NETFLIX: DVD সেলার থেকে বিলিয়ন ডলার স্ট্রিমিংসাইট
আমাজন, আলী বাবা ডট কম, কেএফসি সহ অনেক জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠানের নামই তো শুনেছেন। আজকে এমন একটি জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠানের কথা আপনাদেরকে বলবো। যেই প্রতিষ্ঠানের মালিকরা বার বার লোকসানের মুখে পড়েও কখনো হাল ছেড়ে দেয় নি। খাদের কিনারায় দাঁড়িয়েও নিজেদের স্বপ্নকে ধুলোর সাথে মিশতে দেয় নি। সেই স্বপ্নবাজরাই তৈরী করেছে এক নতুন ইতিহাস, যার নাম Netflix. ১৯০ টি দেশে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছে Netflix. সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী এর বর্তমান ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ২৬৯ দশমিক ৬ মিলিয়ন।
সহজ কথায় Netflix হলো, একটি অন ডিমান্ড ভিডিও স্ট্রিমিং প্লাটফর্ম, যেখানে ইউটিউবের মতো ভিডিও দেখা যায়। তবে ইউটিউব এবং নেটফ্লিক্সের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। ইউটিউবে আপনি শুধু ইন্টারনেট থাকলেই ভিডিও দেখতে পারবেন কিন্তু নেটফ্লিক্সে ভিডিও দেখার জন্য ইন্টারনেট থাকার পাশাপাশি আপনার নেটফ্লিক্সের একাউন্টও থাকতে হবে। শুধু তাই নয়, প্রতি মাসে আপনাকে Subscription Fee হিসেবে নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ এই Netflix কে প্রদান করতে হবে। বিশ্বের মোট ৪৫ টি ভাষার সিনেমা পাওয়া রয়েছে Netflix এ। মুভি, ওয়েব সিরিজ বা নতুন কোন টেলিভশন প্রোগ্রাম উপভোগ করার জন্য Netflix এর চেয়ে ভালো কোন মাধ্যম হতে পারে না।
আজকের এই Netflix কিন্তু একদিনে গড়ে উঠে নি, বহু বছরের পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়ের প্রতিফলন আজকের এই Netflix.
১৯৯৭ সালের ২৯শে আগস্ট মার্ক র্যান্ডলফ এবং রিড হেস্টিংসের হাত ধরেই Netflix এর যাত্রা শুরু হয়। রিড হেস্টিংস(Reed Hastings) একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ ছিলেন। পাশাপাশি তিনি পিওর সফটওয়্যার (puresoftware) কোম্পানীর একজন সহ প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন অন্যদিকে মার্ক র্যান্ডলফ(marc randolph) সেই পিওর সফটওয়্যার কোম্পানীর একজন মার্কেটিং ডিরেক্টর ছিলেন। এর আগে তিনি মাইক্রোওয়্যারহাউসে কাজ করেছিলেন।
একদিন ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা ক্রূজ এ (santa cruise) মার্ক এবং রিড হেস্টিংস কারপুলিং করছিলেন। কারপুলিং করার সময় রেড হেস্টিংসের মাথায় একটা Idea আসে। সে র্যান্ডলফকে সেই Idea এর ব্যাপারে জানায়। দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, তারা DVD ব্যবসায় করবে। তবে তাদের DVD ব্যবসায়ের ধরনটা অন্য সবার চেয়ে কিছুটা ব্যতিক্রম ছিলো। তারা প্রথমে মেইলের মাধ্যমে Compact Disk বিক্রি করতো। তারা প্রথমে পরীক্ষামূলক ভাবে এটা শুরু করেছিলো। এরপর রেড হেস্টিংস একটা ঘর ভাড়া করলো এবং তখন তার কাছে আড়াই মিলিয়ন ডলার ছিলো। সম্পূর্ণ অর্থই তিনি তার নতুন DVD ব্যবসায় বিনিয়োগ করলেন। তার সাথে মার্ক র্যান্ডলফও যোগ দিলো। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তারা DVD Video Rental এর ব্যবসায় পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছিলো। ২০০১ সালে তারা তাদের ব্যবসায় সম্প্রসারনের জন্য অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসের সাথে যোগাযোগ করে। অ্যামাজন তখন ১৬ মিলিয়নের বিনিময়ে Netflix অধিগ্রহনের প্রস্তাব দেয়। মার্ক র্যান্ডলফ এই প্রস্তাবে রাজী থাকলেও রেড হেস্টিংস জেফ বেজোসের সেই প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে দেন। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে Netflix লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছিলো। তখন হেস্টিংস এবং র্যান্ডলফ Netflix কে ব্লকবাস্টারের কাছে ৫০ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। ব্লকবাস্টারের সিইও অ্যান্টিওকো( John Antioco) তাদের প্রস্তাবকে এক ধরনের রসিকতা মনে করে প্রত্যাখ্যান করেন। পরে অবশ্য অ্যান্টিওকে তার ভুল বুঝতে পেরেছিলো কারন ২০০১ সালের মাঝে ব্লকবাস্টার কোম্পানীর পথে বসার মতো উপক্রম হয়েছিলো অন্যদিকে Netflix তখন তাদের মার্কেট গুছিয়ে নিয়েছে। ২০০১ সাল Netflix এর জন্য একটি প্রত্যাবর্তনের সাল ছিলো কারন এই বছর তাদের চাহিদা আগের চেয়ে কয়েকগুন বেড়ে গিয়েছিলো। তারপর থেকে শুরু হলো নতুন এক গল্প, প্রত্যাবর্তনের গল্প।
২০০৩ সালে Netflix ৬.৫ মিলিয়ন ডলার আয় করে, ২০০৪ সালে যেটা বেড়ে গিয়ে ৪৯ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। ২০০৭ সালের জানুয়ারীতে Netflix একটি Streaming Media Service চালু করে। তখন Live Streaming এর জন্য মাত্র ১০০০ সিনেমা ছিলো। তবে তাদের সংরক্ষনে আরো ৭০ হাজার সিনেমা ছিলো।
২০১১ সালে Netflix বেশ কয়েকজন নির্মাতার সাথে Blu – Ray- player এর মতো HD Picture Streaming করার সেবা চালু করে। যা তাদের Brand Value কে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। ১২ই জুলাই তারা নতুন একটি Subscription Fee চালু করে। যেখানে তাদের Streaming সেবা নেওয়ার জন্য ব্যবহারকারীকে ৮ ডলার চার্জ দিতে হবে।
২০১২ সালের ১৮ই অক্টোবরে Netflix Denmark, Finland, Sweden এবং Norway তে তাদের Service চালু করে। ডিসেম্বরে তারা বিশ্বের অন্যতম সেরা ফিল্ম প্রোডাকশন হাউস Disney এর সাথে চুক্তি করে। ২০১৩ সাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত Video Streaming Platform গুলোর মাঝে এখনও সেরা অবস্থানে রয়েছে Netflix.
Netflix এর বর্তমান সদর দপ্তর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যান্জেলসের ১০০ উইনচেস্টার সার্কেলে অবস্থিত। Smart এবং আধুনিক চিন্তা সম্পন্ন ৬৭০০ জন কর্মচারীকে নিয়ে Netflix তাদের Official কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে।
Netflix এর সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোম্পানীর বর্তমান আয় ৩৪.৯৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত বছরে যা ছিলো ৩৩.৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ধারনা করা হচ্ছে, ২০২৫ সালে Netflix এর আয় ৩৬ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় 42 হাজার কোটি টাকা ছাড়াতে পারে।
Netflix Monthly Subscription এ কাজ করে, একটি নির্দিষ্ট ফি দিয়ে অনলাইন স্ট্রিমিং Content গুলোর acces গ্রাহকদের অফার করে থাকে। যার ফলে গ্রাহকরা তাদের পছন্দের সিনেমা, ওয়েব সিরিজ, টিভি শো, এবং ডকুমেন্টারিগুলি কোন বিজ্ঞাপনের ঝামেলা ছাড়াই উপভোগ করতে পারে।
সাবস্ক্রিপশনের মাধ্যমে, ব্যবহারকারীরা তাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্য পৃথক প্রোফাইল তৈরি করতে পারে। মূলত তাদের এই ধরনের পরিকল্পনার জন্যই Netflix বর্তমানে পরিবার এবং ব্যক্তিদের কাছে একটি জনপ্রিয় ওয়েবসাইট হয়েছে।
