রেল চুক্তি নাকি দেশ বিক্রি? Bangladesh-India Train Transit
ভারতের সাথে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সম্পর্ক এবং বিভিন্ন চুক্তি নিয়ে কম জল ঘোলা হয় নি। এই ঘোলা জল আরো ঘোলা হয়ে যায় যখন ২০২৪ সালের ২১শে জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন। বলা যায়, বাংলার ইতিহাসে এই দিনটি একটি ঐতিহাসিক দিন। কারন, এই দিনে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করা নরেন্দ্র মোদির সাথে প্রধানমন্ত্রী একটি বৈঠকে অংশ নেন। যেখানে দুই দেশের সরকার প্রধানের সম্মতিতে মোট ১০ টি চুক্তি সই করা হয়। এগুলোর মাঝে সবচেয়ে বেশী আলোচিত হচ্ছে, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের রেল ট্রানজিট সুবিধা। ইতিমধ্যে এটা নিয়ে অনেক আন্দোলনও শুরু হয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন হলো, এই রেল চুক্তিতে বাংলাদেশ আসলে কতোটা লাভবান হচ্ছে…? এই চুক্তির আড়ালে ভারতের কোন স্বার্থ লুকিয়ে নেই তো..? এই রেল ট্রানজিট ভবিষ্যতে বাংলাদেশে ব্যবসার জন্য কি লাভ হবে না ক্ষতি হবে…? এই বিষয়গুলো নিয়েই মূলত বিজনেস ম্যানিয়ার আজকে ব্লগটি।
চুক্তি নিতে বিস্তারিত বলার আগে আমাদের যেতে হবে আরো পেছনের দিকে এবং উদঘাটন করতে হবে ঠিক কি কারনে ভারত এই চুক্তি করতে এত ব্যাকুল। আর ভারতের কি সুবিধা হবে এই চুক্তির ফলে । ভারতের মাঝে ৭টা রাজ্য রয়েছে যেটা Seven Sisters নামে পরিচিত, সেখানে প্রায় সব সময়ই কোন না কোন সময় দাঙ্গা হাঙ্গামা লেগেই থাকে। ভারত সরকার সব এই জায়গাগুলো নিয়ে অনেক চিন্তিত থাকে, কারন সেখানকার স্থানীয় লোকদের সাথে সেখানকার সামরিক বাহিনীদের অনেকবারই সংঘর্ষ হয়েছে। সেটাও কোন বিষয় ছিলো না। কিন্তু সমস্যাটা হলো এখানে একটা প্রদেশ রয়েছে যার নাম অরুনাচল প্রদেশ। যেই প্রদেশ নিয়ে চীনের সাথে বেশ কয়েকবারই ভারতের সংঘর্ষ হয়। ভারত সরকার এই অরুনাচল প্রদেশের সাথে একটা ভালো সম্পর্ক তৈরী করতে চায় কিন্তু বিভিন্ন কারনে তারা সেটা করতে পারে না। এবার তারা বুদ্ধি করে বাংলাদেশের সাথে রেল ট্রানজিটটা করে ফেলে যাতে ঐ প্রদেশের সাথে তাদের ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। কারন সেই প্রদেশ থেকেই ট্রেনের যাত্রা টা শুরু হবে। রেল ট্রানজিটের ফলে ভারতের উত্তর পশ্চিম থেকে উত্তর পূর্বে যেতে দূরত্ব কমে যাবে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। এতে একদিকে যেমন ভারতের জ্বালানী খরচ কম ব্যয় হবে আর অন্যদিকে তাদের সময়ও অনেকটা বেঁচে যাবে। ভারতকে এই সুবিধা দিতে গিয়ে বাংলাদেশ বিশাল একটা সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে, কারন চীনের সাথে ভারতের সীমান্ত নিয়ে যেই ঝামেলাটা রয়েছে, কোন কারনে যদি সেটা বেড়ে যায়। আর তারা যদি তাদের বিশ্বমানের Intercontinental Ballistic Missile দিয়ে ভারতের সীমান্তে আক্রমন চালায়, তাহলে কিন্তু বাংলাদেশও এক বিরাট হুমকীর সম্মুখীন হতে পারে। কারন তারা যদি বাংলাদেশের রেল লাইনের উপর কোন কারনে হামলা চালায়, তাহলে সেটা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশ এবং ভারতের মাঝে মোট ৫ টি ট্রেনের মাঝে ২টা হলো মালবাহী আর বাকি ৩টা হলো যাত্রীবাহী।
