সরিষার তেল থেকে লক্ষ কোটি টাকার সিটি গ্রুপ | City Group Empire | Business Mania
সিটি গ্রুপের নামটা আমাদের কাছে খুবই পরিচিত। চাল, আটা, তেল – এমন অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আছে, যা এই কোম্পানির হাত ধরে আমাদের ঘরে পৌঁছায়। এত বড় এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে তারা, কিন্তু এর পেছনের গল্প কতজন জানেন?
ভাবুন তো, কীভাবে একটি সাধারণ ব্যবসা শুরু করে আজ সিটি গ্রুপ (City Group) বাংলাদেশের বাজারের অন্যতম প্রভাবশালী শক্তি হয়ে উঠেছে? কীভাবে তারা একের পর এক খাত দখল করে আজ বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিতে পেরেছে? আসলেই কি তাদের এই শক্তি নিছক ব্যবসার সাফল্য, নাকি এর পেছনে আছে কিছু বিতর্কিত অধ্যায়?
বিজনেস ম্যানিয়া (Business Mania) আজকের এই ব্লগ পোস্টে থাকছে সিটি গ্রুপের উত্থান-পতনের গল্প এবং দেশের অর্থনীতিতে তাঁদের সার্বিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ।
১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে যেখানে ব্যবসা করার সামর্থ্য কিংবা সহায়ক অবকাঠামো তেমন ছিল না, সেখানে সাহস করে ব্যবসা শুরু করেন ফজলুর রহমান। সিটি গ্রুপের যাত্রা শুরু হলো গেন্ডারিয়ার ছোট্ট একটি জায়গা থেকে, নাম দেওয়া হলো “সিটি অয়েল মিলস (City Oil Mills)”। তাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল সরিষার তেল উৎপাদন, কারণ তখন সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের চাহিদা পূরণই ছিল দেশের বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি।
শুরুর দিনগুলো সহজ ছিল না; স্বাধীনতা পরবর্তী অর্থনৈতিক দুর্যোগ আর তৎকালীন বাজার পরিস্থিতি সিটি অয়েল মিলসের জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল। সীমিত উপকরণ, অপ্রতুল অবকাঠামো আর নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদনের মতো জরুরি কাজের মধ্যে দিয়ে ফজলুর রহমান তাঁর ব্যবসার ভিত্তি শক্ত করছিলেন। সঠিক পরিকল্পনা আর কঠোর পরিশ্রমের ফলে দ্রুত বাজারে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকেন তিনি।
প্রথম প্রকল্পের সাফল্য দেখে ধীরে ধীরে নতুন নতুন খাতে বিনিয়োগ শুরু করেন ফজলুর রহমান। ১৯৯২ সালে চালু করেন সয়াবিন তেল রিফাইনিং ইউনিট (Refining unit), এরপর একে একে চালু করতে থাকেন আটা, ময়দা এবং সুজির মতো পণ্য। এই পণ্যগুলো বাজারে আনার ফলে সিটি গ্রুপের “তীর” ব্র্যান্ড পরিচিতি পায় এবং গ্রাহকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
পরবর্তীতে, ১৯৯৯ সালে চালু হয় প্রিন্টিং (printing) ও প্যাকেজিং ইউনিট (Packaging unit)। এর ফলে সিটি গ্রুপ ব্যবসায়িক কার্যক্রমে আরো বেশি সক্ষম হয়ে ওঠে এবং বিভিন্ন পণ্যের মান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ হয়। ২০০০ সালে চালু করা হয় সিটি নেভিগেশনস, যা কাঁচামাল পরিবহনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ধীরে ধীরে এই প্রতিষ্ঠানটি ভোক্তাদের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে দেশের অর্থনীতিতে তার শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে।
শুরুটা সরিষার তেল দিয়ে হলেও, সিটি গ্রুপের যাত্রা ছিল দারুণ গতিময়। বিশেষ করে ১৯৯০-এর দশকে, যখন সিটি গ্রুপ ভোগ্যপণ্য থেকে শুরু করে খাদ্য, স্টিল(Steel), প্রিন্টিং (printing) ও প্যাকেজিং (Packaging), শিপিং (Shipping), শক্তি, স্বাস্থ্যসেবা, এমনকি মিডিয়া (media) ও ইন্স্যুরেন্স (Insurance) খাতে তাদের কার্যক্রম প্রসারিত করে।
“তীর” ব্র্যান্ডটি ছিল তাদের অন্যতম বড় সাফল্যের নিদর্শন। তীর ব্র্যান্ডের তেল, আটা, ময়দা, সুজি, চাল, ডাল, চিনি এবং পশুখাদ্যের মাধ্যমে তারা দেশের প্রতিটি ঘরে নিজেদের স্থান করে নেয়। এভাবেই সিটি গ্রুপ একটি বিশ্বস্ত ভোক্তা ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
