নেতৃত্ব সংকট আর ঋণের বোঝা: নাভানা গ্রুপ কি হারিয়ে যাবে? | Navana Group | Business Mania
নাভান গ্রুপ সর্বপ্রথম আলোচনায় আসে ২০১৯ সালে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সরকার এর কাছ থেকে প্রায় ১২০০ কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা চায় এই প্রতিষ্ঠানটি। জানা যায় বিভিন্না ব্যাংক থেকে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকারো বেশী লোন নিয়ে বেকায়দায় পরেছে প্রতিষ্ঠানটি। শুরু হয় তোর জোড়।
বলা হয়ে থাকে, মোটামুটি ৬০ এর দশকে যাত্রা শুরু করে এখন অব্দি যেই কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে তাদের ব্যাবসা সফল ভাবে পরিচালনা করে যাচ্ছে তাদের মধ্যে নাভানা গ্রুপ একটি।
তবে প্রতিষ্টানটির নাম আগে থেকেই নাভানা ছিল না। সেই সময় এটি পরিচিত ছিল ইসলাম গ্রুপ হিসেবে। জহরুল ইসলাম এর হাত ধরে যার সূচনা স্বাধীনতার পূর্ববর্তী বাংলাদেশে যে কয়টা ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান আত্মপ্রকাশ করেছিল তাদের মধ্যে একটি ছিল এই ইসলাম গ্রুপ। তবে আর আট দশটা প্রতিষ্ঠানের মতো কেবল আত্নপ্রকাশ করেই থেমে থাকে নি এই ইসলাম গ্রুপ।
বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশে প্রথম ব্যাক্তিগত গাড়ি আসে এই ইসলাম গ্রুপের হাত ধরেই। ১৯৬৩ সালের দিকে প্রথম বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান হিসেবে টোয়োটার (Toyota) সাথে চুক্তি করে তাদের গাড়ির পরিবেষক হিসেবে কাজ শুরু করে ইসলাম গ্রুপ।
প্রিয় দর্শক Business Maniar আজকের এই ভিডিওটি হলো নাভানা গ্রুপকে নিয়ে। কীভাবে বহুল পরিচিত এই নাভানা গ্রুপ তাদের যাত্রা শুরু করে, তাদের ব্যাবসা পরিধি সেই সাথে তাদের কিছু ডার্ক সাইড ও। তাহলে চলুন শুরু করা যাক আজকের ভিডিওটি।
আগেই বলা হয়েছে নাভানা গ্রুপের শুরুটা আসলে হয় ইসলাম গ্রুপের হাত ধরে। ১৯৬৪ সালে জহুরুল ইসলাম ইসলাম গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম দিকের উদ্যোক্তাদের একজন, যার হাত ধরেই বাংলাদেশের কন্সট্রাকশন শিল্পে একটা বিপ্লব আসে।
তবে প্রতিষ্ঠার আগেই ১৯৬৩ সালে টয়োটার সাথে তাদের গাড়ির পরিবেষক হিসেবে এগ্রিমেন্ট করে। সেই থেকে ইসলাম গ্রুপ টয়োটার অফিসিয়াল ডিলার হিসেবে বাংলাদেশে কাজ করতে শুরু করে। জহরুল ইসলাম এর ভাই শফিউল ১৯৬৮ সালে ইসলাম গ্রুপে যোগ দেন। তার হাত ধরেই ইসলাম গ্রুপের অধীনে টয়োটা গাড়ির পরিবেশক নাভানা লিমিটেড এবং হিনো কমার্শিয়াল ভেহিকল ডিস্ট্রিবিউটর ও অ্যাসেম্বলার আফতাব অটো প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৭৬ সাল থেকে ইসলাম গ্রুপ বাংলাদেশ আর্মির সাথে কাজ করা শুরু করে। বাংলাদের আর্মির সব ভেহিকেল ইম্পোর্ট করার দায়িত্ব পায় এই ইসলাম গ্রুপ। তবে ১৯৯৬ সালে জহুরুল ইসলামের মৃত্যুর পর ইসলাম গ্রুপে নেতৃত্বের সংকট দেখা দেয়। এরপর তার ভাই শফিউল ইসলাম কামাল ইসলাম গ্রুপ থেকে বের হয়ে ১৯৯৬ সালে তিনি নাভানা লিমিটেড এবং আফতাব অটো এই দুটি কোম্পানি নিয়ে নাভানা গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন।