ভারত – বাংলাদেশ রেল ট্রানজিটের ফলে ভারত বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে কলকাতা থেকে ১২ টি রুটে পণ্য এবং যাত্রী চলাচল করতে পারবে। নতুন পরিকল্পনার আওতায় মোট ১ হাজার ২৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথের ১৪টি সেকশন থাকবে। তার মাঝে বাংলাদেশের ভেতরে থাকবে ৮৬১ কিলোমিটার।
ভারতের ট্রেন এতোদিন বাংলাদেশের সীমান্তে এসে ইঞ্জিন পরিবর্তন করে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ওপর বাংলাদেশের ইঞ্জিনে চলতো কিন্তু ট্রানজিট চালু হলে, ভারতের রেলগাড়িকে আর সেই ইন্জিন পরিবর্তন করতে হবে না।
ভারত বাংলাদেশের এই ট্রানজিটকে সহজ কথায়
ওপেন ডোর’ পলিসি বলে। এই সম্পর্ক উন্নয়নের মূল কথা হলো, ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমতাভিত্তিক উন্নয়নের সুযোগ দেওয়া। আঞ্চলিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি চমৎকার ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে। কারন দেশের কোস্ট লাইন বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য করার বিশাল সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এই সুযোগটি কিন্তু প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বা নেপাল বা ভুটানের নেই। সে জায়গায় বাংলাদেশ তার ভৌগোলিক অবস্থানের সুযোগ নিতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে ভারত কতোটা সহায়ক হতে পারে সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামো বহুমাত্রিক। ভারত বাংলাদেশের যে রেলপথ দিয়ে আন্তঃদেশীয় যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ করতে চায়, সে রেলপথের জন্য পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা করতে প্রয়োজন, কারন অন্য একটি ভারতের ট্রেন যখন বাংলাদেশে ঢুকবে, তখন কিন্তু অপারেশনাল ডিজরাপশন তৈরি হবে।।শুধু তাই নয়, সিকিউরিটির জন্যও সেখানে আলাদা খরচ রয়েছে। এখন অবকাঠামো অবচয় কত হবে প্রতি বছর সেটাও হিসাব করে বের করতে হবে। কারন এর সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতিও জড়িয়ে রয়েছে। ভারত যে সুবিধা পাবে তা যেন বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানও সমভাবে পায়। সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
২০২২ সালে ভারত বাংলাদেশকে বিনা Toll এ তাদের ভূমি ব্যবহার করে ট্রানজিট সুবিধা দেয়। যদিও তা সীমিত ক্ষেত্রে কার্যকর হয়েছে। এখন একইভাবে, India ও কিন্তু খুব সীমিত পরিসরে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা নিচ্ছে।
বাংলাদেশ ভারতকে ট্রান্সশিপমেন্ট বা ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে ২০১০ সাল থেকে। তবে সেটা ২০১৬ সালে পরীক্ষামূলক চালু হয়। ২০২৩ সালে Chattogram ও Mongla পোর্ট ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়।
তবে ট্রানজিটের কারনে Communication এবং Bilateral Trade এ অগ্রগতির পাশাপাশি, বাংলাদেশ ও ভারতের নাগরিকরা দু দেশে যাতায়াতে আরো স্বাচ্ছন্দ্যে ও দ্রুত গতিতে করতে পারবে।
ভারত বাংলাদেশ রেল ট্রানজিট বাংলাদেশের ব্যবসায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ও নতুন দ্বার উন্মোচন করবে বলে অনেক অর্থনীতিবিদরাই ধারনা করছেন।