নতুন নতুন উদ্যোগ এবং উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার সিটি গ্রুপকে এক অনন্য অবস্থানে পৌঁছে দেয়। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত অটোমেটেড (Automated) চাল ও ডাল মিল কিংবা রূপসী ফ্লাওয়ার মিল তাদের ব্যবসার পরিসর এবং মান বাড়াতে সাহায্য করে। এ ছাড়াও, চা উৎপাদনে শ্রীমঙ্গল ও চট্টগ্রামের তিনটি চা বাগানের মাধ্যমে তারা স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করেছে। অন্য দিকে আর্থিক সাহায্য প্রদান ও চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটি, যা তাদের জনসমর্থনকে আরো শক্তিশালী করেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সিটি গ্রুপের অবদান অপরিসীম। বিপুল কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তারা শুধু নিজস্ব কর্মী বাহিনীর জন্য নয়, গোটা দেশের জন্যই একটি স্থিতিশীল কর্মক্ষেত্র তৈরি করেছে। তাদের প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন কারখানা, যেমন রূপসী ফ্লাওয়ার মিল, অটোমেটেড (Automated) চাল ও ডাল মিল এবং চিনি পরিশোধনাগার, হাজার হাজার মানুষের জীবিকা নিশ্চিত করছে। এমনকি দেশজ উৎপাদনেও তারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে, যা দেশের জিডিপিকে সরাসরি প্রভাবিত করে।
তবে সিটি গ্রুপের প্রকৃত প্রভাবটি তাদের বাজার নিয়ন্ত্রণে। “তীর” ব্র্যান্ডের তেল, আটা, ময়দা, চাল এবং ডালের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলির মাধ্যমে সিটি গ্রুপ দেশের প্রতিটি ঘরে পৌঁছে গেছে। এ ধরনের ব্র্যান্ডের মাধ্যমে তারা বাজারের এক বড় অংশ দখল করে আছে, যা ভোক্তা বাজারে একচেটিয়া শক্তির ইঙ্গিত দেয়। সিটি গ্রুপের প্রভাব এমন যে, অনেক ক্ষেত্রে তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম নির্ধারণেও প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে।
তবে, এই বিশাল বাজারে সিটি গ্রুপকে একা প্রতিযোগিতা করতে হয় না। মেঘনা গ্রুপ (Meghna Group) এবং বসুন্ধরা গ্রুপের (Bashundhara group) মতো বড় বড় কোম্পানিও তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। মেঘনা গ্রুপের তেল ও খাদ্যপণ্য এবং বসুন্ধরা গ্রুপের ভোক্তা দ্রব্যগুলির সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা সিটি গ্রুপ এর সাথে। যদিও প্রতিযোগীরা ক্রমাগত বাজারে স্থান করে নিচ্ছে, সিটি গ্রুপের শক্তিশালী ব্র্যান্ড সচেতনতা এবং সর্বত্র উপস্থিতির কারণে তারা এখনও শীর্ষস্থানীয় হিসেবে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হচ্ছে।
সিটি গ্রুপের উত্থানের পেছনে যেমন সাফল্যের গল্প রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিভিন্ন বিতর্ক এবং সমালোচনার ছায়াও।
সিটি গ্রুপের বিভিন্ন কারখানার পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে পরিবেশবিদরা অনেক প্রশ্ন তুলেছেন। বিশেষ করে তাদের মিল এবং রিফাইনারি (Refinery) স্থাপনগুলো থেকে নির্গত বর্জ্য ও দূষণ স্থানীয় পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত রাসায়নিক এবং উৎপন্ন বর্জ্য অনেক ক্ষেত্রে আশপাশের জলাশয় এবং জমিতে দূষণ ছড়াচ্ছে। এছাড়াও, বড় বড় উৎপাদনকারীদের পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণ যথাযথভাবে না মেনে চলার কারণে পরিবেশগত অবনতির শঙ্কা রয়েছে। যদিও সিটি গ্রুপ (City Group) এ ধরনের অভিযোগকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার কথা বলে, এই প্রশ্নগুলো তাদের সামগ্রিক ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
সিটি গ্রুপের বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নিয়ে বরাবরই ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। “তীর” ব্র্যান্ডের মাধ্যমে তারা তেল, আটা, চাল এবং ময়দার মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে বিশাল বাজার দখল করে রেখেছে। তাদের এই একচেটিয়া প্রভাবের কারণে বাজারে মূল্য স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা সাধারণ মানুষের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন (Bangladesh Competition Commission) সম্প্রতি সিটি গ্রুপের বিরুদ্ধে বেআইনি দাম বৃদ্ধির এবং কৃত্রিম সংকট তৈরির অভিযোগে মামলা করেছে। অভিযোগ রয়েছে, তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলোর মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছে। উদাহরণস্বরূপ, চালের দাম যেখানে ছিল ৬০ টাকা কেজি, তা বেড়ে ৮৫ টাকায় পৌঁছায় এবং ডিমের দাম এক হালি ৬৫ টাকায় ওঠে।
