দুই ভাইয়ের শেয়ার মার্কেট জয়! Zerodha’s Success Story
ভারতে বর্তমানে প্রায় ৭২,০০০ এর বেশি স্টার্টআপ রয়েছে যার মধ্যে রয়েছে ১০০’র ও বেশি ইউনিকর্ন কোম্পানি । এরই মাঝে একটি ভারতীয় স্টার্টআপ জিরোধা কে নিয়ে আজ কথা বলা হবে যাদের বিজনেস শুরু হয়েছিল মাত্র জিরো ডলার হাতে রেখে। যা পরবর্তী ১০ বছরে রূপ নেয় ২০০ কোটি ডলারের বিজনেসে। এবং তাদের এই জার্নিতে ছিল না কোন ফান্ডিং অথবা চটকদার মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি। একদিকে বড় টেক কোম্পানিগুলো যখন কোটি কোটি টাকা লোকসানের মুখে চলছে।সেখানে জীরোধা ২০২২ সালে এসে প্রায় ৫০০০ কোটি রুপী আয় করে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে আমরা কেউ কি ভবিষ্যতে এমন কোনো বিজনেস দাঁড় করাতে পারবো? এটা কি আদৌ সম্ভব!
সম্ভব! অবশ্যই সম্ভব! তবে কিভাবে তা জানতে হলে পড়তে হবে বিজনেস ম্যানিয়ার আজকের ব্লগটি।
Zerodha হল একটি ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস কোম্পানি যা ভারতীয় খুচরা বিনিয়োগকারী এবং ব্যবসায়ীদের ডিসকাউন্ট ব্রোকারেজ সেবা দিয়ে থাকে। তারা স্টক মার্কেট, কারেন্সি এবং কমোডিটি মার্কেট, মিউচুয়াল ফান্ড সহ বন্ডে বিনিয়োগ এবং ট্রেডিং সেবা প্রদান করে। বর্তমান গ্রাহক সংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে Zerodha হল ভারতের বৃহত্তম ব্রোকারেজ ফার্ম। বর্তমানে এর গ্রাহক সংখ্যা ৬০ লক্ষেরও অধিক। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব হল?
এই প্রশ্নের উত্তর এসেছে সরাসরি ভারতীয় স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের সবচেয়ে কিংবদন্তি উদ্যোক্তাদের একজন কুনাল শাহের তরফ থেকে।
জিরোধা নিয়ে কুনাল শাহের চমৎকার সব বিজনেস ফ্যাক্টের দিকে একটু পরে যাচ্ছি।
তার পূর্বে চলুন জেনে নেই জিরোধা কোম্পানির মূল নায়কদের ব্যাপারে। Zerodha এর প্রতিষ্ঠাতা এবং CEO নিথিন কামাথ মাত্র ১৭ বছর বয়সে স্টক ট্রেডিং শুরু করেছিলেন। তিনি বন্ধুদের মাধ্যমে শেয়ার বাজারে পরিচিত হলেও, পরে তিনি পেনি স্টক ব্যবসা শুরু করেন এবং প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। কিন্তু ২০০১-০২ ভারতের শেয়ার মার্কেট ক্র্যাশে সে সব হারিয়ে ফেলেন। এর পর নিথিন একটি কল সেন্টার এ চাকরী করেন, এর পর তিনি সাব-ব্রোকার হিসেবে রিলায়েন্স মানি তে যোগ দেন এবং বড় বড় ক্লায়েন্ট অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করে বেশ অর্থ উপার্জন করেন।
নিখিল কামাথ, জিরোধার সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং সিটিও, তার ভাইয়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন।
খামখেয়ালি কিন্তু জিনিয়াস নিখিল শুধুমাত্র দাবা খেলার নেশায় দশম শ্রেণির পর স্কুল ছেড়ে দেয়!