কারন, বাংলাদেশের Economic Growth প্রয়োজন। এজন্য অন্য দেশের সাথে Connectivity এর কোন বিকল্প নাই। যদি শুধু নিরাপত্তার কথা বলে Regional Connectivity তে বাংলাদেশ যুক্ত না হয়, তবে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বের মাঝে একটি Developed Country হওয়া সম্ভব নয়।
২০৪১ সালে বাংলাদেশ Tax-GDP Ratio ২২% করতে চায়। বাংলাদেশের জিডিপির তুলনায় রাজস্ব আদায় খুবই কম। সে ক্ষেত্রে ট্রেনের Toll, fee এর মাধ্যমে অনেক রাজস্ব আদায় করতে পারবে বাংলাদেশ।
পাশাপাশি আরেকটি বিষয় হলো ২০২৬ সালের ২৪ শে নভেম্বর বাংলাদেশ LDC থেকে উত্তরণ করবে। তখন WTO এর নীতিমালা অনুসারে Import Duty – যা রাজস্বের বৃহৎ উৎস, তা কিন্তু আগের মত পাওয়া যাবে না৷ MFN নীতি অনুসরণে Trade Liberalisation করতে হবে। সে ক্ষেত্রে Toll এর মাধ্যমে রাজস্ব আদায় এবং Lateral Economic Benefit অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
ভারতের মত বৃহৎ ভোক্তাবাজারে আমদানি রপ্তানিতে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার হলে, তা বিশাল অর্থনৈতিক লাভের সুযোগ তৈরি করবে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ বাড়বে।
মনে করুন, ভারতের নয়াদিল্লিতে একটি Maaza জুস কারখানা আছে৷ এখন এই Maaza জুসটি তারা অনেক দূরে যেমন: Seven Sisters বা ৭ রাজ্যে রপ্তানি করবে। এখন ট্রানজিট সুবিধা পেলে ভারত বাংলাদেশের সিলেট বা কুমিল্লাতে ইচ্ছা করলে Maaza Factory নির্মাণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে একদিকে যেমন Investment হবে ঠিক তেমনি অন্যদিকে Employment ও হবে অনেক। যার প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে যদিও ভারত আসলে বাংলাদেশকে এতো সুবিধা দেবে কিনা তা নিয়ে দেশের জনগন বেশ চিন্তিত ।
নিজের স্বার্থেই ভারত বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ বাড়াতে বিনিয়োগ বা অর্থায়ন করবে।
আঞ্চলিক যোগাযোগ বা Regional Connectivity এবং Trade বাড়াতে ট্রানজিট–ট্রান্সশিপমেন্ট ভূমিকা রাখবে। Nepal, Bhutan এর মতো Landlocked Countries, ASEAN ভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। ফলে বাংলাদেশ Geopolitically আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
ভারতকে প্রদত্ত এ বিশেষ সুবিধাটি ভারতকে ব্যাপকভাবে লাভবান করবে এবং ভারত বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।
ভারতের এ নির্ভরতাকে বাংলাদেশ Bargaining Tool হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। যেমনঃ কোন এক সময় বাংলাদেশ বলল, Non Tariff Barriers, সীমান্ত সমস্যা, সমুদ্রবিরোধ নিষ্পত্তি বা পানিবণ্টন চুক্তি না হলে আমরা ট্রানজিট–ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বন্ধ করে দেবো। তখন কিন্তু ভারত Consider করতে বাধ্য হতে পারে।
এখন দেখার বিষয়, ভবিষ্যতে ভারতের সাথে তিস্তা চুক্তি সহ অন্যান্য চুক্তিগুলো কোন পর্যায়ে যায়…? তবে ভারত বাংলাদেশের রেল ট্রানজিট চুক্তি সেই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ভারত যদি উপকারের কথা মনে রাখে, তাহলে অবশ্যই বাংলাদেশকে সেই উপকারের প্রতিদানটা ভারতের অবশ্যই দেওয়া উচিৎ।
এই ব্যাপারে আপনার কি মতামত..? কমেন্ট করে জানিয়ে দিবেন।