সিটি গ্রুপের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে তারা তাদের ব্যবসার প্রসার এবং সুরক্ষা দুটোই নিশ্চিত করে চলেছে। বিশেষ করে তাদের প্রতিষ্ঠাতা ফজলুর রহমানের রাজনৈতিক প্রভাব এবং সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে। অনেকের মতে, এই রাজনৈতিক সমর্থনের কারণেই সিটি গ্রুপ (City Group) বিভিন্ন সময়ে সরকারি বাধা থেকে মুক্ত থাকতে এবং বাজারে নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি, তাদের বিরুদ্ধে পরিবেশগত আইন লঙ্ঘন অথবা প্রতিযোগিতা আইন হোক তা ভঙ্গের অভিযোগ উঠলেও তারা সহজেই এই ঝামেলা থেকে মুক্তি পায়।
সিটি গ্রুপের সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারিগুলোও তাদের ব্যবসার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। চট্টগ্রামের একটি আদালত সম্প্রতি ফজলুর রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে, কারণ তার কোম্পানি তীর ব্র্যান্ডের তেলের ভিটামিন-এ মান বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে, যা BSTI (Bangladesh Standards and Testing Institution)-এর তদারকি পরীক্ষায় ধরা পড়ে।
এই ঘটনাগুলো মিডিয়া এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতর্কের ঝড় তুলেছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সিটি গ্রুপের এই কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। জনগণ তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পেছনে সিটি গ্রুপের মতো বড় কোম্পানিগুলোর কারসাজি রয়েছে বলে সন্দেহ করছে। আর BCC (Bangladesh Competition Commission)-এর মামলাগুলো এই ধারণাকে আরও জোরদার করছে।
যদিও তারা তাদের কার্যক্রমকে আইনের মধ্যে রেখে পরিচালনার দাবি করে, কিন্তু বাজার এবং পরিবেশের উপর তাদের প্রভাবের বিষয়টি সকলের জন্য উদ্বেগের কারণ। ভবিষ্যতে যদি তাদের এসব বিতর্কিত কার্যকলাপের ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে দেশের অর্থনীতি এবং সমাজ উভয়েই দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।
বর্তমানে সিটি গ্রুপ (City Group) তাদের ব্যবসাকে আরও বিস্তৃত করার লক্ষ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাতে মনোযোগ দিচ্ছে। খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ইতোমধ্যেই প্রভাবশালী অবস্থানে থাকলেও, তারা এনার্জি (Energy), ইস্পাত, প্যাকেজিং (Packaging) এবং স্বাস্থ্য খাতে তাদের বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে টেকসই ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে তারা এই খাতগুলোতে নিজেদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে চাচ্ছে। এর পাশাপাশি, উন্নত মানের পণ্য ও সেবা প্রদানের মাধ্যমে ভোক্তাদের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করছে, যা তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
সিটি গ্রুপ তাদের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে তারা আগামীর চ্যালেঞ্জগুলোকে পেরিয়ে আরও শক্তিশালী হতে চায়।
সিটি গ্রুপের উত্থান এবং বিতর্কের এই গল্প কেবল একটি কোম্পানির নয়, বরং এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির শক্তিশালী প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি প্রতিচ্ছবি।
আপনাদের মতে সিটি গ্রুপের এই শক্তিশালী অবস্থান কতটা ন্যায়সঙ্গত? ভবিষ্যতে কি এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো আরও স্বচ্ছভাবে কাজ করতে পারে? আপনার মতামত অবশ্যই আমাদের সাথে শেয়ার করবেন।