ভারতের বাধে বাংলাদেশের যত অর্থনৈতিক ক্ষতি | How Indian Dam Affects Bangladesh | Business Mania
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ । বাংলাদেশের নদীগুলো দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড স্বরুপ। বাংলাদেশের বুক চিরে বয়ে চলেছে শতাধিক নদী। কিন্তু ভারত, আমাদের দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী, যার সঙ্গে আমাদের সুদীর্ঘকালের ঐতিহাসিক সম্পর্ক, সেই সম্পর্কের বাঁকে বাঁকে তৈরি হয়েছে নানা সমস্যা। আর সেই সমস্যার মূলে রয়েছে ভারতের নদীগুলির ওপর নির্মিত বাঁধগুলো । ভারতের বাঁধগুলো বাংলাদেশের নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে, যা আমাদের দেশের কৃষি, মৎস্য, এবং জলপরিবহন খাতকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এমনকি, এই প্রভাব এতটাই ভয়াবহ যে, দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো পর্যন্ত এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আজকের ব্লগ পোস্টের মূল আলোচনার বিষয় হচ্ছে, ভারতের বাঁধগুলোর কারণে বাংলাদেশে কীভাবে পানি সংকট তৈরি হচ্ছে এবং তার প্রভাব কেমনভাবে আমাদের অর্থনীতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কীভাবে এই সংকট আমাদের কৃষি, মৎস্য, ও নৌপরিবহন খাতে ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবশেষে,এই সমস্যা আমাদের জন্য কতটা ব্যাপক এবং কেন আমাদের এই বিষয়ে সচেতন হওয়া উচিত ।
ভারত, তার জলসম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য শত শত বাঁধ নির্মাণ করেছে। বর্তমানে ভারতের ৫ হাজারেরও বেশি বাঁধ রয়েছে। ১৯৭৫ সালে, যা তাদের কৃষি, শিল্প, ও পানির চাহিদা মেটাতে গড়ে তোলা হয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য অন্তত পক্ষে ১০০টিরও বেশি বড় বাঁধ রয়েছে। এসব বাঁধ ভারতের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের জন্য হলেও এর প্রভাব শুধুমাত্র সীমান্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের ওপর এই বাঁধগুলো গুরুতর প্রভাব ফেলছে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ থামিয়ে দিয়ে , নিয়ন্ত্রিত করলে, এর অর্থনৈতিক প্রভাব ব্যাপক হয়ে উঠে।
বাংলাদেশের কৃষিকাজ সরাসরি এই বাধের দ্বারা প্রভাবিত হয়। সেচের পানির অভাব, শুকনো মৌসুমে মাটির উর্বরতা কমে যাওয়া, আর বর্ষাকালে আকস্মিক বন্যা – এসবই কৃষির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন কমে যাওয়ার সাথে সাথে খাদ্য নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও নড়বড়ে হয়ে পড়ে।
ভারতের এই বাঁধগুলো তাদের জন্য ইতিবাচক প্রভাব ফেললেও, এর প্রভাব বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য একেবারেই নেতিবাচক। বিশেষ করে, গঙ্গা ও তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত বাঁধগুলো বাংলাদেশের পানির সরবরাহে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। প্রথমেই আসি ফারাক্কা বাঁধের কথায় ।
১৯৭৫ সালে গঙ্গা নদীর ওপর নির্মিত এই বাঁধটির মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি নদীর প্রবাহ ঠিক রাখা।
গঙ্গা নদীর পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রায় ১৫ লাখ হেক্টর কৃষিজমি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই বাঁধের কারণে গঙ্গার পানি প্রবাহ কমে গিয়ে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ভয়াবহ পানি সংকট সৃষ্টি হয়। এই সংকট শুষ্ক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়, যখন বাংলাদেশে গঙ্গার পানি প্রবাহ ৫০% এরও বেশি কমে যায়। এর ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষি ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। পানি সংকটের কারণে কৃষকরা ধান, গম, ও অন্যান্য ফসল উৎপাদনে বাধাগ্ৰস্থ হন , যার ফলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যায় ।
অন্যদিকে যদি তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত তিস্তা ব্যারেজ (Teesta Irrigation Project) এবং গজলডোবা বাঁধের কথা বলি এগুলোও বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করছে। এই বাঁধগুলোর কারণে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ এতটাই কমে যায় যে, উত্তরবঙ্গের কৃষিকাজ প্রায় অচল হয়ে যায়। তিস্তা নদীর পানি সংকটের কারণে ফসল উৎপাদন কমে যাওয়ার পাশাপাশি, এই অঞ্চলে মৎস্য সম্পদও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে, তিস্তা নদীতে মাছের প্রজনন ব্যাপকভাবে কমে গেছে, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ।
