্ঠান এদের সাথে যুক্ত হয়।
আর এদেরই একটা শাখা বিস্তার লাভ করে ব্রিটেনে মার্জারী ইউনিয়ন এল নামে আর নেদারল্যান্ডস এরটা পরিচিতি অয়ায় মার্জারী ইউনিয়ন এনভি নামে। যাদের সাথেই ১৯২৯ সালে লিভার ব্রাদার্স মার্চ করে আর আত্মপ্রকাশ করে ইউনিলিভার।
যাত্রা শুরুর পর থেকেই ইউনিলিভারকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। যাত্রা শুরুর পর থেকে বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১৯০টা দেশে ইউনিলিভার তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। বর্তমানে তাদের রয়েছে ৪০০টি পৃথক পৃথক ব্রান্ড যার অধীনে রয়েছে প্রায় কয়েক হাজার পণ্য। আর ২০২৩ এর সমীক্ষা অনুযায়ী বিশ্বের প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন মানুষ ইউনিলিভের এর কোন না কোন পণ্য ব্যবহার করে থাকে। যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ।
এতো গেলো ইউনিলিভার এর শুরুর দিককার ইতিহাস। এবার চলুন জানা যাক ইউনিলিভার এর বাংলাদেশের যাত্রা সম্পর্কে।
ইউনিলিভার বাংলাদেশে তাদের যাত্রাটা শুরু করে পূর্ব পাকিস্তান এর আমলে। প্রথমে এটি পরিচিত ছিল “লেভার ব্রাদার্স পাকিস্তান” এই নামে। তবে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে এটির নাম পরিবর্তিত হয়ে “লেভার ব্রাদার্স বাংলাদেশ” রাখা হয়। পরে ২০০৪ সালে এর নামকরণ করা হয় “ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড”।
বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত আছে দেশের প্রায় ১০ হাজার মানুষ। এছাড়াও প্রতি বছর প্রতিষ্ঠানটি সরকারকে প্রায় ১০০০ কোটি টাকার ট্যাক্স দিয়ে থাকে।
বর্তমানে ইউনিলিভার বাংলাদেশ এর অধীনে রয়েছে প্রায় ২১টি ব্রান্ড। এদের অধীনে যেসব প্রডাক্ট বাজারে পাওয়া যায় সেগুলো হলো লাইফবয়, লাক্স, ডাভ, সানসিল্ক, ক্লিয়ার, পনডস, ভেসলিন, ক্লোজাপ, পেপসুডেন্ট, সারফেক্সসেল, হুইল, রিন, ভিম, নোর, লিপটন, তাজা, কোয়াল্টি ওয়ালস, রেক্সোনা, ফেয়ার এন্ড লাভলি, ট্রেসমি এবং কিফ।
এছাড়াও আরো যেসব পণ্য ইউনিলিভার বাংলাদেশ উৎপাদন না করলেও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশ থেকে আসে সেগুলো হলো
ক্লিনিপ্লাস,লাইকমি,হামাম,সানলাইট, পিওরি ফাই ওয়াটার ফ্লিটার, হরলিক্স, বুস্ট আর ম্যাগমাম আইসক্রিম।
এসব থেকেই একটা ধারণা হয়তো আপনি করতে পারছেন ইউনিলিভার এর পণ্য বাংলাদেশে আসলে ঠিক কতটা জনপ্রিয়। ইউনিলিভার এর লাক্স এ শুধু বাংলাদেশের সাবান মার্কেটের ৫০% দখল করে রেখছে। এছাড়াও দেশের মোট কন্সিউমিং গুডস এর ৬০% ই রয়েছে ইউনিলিভার এর দখলে।
এখন আপনার মাথাই একটা প্রশ্ন আসতে পারে ইউনিলিভার এতটা জনপ্রিয়তা আসলে কিভাবে অর্জন করলো?
এটা একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে বোঝা যাক। এদেশের বেশির ভাগ মানুষ লাক্স সাবান ব্যবহার করে থাকে। যেটা আবার বিভিন্ন সাইজের আর ফ্লেভার এর হয়ে থাকে। ব্যাচলর মানুষ হলে যে কেউ সহজেই লাক্স এর একটা মিনি প্যাকেট কিনে সেটা ব্যবহার করতে পারে। আবার যারা লাক্স ব্যবহার করে তাদের অনেকেই নিজেদের বাচ্চাদের জন্য লাইফবয় কিনে থাকে।
এছাড়াও দেশের এলিট শ্রেনীর মানুষ যারা লাক্স ইউজ করতে চায় না। তাদের জন্য ও রয়েছে ডাভ, পেয়ার এর মতো বিকল্প সাবান।
একই জিনিস আবার যায় দেশের শ্যাম্পু এর মার্কেট এর জন্য। এদেশের বেশির ভাগ ছেলেরা খুশকি এর সমস্যায় ভোগে তাদের জন্য রয়েছে ক্লিয়ার। আবার মেয়েদের চুল পরার সমস্যাকে নিয়ে সামনে এনেছে ক্লিনিক প্লাস সানসিল্ক এর মত শ্যাম্পু।
আবার এসব প্রত্যেকটা পণ্যের বড় প্যাকেট যেমন বাজারে পাওয়া যায় তেমনি ৫টাকার মিনি প্যাকেট ও পাওয়া যায়৷
অর্থাৎ একজন ক্রেতার আর্থিক অবস্থা, সমস্যা, চাহিদা কিংবা রুচি যাই হোক না কেন সবগুলোর জন্যই ইউনিলিভার এর কোন না কোন পণ্য বাজারে বিদ্যমান। যেন ইউনিলিভার নিজেই নিজের কম্পিটিটর।
আর এভাবেই ইউনিলিভার বাংলাদেশসহ বিশ্বের কনজিউমিং গুডস এর মার্কেট সফলভাবে দখল করে রেখেছে।
প্রিয় দর্শক আপনি ইউনিলিভার কোন কোন পন্য প্রতিদিন ব্যবহার করেন তা আমাদের কমেন্ট করে জানাতেন ভুলবেন না। এছাড়া নেক্সট এ আর কি কি টপিকের উপর ভিডিও দেখতে চান, তাও আমাদের জানাতে পারেন।
আমাদের আজকের ভিডিও এই অব্দি। । ভিডিওটি ভালো লাগলে লাইক দিন এবং কমেন্ট করুন।এরকম আরো ভিডিও দেখতে চাইলে, চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করে বেল বাটন্টি প্রেস করে রাখুন। দেখা হবে নেক্সট কোন ভিডিওতে।