এটি মূলত বিভিন্ন চাহিদা এবং বাজেট উপযোগী বিভিন্ন সাবস্ক্রিপশন প্ল্যান অফার করে থাকে। তাদের বেসিক প্ল্যান থেকে শুরু করে প্রিমিয়াম প্ল্যান পর্যন্ত রয়েছে। Basic Plan এ তারা শুধুমাত্র একটি ডিভাইসে Streaming করার অনুমতি দেয় অন্যদিকে Premium Plan এ তারা একসাতে ৪ টা Device এ Ultra HD Streaming করার অফার করে থাকে।
Netflix এর ব্যবসায়ের পদ্ধতি অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা বলেই তারা বর্তমানে এতোটা সফল হয়েছে। বিশেষ করে ব্যবহারকারীদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য যে সকল Feature রাখা প্রয়োজন, তারা তাদের সাইটে সেই গুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে থাকে।
বর্তমানে বাংলাদেশেও Netflix এর জনপ্রিয়তা বেড়ে চলেছে। বর্তমানে এশিয়া, ল্যাতিন আমেরিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকায়
এর Subscription Fee কমানো হয়েছে। কিন্তু নেটফ্লিক্স তার সবচেয়ে বড় দুটি বাজার উত্তর আমেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপে
দাম বাড়ানোর কথা থাকলেও আর বাড়ানো হচ্ছে না।
প্রতিটা জিনিসেরই দুটো দিক থাকে। একটা ভালো অপরটি খারাপ । Netflix ও সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। এরও কিছু খারাপ দিক রয়েছে। ২০১৯ সালের ডকুমেন্টারি দ্যা ডেভিল নেক্সট ডোরের নির্মাতারা ১৯৮৫ সালে নাৎসি বাহিনীর মৃত্যু শিবিরের অবস্থান দেখানোর জন্য একটা মানচিত্র অংকন করে, সেটা ভিডিও আকারে প্রকাশ করে। যেটি Netflix এ প্রদর্শন করা হয়। তারপর থেকেই শুরু হয় সমালোচনা।
Netflix এর খারাপ দিক গুলোর মাঝে অন্যতম একটা দিক হলো এখানে এমন অনেক মুভিই রয়েছে, যা LGBTQ ছাড়াও অনেক বিতর্কিত বিষয় গুলো স্বাভাবিক ভাবে তুলে ধরে ।
২০১৮ সালে Netflix এ সম্প্রচারিত জনপ্রিয় মুভি ট্রাভেলার্স সিরিজ এবং বার্ড বক্স এ ২০১৩ সালের সত্যিকারের Train Accident এর স্টক ফুটেজ ব্যবহার করা হয়েছিলো। যেটা নিয়েও পরবর্তীতে অনেক বিতর্ক হয়।
ব্রাজিল এবং ইসরায়েলের কিছু বিতর্কিত সিনেমা রয়েছে Netflix এ, যেগুলোতে রাজনীতির কিছু লোমহর্ষক ঘটনা দেখানো হয়েছে। রাজনীতির আড়ালে কিছু নিকৃষ্ট ঘটনা নিয়ে নির্মিত এই সিনেমাগুলো Netflix এ প্রচার করা হয়। যেগুলো সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে প্রভাবিত করছে।
এসকল বিভিন্ন কর্মকান্ডের ফলে Netflix কে সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, জার্মানি এবং নিউজিল্যান্ডের সরকারের পক্ষ থেকে তাদের দেশের বিতর্কিত সিনেমা প্রদর্শনের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
২০১৩ সালে Netflix এর বিরুদ্ধে ভোক্তা গোপনীয়তা ভঙ্গ করার মামলা করা হয়। সেই ভোক্তা গোপনীয়তা মামলা নিষ্পত্তি করতে Netflix কে ৯ মিলিয়ন ডলার জরিমানা দিতে হয়েছিলো।
জনপ্রিয় এই কোম্পানীর খারাপ দিক গুলো বলে শেষ করা যাবে না। Netflix এ প্রচারিত কিছু টিভি সিরিজ এবং আমেরিকান সিনেমা রয়েছে। যেগুলোতে অতিমাত্রায় ধূমপানের দৃশ্য রয়েছে। এই বিষয় গুলো তরুন সমাজের উপর প্রভাব পড়বে জেনেও Netflix অনবরত ভাবে এগুলো প্রচার করে যাচ্ছে।
Netflix একদিকে যেমন সারাবিশ্বকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে অন্যদিকে তাদের কিছু কর্মকান্ডের জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিতও হয়েছে। তাছাড়া প্রতিযোগিতামূলক এই সাম্প্রতিক বিশ্বে প্রতিনিয়ত অসংখ্য কোম্পানীই টাইমলাইনে চলে আসছে আবার অনেকেই হারিয়ে যাচ্ছে অতল গহ্বরে। দিনশেষে আসলে কে কোথায় থাকে..? সেটা নির্ণয় করাটা খুব মুশকিল।
এখন Netflix কতোদিন তাদের মার্কেট ধরে রাখতে পারে…? সেটাই দেখার বিষয়।