এছাড়াও, ভারতের অন্যান্য বাঁধ, যেমন মহিষকুচি বাঁধ, যা দুধকুমার নদীর ওপর নির্মিত, এই বাঁধগুলোও বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে এতে কোন সন্দেহ নেই । নদীর পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষিকাজ ও নৌপরিবহন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষকরা পানি সংকটের কারণে শুষ্ক মৌসুমে ফসল উৎপাদন করতে পারছে না, যার ফলে খাদ্য উৎপাদনে ব্যাপক হ্রাস ঘটছে। নদীর পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় নৌপরিবহন খাতে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে, যার ফলে স্থানীয় বাণিজ্যিক কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে।
ভারতের এই বাঁধগুলোর কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশাল আকারের ক্ষতি হচ্ছে। প্রথমত, কৃষিখাতে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশের কৃষি নির্ভরশীল পানি সরবরাহের ওপর। যখন নদীগুলোতে পর্যাপ্ত পানি থাকে না, স্বাভাবিক ভাবেই তখন কৃষকরা ফসল উৎপাদনে ব্যর্থ হয়। তিস্তা, গঙ্গা, এবং ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপর নির্ভরশীল কৃষিজমিগুলো শুষ্ক মৌসুমে প্রায় শূন্য হয়ে যায়। বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকরা ফসল উৎপাদনে চরম সমস্যার সম্মুখীন হয়, যার ফলে খাদ্য উৎপাদন কমে যায় এবং খাদ্য মূল্য বৃদ্ধি পায়। এর ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে এবং কৃষকের আয়ও হ্রাস পায়।
মৎস্য সম্পদ এর ক্ষতির কথা না বললেই নয় । বাংলাদেশের নদীগুলোর পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় মাছের প্রজনন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে, পদ্মা নদীতে ইলিশ মাছের প্রজনন ব্যাপকভাবে কমে গেছে, যা দেশের রপ্তানি আয়ের একটি বিশাল অংশ। গঙ্গা ও তিস্তা নদীর পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে মাছ উৎপাদন প্রায় ২৫-৩০% কমে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, পদ্মা নদীতে ইলিশ মাছের উৎপাদন প্রায় ১৫% হ্রাস পেয়েছে, যা বাংলাদেশের মোট মাছ উৎপাদনের প্রায় ১২%। এর ফলে রপ্তানি আয়েও বছরে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়ে চলেছে ।
ভারতের বাঁধগুলোর কারণে ইলিশের প্রজনন মৌসুম প্রায়শই ব্যাহত হচ্ছে, যার ফলে ইলিশের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। দেশের রপ্তানি আয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাচ্ছে এবং দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে একটি বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ।বাংলাদেশের বেশিরভাগ পণ্য পরিবহন হয় নদীপথে, এবং এই পথে বাঁধের কারণে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় নৌপরিবহনে ব্যাঘাত ঘটছে।
নৌপরিবহন খাতে আমাদের নদীগুলোর গভীরতা কমে যাওয়ায় বড় বড় নৌযান চলাচল কমে যাচ্ছে ,ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এর ফলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে । যার ফলে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি, বিভিন্ন পণ্যের মূল্যেও বৃদ্ধি পাচ্ছে।উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধিও একটি বড় সমস্যা । নদীর পানি কমে যাওয়ার ফলে সাগরের লবণাক্ত পানি উজানে প্রবেশ করছে, যার ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যাচ্ছে। এই লবণাক্ততার কারণে চাষযোগ্য জমি অনুপযোগী হয়ে পড়ছে, এবং দেশের উপকূলীয় কৃষি এবং চিংড়ি চাষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে চিংড়ি চাষ একটি বড় শিল্প, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তবে লবণাক্ততার কারণে চিংড়ি চাষে উৎপাদন কমে যাচ্ছে, এবং দেশের রপ্তানি আয়ও হ্রাস পাচ্ছে।
এছাড়াও, ভারত থেকে আসা নদীগুলোর পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় দেশের জলজ জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের নদীগুলোতে আগে যেসব মাছ পাওয়া যেত, সেগুলোর প্রজনন কমে যাওয়ায় এবং জলজ পরিবেশের অবনতি হওয়ায় মাছের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। এটি দেশের মৎস্য খাতের ওপর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির কারণ হতে পারে, যার ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে।
সব শেষে বলা যায়,বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভারতের বাঁধগুলোর প্রভাব অত্যন্ত গুরুতর। একটি নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে তার প্রভাব যে কতটা গভীর হতে পারে, তা বাংলাদেশের মানুষজন ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে পারছে ।
জন সচেতনতার জন্য ব্লগটি শেয়ার করুন আপনার পরিজনের সাথে। ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে মন্তব্য জানান কমেন্ট বক্সে, পরবর্তি ব্লগ পড়তে বিজনেস ম্যানিয়ার নিউজলেটারটি সাবসস্ক্রাইব করুন।