ড.মুহাম্মদ ইউনুস – ক্ষুদ্র ঋনের জনক যিনি । Dr. Younus Biography
2024 সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন , যেন কেটে গেল এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মতো।
টানা এক মাস ধরে চলা এ আন্দোলনে, শত শত ছাত্রের রক্তের বিনিময়ে যেন আবার নতুন করে স্বাধীন হলো বাংলাদেশ। ১৫ বছরের সৈরাচারি শাসনের অবসান হয় শেখ হাসিনার । রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগ পত্র জমা দিয়ে , বর্তমানে দেশ ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন শেখ হাসিনা।
৬ই আগস্ট ২০২৪ , রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন । নতুন সরকার গঠন করতে ছাত্রদের মতামত কেই প্রাধান্য দেয়ার আশ্বাস দেওয়া হয় । সবার সম্মতি ক্রমে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নির্বাচন করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। আর গ্ৰামীন ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়েই আজকে
আমাদের আলোচনার মূল বিষয়।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি ক্ষুদ্রঋণ নামক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জনক হিসেবে সমাদৃত। অধ্যাপক ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এই পুরস্কার লাভ করেন। ড. মুহাম্মদ ইউনুস হলেন পৃথিবী এর সাতজন ব্যক্তির একজন, যিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম (Presidential Medal of Freedom) এবং যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল (Congressional Gold Medal) পেয়েছেন।
মুহাম্মদ ইউনুস ১৯৪০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রামের হাটহাজারির কাপ্তাই সড়কের বাথুয়া গ্রামে একটি বাঙালি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন (Matriculation) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তিতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (Dhaka University) অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৬০ সালে বিএ এবং ১৯৬১ সালে এমএ সম্পন্ন করেন। স্নাতক শেষ করে মুহম্মদ ইউনূস গবেষণা সহকারী হিসেবে অর্থনীতি ব্যুরোতে (Bureau of Economic and Business Affairs) যোগ দেন।
তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার জন্য ফুলব্রাইট স্কলারশিপ (US Fulbright Scholarship Program) লাভ করেন। ১৯৭১ সালে ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের (Vanderbilt University) গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম ইন ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট (GPED) থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তি বাংলাদেশে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেব যোগ দেন এবং বিভাগের প্রধান হিসেবেও কাজ করেছেন।
১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষের সময় অধ্যাপক ইউনূস বুঝতে পারেন স্বল্প পরিমাণে ঋণ দরিদ্র মানুষের জীবন মান উন্নয়নে অত্যন্ত কার্যকরী হতে পারে। সেই সময়ে তিনি গবেষণার লক্ষ্যে গ্রামীণ অর্থনৈতিক প্রকল্প চালু করেন।
১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি জোবরা গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সময় ইউনুস আবিষ্কার করেন যে খুব ছোট ঋণ দরিদ্র মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য তৈরি করতে পারে। তিনি লক্ষ্য করেন গ্রামের মহিলারা যারা বাঁশের আসবাব তৈরি করতেন, তাদের বাঁশ কিনতে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হতো এবং তাদের লাভ ঋণদাতাদেরকে দিতে হতো। প্রথাগত ব্যাংকগুলো দরিদ্রদেরকে উচ্চ ঋণখেলাপির ঝুঁকির কারণে যুক্তিসঙ্গত সুদে ছোট ঋণ দিতে চায়তনা। কিন্তু ইউনুস বিশ্বাস করতেন যে, সুযোগ পেলে দরিদ্ররা উচ্চ সুদ পরিশোধ করতে হবে না, তাদের নিজেদের পরিশ্রমের লাভ রাখতে পারবে, সেজন্য ক্ষুদ্রঋণ একটি কার্যকর ব্যবসায়িক মডেল হতে পারে। ইউনুস তার নিজের টাকা থেকে ২৭ মার্কিন ডলার ঋণ দেন গ্রামের ৪২ জন মহিলাকে, আর প্রতি ঋণে হতে তিনি ০.৫০ টাকা বা ০.০২ মার্কিন ডলার লাভ করেন। যেজন্য ইউনুসকে ক্ষুদ্রঋণের ধারণার জন্য কৃতিত্ব দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রভাব ব্যপক । 2023 সালের মধ্যে, এটি 90 লাখেরো বেশি ঋণগ্রহীতাকে ঋণ প্রদান করেছিল । সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্রামীণ ব্যাংক প্রায় 1 কোটি ঋণগ্রহীতাকে ৩৭০০ কোটি ডলারের বেশি ঋণ বিতরণ করেছে। ২০২৩ এর মে মাসের একটি রিপোর্ট এ পাওয়া যায় গ্রামীণ ব্যাঙ্কের বিভিন্ন শাখায় প্রায় ২২০০০+ কর্মী রয়েছেন। এই কর্মচারীরা ঋণগ্রহীতাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে, কেবল আর্থিক পরিষেবা প্রদান করে না, গ্রামীণ ঋণের অর্থায়নে ক্ষুদ্র উদ্যোগের সাফল্য নিশ্চিত করতে ব্যবসায়িক পরামর্শ ও সহায়তাও প্রদান করে। ব্যাংকটি বাংলাদেশে ২৫০০ টিরও বেশি শাখা পরিচালনা করে, যা দেশের সবচেয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এর প্রসারকে প্রসারিত করে।
দারিদ্র্য বিমোচনে উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য গ্রামীণ ব্যাংক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও অর্জন করেছে। নিম্ন থেকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন সৃষ্টির প্রচেষ্টার জন্য মুহাম্মদ ইউনূস এবং ব্যাংক যৌথভাবে 2006 সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়। গ্রামীণ ব্যাঙ্কের সাফল্য বিশ্বব্যাপী অনুরূপ ক্ষুদ্রঋণ উদ্যোগকে অনুপ্রাণিত করেছে, যা এই ক্ষেত্রে অগ্রণী হিসাবে এর সুনামকে দৃঢ় করেছে।