সেই থেকেই শুরু। বর্তমানে নাভানা লিমিটেড বা নাভানা অটোমোবাইলস লিমিটেড বাংলাদেশে টয়োটার একমাত্র এজেন্ট। ২০২৩ সাল অব্দি তারা বিক্রী করেছে প্রায় ৫০ হাজার এরও বেশি গাড়ি। আর শুধু মাত্র ২০২৩ সালেই বিক্রয় ছিল ৫০০ কোটি টাকার ও বেশি। বর্তমানে ৫০০ এরো অধিক কর্মী এই প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত রয়েছে।
১৯৮২ সালে ইসলাম গ্রুপের অধীনে যাত্রা শুরু করে আফতাব অটোমোবাইলস লিমিটেড যা পরবর্তীতে নাভানা গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়৷ এই প্রতিষ্ঠানটি ১৯৮২ সাল থেকেই বাংলাদেশের বাজারের জন্য টয়োটা এবং এইচআইএনও যানবাহন বিপণন করছে সেই সাথে গাড়ির ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ ও তৈরি করে থাকে। ২০২৩ সালে এসে এই প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৩০০ কোটি টাকার যন্ত্রাংশ বিক্রী করে। বর্তমানে ৭০০ এরো অধিক কর্মী এই প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত রয়েছে।
এছাড়াও ১৯৯৬ সালে যাত্রা শুরু করে নাভানা রিয়েল এস্টেট লিমিটেড। এর মূল কার্যক্রম হলো আবাসিক এবং বাণিজ্যিক প্রকল্প উন্নয়ন করা। প্রায় ২০০টির ও অধিক অভিজাত প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে এই প্রতিষ্ঠান নি। ৩০০ এর অধিক কর্মী বর্তমানে এদের সাথে যুক্ত রয়েছে।
১৯৯৬ সালে নাভানা এর আরো একটি প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করে নাভানা ফার্মাস্যাটিক্যাল লিমিটেড। যাত্রা শুরু কিছুদিনের মাথাতেই এই প্রতিষ্ঠানটি মানুষের মনে একটা আস্থার জায়গা তৈরী করে নেয়। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের একটা লিডিং ফার্মাস্যাটিক্যাল কোম্পানি। এর কর্মী সংখ্যা ৫০০ এরো অধিক।
২০০৪ সালে যাত্রা শুরু করে নাভানা গ্রুপের আরো একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান নাভানা সিএনজি লিমিটেড। বর্তমানে বাংলাদেশে সিএনজি মার্কেটের প্রায় ৭০% দখল করে রেখেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। প্রায় ১০০টির মতো সিএনজি স্টেশন রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের। বর্তমানে ২০০ এরো অধিক কর্মী এর সাথে যুক্ত রয়েছে।
২০০৫ সালে এসে যাত্রা শুরু করে নাভানা ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। বর্তমানে এটা বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ প্লাস্টিক উৎপাদনকারী সংস্থা। এছাড়াও বিভিন্ন ধরণের পাইপ এবং ডাক্ট ও উৎপাদন করে থাকে এই প্রতিষ্ঠানটি। প্রায় ২০০ কর্মীর এই প্রতিষ্ঠানটি ২০২৩ সালেই প্রায় ২৫০ কোটি টাকার ইনকাম জেনারেট করে।
২০১০ সালে যাত্রা শুরু করে নাভানা ফার্নিচার লিমিটেড। যাত্রা শুরু অল্প কিছুদিনের মাথাতেই উন্নত ডিজাইন ও মানের কারণে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এই প্রতিষ্ঠানটি। কেবলমাত্র ২০২৩ সালেই প্রতিষ্ঠানটির মোট বিক্রয় ছিল ১৫০ কোটি টাকা। বর্তমানে প্রায় ৪০০ জন কর্মী এই প্রতিষ্টানটির সাথে সরাসরি যুক্ত আছে।
বর্তমানের নে রয়েছে ২১ টির মতো প্রতিষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে নাভানা লিমিটেড, নাভানা অটোমোবাইলস, নাভানা ব্যাটারি লিমিটেড, নাভানা রিয়েল এস্টেট লিমিটেড, নাভানা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, নাভানা টেক্সটাইল লিমিটেড, নাভানা সিএনজি লিমিটেড, নাভানা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড, নাভানা ইঞ্জিনিয়ারিং উল্লেখযোগ্য।
তবে অন্য যে কোনো বড় প্রতিষ্ঠানের মতো নাভানা গ্রুপকে ঘিরেও বেশ কিছু বিতর্ক রয়েছে।
নাভানা গ্রুপ বাংলাদেশে টয়োটার একচেটিয়া পরিবেশক হবার কারণে। প্রায় সয়ই তুলনামূলক ভাবে উচ্চ মুল্যে গ্রাহকদের গাড়ি ক্রয় করতে হয়। আর কোন বিকল্প না থাকার কারণে দিন দিন এই সমস্যাটা আরো ঘনীভূত হচ্ছে।
নাভানা সিএনজি লিমিটেডকে নিয়েও ভোক্তাদের অভিযোগ রয়েছে। ভোক্তারা অভিযোগ করেছেন যে নাভানা সিএনজি কিটের দাম তুলনামূলক বেশি। যার কারনে ছোট ছোট ব্যাবসাগুলো বাজারে প্রবেশ করতে বাধার সম্মুখীন হয়।
এছাড়াও চলতি বছর নাভানা ফার্মাস্যাটিক্যাল এর নামে প্রায় ১৩৯ কোটি টাকার কর ফাকি দেওয়ার অভিযোগ আসে। অভিযোগে বলা হয় গত দুই অর্থ বছরে নাভানা ফার্মাস্যাটিক্যাল প্রায় ১৩৯ কোটি টাকার কর ফাকি দিয়েছে। যদি নাভানা গ্রুপের দায়িত্বশীলরা এই অভিযোগকে অস্বীকার করেছে।
তবে নাভানা গ্রুপ সবথেকে বড় ধাক্কা খায় ২০১৭–১৮ সালের দিকে এসে। কেননা এই বছর সকলের সামনের আসে যে নাভানা গ্রুপ তাদের নতুন নতুন ব্যাবসা বাড়াতে গিয়ে প্রচুর পরিমানে লোন নিয়েছে। জানা যায় ব্যবসা বাড়াতে গিয়ে নাভানা গ্রুপ ১৭টি কোম্পানি ৩১টি ব্যাংক ও ১৯টি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে মোট ৫,২৩৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। আর এই বিপুল পরিমান ঋণ শোধ করার মতো প্রয়োজনীয় ক্যাশ ফ্লো তাদের নেই।
২০১৮ এর শেষের দিকে প্রতিষ্ঠানটির চ্যায়ারম্যান শফিউল ইসলাম কামাল অসুস্থ হয়ে পরলে সমস্যা আরো ঘনীভূত হয়। নাভানা গ্রুপ একদ খাদের কিনারায় এসে পরে। সেই থেকে প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা করছে।
সংকট কাটিয়ে উঠার জন্য প্রতিষ্ঠানটি সরকারের কাছ থেকে বর্তমানে ১২০০ কোটি টাকার সহায়তা চেয়েছে। যা বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন।
এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে পেশি শক্তি দেখিয়ে জোর পূর্বক জমি দখলেরও অভিযোগ উঠেছে নানা সময় এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে লবিং করে অনৈতিক সুবিধা নেবার ও অভিযোগ উঠেছে নানা সময় নাভানা গ্রুপের বিরুদ্ধে।
বর্তমানে নাভানা গ্রুপ ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে তাদের পরিকল্পনা নতুন করে সাজাচ্ছে। আর্থিক দুরাবস্থা কাটাতে তারা লাভজনক নয় এমন প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তেমনি পণ্যের কোয়ালিটির উপর ফোকাস করে জনগনের আস্থা পুনরুদ্ধার এর ব্যবাস্থাও করছে।
প্রিয় দর্শক আপনি কি মনে করেন ৬০ দশকে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই প্রতিষ্ঠানটি কি পারবে ঘুরে দাড়াতে। নাকি ব্যার্থ হবে। আপনার সুচিন্তিত মতামত আমাদের জানাতে ভুলবেন না। আর কর ফাকি দেওয়া নিয়ে আপনাদের ধারণাটাই বা কি।
আমাদের আজকের ভিডিও এই অব্দি। । ভিডিওটি ভালো লাগলে লাইক দিন এবং কমেন্ট করুন। আর কোন কোন টপিকের উপর ভিডিও দেখতে চান তাও আমাদের জানান আর এরকম আরো ভিডিও দেখতে চাইলে, চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করে বেল বাটন্টি প্রেস করে রাখুন। দেখা হবে নেক্সট কোন ভিডিওতে।