গ্রামীণ ব্যাংকের প্রভাব বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হয়েছে। 2015 সালের 26শে আগস্ট, ফরচুন ম্যাগাজিন (Fortune Magazine) গ্রামীণ ব্যাঙ্ককে তার “চেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড” (Change the World) তালিকায় 12তম স্থান দেয়, যা দারিদ্র্যের মধ্যে থাকা ব্যক্তিদের জন্য নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি এবং ব্যাঙ্ক পরিষেবা থেকে বঞ্চিত ব্যক্তিদের আর্থিক পরিষেবার আওতায় আনার ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কের সাফল্যকে তুলে ধরে। এই স্বীকৃতি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নকে উৎসাহিত করতে ব্যাংকের ভূমিকাকে তুলে ধরে।
এখন পর্যন্ত দারিদ্র্য দূরীকরণে ক্ষুদ্রঋণ বা সামাজিক ব্যবসার এই মডেল পৃথিবীর ৪০টির বেশি দেশে ১৩০টির বেশি প্রতিষ্ঠান ধারণ করে চলেছে। এ ছাড়া পৃথিবীর ৮০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে তার নামে ‘ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার’ (Yunus Social Business Center) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে ড. ইউনূসের চিন্তা, কাজ, ভবিষ্যৎ লক্ষ্য ও তার জীবনাদর্শ নিয়ে গবেষণা হয়। এখন পর্যন্ত ২৪টি দেশের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ৬০টির মতো সম্মানসূচক ডিগ্রি (Honorary Degrees) পেয়েছেন। ১৩০টির বেশি সম্মাননা (Awards) পেয়েছেন ৩০টির বেশি দেশ থেকে। কানাডা ও জাপানের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে ড. ইউনূসের জীবনী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গত কয়েক দশকে ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক, গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ কল্যাণ, গ্রামীণ ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ ফান্ড, গ্রামীণ মৎস্য ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ উদ্যোগ, গ্রামীণ সামগ্রী, গ্রামীণ শক্তিসহ ৫০টির বেশি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।
1994 সালে গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সরকারি সম্মান স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার লাভ করে। 2006 সালের 13ই অক্টোবর নোবেল কমিটি মুহাম্মদ ইউনূসকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন সৃষ্টির প্রচেষ্টার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান করে। কমিটি উল্লেখ করে যে, ইউনূস ব্যাংক দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ক্ষুদ্রঋণকে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তুলেছিল এবং বিশ্বব্যাপী অনুরূপ উদ্যোগকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
2011 সালে, শেখ হাসিনা সরকার ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেয় এই বলে যে, 73 বছর বয়সে তিনি বৈধ অবসরের বয়স 60 বছর অতিক্রম করেছেন। তাঁর বরখাস্তের প্রতিবাদে হাজার হাজার বাংলাদেশি মানববন্ধনে আবদ্ধ হন।
২০২৪ এর জানুয়ারিতে শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে ইউনূসকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তার প্রতিষ্ঠিত একটি টেলিকম সংস্থার শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে ২৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগে তাকে এবং আরও ১৩ জনকে জুন মাসে বাংলাদেশের একটি আদালত অভিযুক্ত করে।
যদিও কোনও মামলায়ই তাঁকে জেলে যেতে হয়নি, তবুও দুর্নীতি ও অন্যান্য অভিযোগে 100টিরও বেশি মামলার মুখোমুখি হয়েছেন ইউনুস।
১০৪ জন নোবেল বিজয়ী এবং ৭৯ জন বৈশ্বিক ব্যক্তিত্বের একটি চিঠিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহম্মদ ইউনুসের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। নোবেলজয়ী, নির্বাচিত কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দদের লেখা এই চিঠিতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের হুমকির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। চিঠিতে অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় কার্যক্রম স্থগিত এবং নিরপেক্ষ বিচারকদের একটি প্যানেলের দ্বারা অভিযোগের পর্যালোচনা করার আহ্বান জানানো হয় । পাশাপাশি ড. ইউনূস নিজেও এগুলোর সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন এবং এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, অভিযোগগুলি “অত্যন্ত তুচ্ছ, বানানো গল্প”।
পরিশেষে, ব্যাপক বিক্ষোভ ও অস্থিরতার মধ্যে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ ও পালিয়ে যাওয়ার পর নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দিতে চলেছেন।
শেখ হাসিনা সরকারের আমলে দুর্নীতির অভিযোগের সম্মুখীন হওয়া ইউনূস এটিকে দেশের গণতান্ত্রিক নবায়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ হিসেবে দেখেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের লক্ষ্য হল জাতিকে স্থিতিশীল করা এবং নতুন নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। ইউনূসের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক এবং সামাজিক ব্যবসা ও দারিদ্র্য বিমোচনের উদ্যোগের প্রতি আরও বেশি মনোযোগ দেওয়ার সম্ভাবনার কারণে তাঁর নেতৃত্বে গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ আরও নিরাপদ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক উত্থানের মূল কারণগুলি মোকাবেলা করার সময় নতুন প্রশাসনকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. ইউনূস বিশেষ করে দেশের এই অবস্থায় তার যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারবেন ? গ্ৰামীন ব্যাংকের ভবিষ্যৎই বা কিরুপ হতে পারে? কোটি কোটি টাকার ঋণ ও দারিদ্রতা থেকে দেশ কি মুক্তি পাবে ?
ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে মন্তব্য জানান কমেন্ট বক্সে, পরবর্তি ব্লগ পড়তে বিজনেস ম্যানিয়ার নিউজলেটারটি সাবসস্ক্রাইব করুন।