কিন্তু ১৭ বছর বয়সে নিখিলকেও একটি কল সেন্টারে পুরো সময় কাজ শুরু করতে হয়। এর পাশা পাশি তিনি তার ভাই এবং বন্ধুদের অনুসরণ করে শেয়ার ব্যবসা শুরু করেন। নিখিল ট্রেডিংয়ে আরও অভিজ্ঞ হয়ে উঠলে সাব-ব্রোকার হিসাবে way 2 wealth এ যোগ দেন।
তাহলে, কীভাবে এই দুই ভাই জিরোধা প্রতিষ্ঠার চিন্তায় মাথায় এসেছি্ল । চলুন তা বের করা যাক।
২ কামাথই ব্রোকারেজ ইন্ডাস্ট্রির বেশ কিছু বিষয় নিয়ে চরমভাবে ডিপ্রেসড ছিলেন। এই ইন্ড্রাস্ট্রিতে অনেক বেশি খরচ এবং স্বচ্ছতার অভাব তাদের বরাবরই ব্যাথিত করতো। যার ফলে তারা মনে মনে তারা এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরির প্ল্যান করছিলেন যেখানে মানুষ সহজে এবং লিমিটেড বাজেটে ট্রেডিং করতে পারবে।
এরই প্রেক্ষিতে ২ ভাই মিলে ২০১০ সালে “জিরো” এবং “রোধা” নাম মিলিয়ে জিরোধা কোম্পানি নামের নতুন একটু কোম্পানির কাজ শুরু করেন। এবং এটি ছিল ভারতের সর্বপ্রথম ডিস্কাউন্ট ব্রোকারেজ কোম্পানি । এখানে জিরো মানে শূণ্য এবং সংস্কৃত শব্দ রোধা মানে বাঁধা হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। যখন দুটি শব্দ একত্রিত হয়, তখন এর অর্থ “কোন বাধা নেই” বা “বাধাশূন্য “। তাহলে, কীভাবে তারা বাধাগুলি দূর করে ভারতের বৃহত্তম ব্রোকারেজ কোম্পানিতে পরিণত হয়েছিল? তারা সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি ইউসার ফ্রেন্ডলী ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম চালু করেছে।
যেখানে তারা প্রতিটি ট্রেডে শুধুমাত্র ২০ রুপী ফি চার্জ করত, এবং বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ ফি মাত্র ৩০০ রুপী নিত গ্রাহকদের থেকে। এরই মাধ্যমে জিরোধা অনেক পুরনো স্টক ব্রোকারদের সিন্ডিকেের ভাঙতে সক্ষম হয়।
এরপর ২০১৯ সালের দিকে অর্থ্যাৎ ৯ বছরে জিরোধা একটু একটু করে নিজেকে বৃহত্তম খুচরা স্টক ব্রোকার হিসাবে তৈরি করে নেয়। স্টক এক্সচেঞ্জে নিয়মিত ২% করে ভলিউম রাখে নিজেদের দখলে।
কম খরচে ট্রেডিং ফিসহ বিভিন্ন সার্ভিস নিয়ে জিরোধা ধীরে ধীরে নিজেকে বড় করতে থাকে। ইক্যুইটি ইনভেস্টে কোম্পানিটি জিরো ব্রোকারেজ সিস্টেমও চালু করে। কাইট ট্রেডিং প্ল্যাটফর্মের মতো ট্রেডিং টেক সলুশনও বের করে বসে জিরোধা। যার কারণে জিরোধা সম্পর্কে নতুন ট্রেডারেরা দ্রুত পজেটিভ চিন্তা করে ফেলে।
২০১৯ সালের মধ্যে কোম্পানিটি স্বচ্ছতা এবং উদ্ভাবনের মাধ্যমে ট্রেডিং জগতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করে। চালু করে গ্রাহকদের ট্রেডিং নিয়ে আয়োজন করা বিভিন্ন কোর্স! যেখান থেকে নতুন ট্রেডাররা সহজেই ট্রেডিং সম্পর্কে শিখতে পারে, জানতে পারে, বুঝতে পারে পরবর্তী স্টেপ।
২০২৩ সাল পর্যন্ত জিরোধা ১০ মিলিয়নেরও বেশি ক্লায়েন্টদের সার্ভিস দিচ্ছে। বর্তমানে এই ক্লায়েন্টের পরিমাণ দ্রুত বাড়ছে।
এবার আসি ২ ভাইয়ের চমৎকার আইডিয়ার এই নতুন বিজনেস…জিরোধা কোম্পানির সফলতার গোপন রহস্যের ব্যাপারে। মূলত বেশকিছু যুক্তিযুক্ত কারণে জিরোধা আজকে নিজেকে সফল কোম্পানিতে পরিণত করতে পেরেছে।
এসব কারণের মাঝে শুরুতে বলবো জিরোধার প্রথাগত ট্রেডিং মডেলকে ভেঙে দেওয়ার সিস্টেমটির ব্যাপারে। জিরোধা ইক্যুইটি ইনভেস্টে জিরো ব্রোকারেজ সিস্টেম এবং ট্রেডিংয়ে একটি নির্দিষ্ট ফি চার্জ করে নতুন ট্রেডিং মডেল তৈরি করেছে। যা ট্রেডারদের জন্য কিছুটা হলেও সিকিউর! তাছাড়া যারা নতুন বিজনেস শুরু করছে তাদের জন্যে সিস্টেমেটিক্যালি একটি ভালো কাজে দিচ্ছে।
একই সাথে জিরোধা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ট্রেডারদের শিক্ষিত করার উপরও ফোকাস করছে। Trading Q&A- এর মতো উদ্যোগ নিয়ে কোম্পানিটি গ্রাহকদেরকে সচেতন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তৈরিতে সাহায্য করছে। এটিও কিন্তু আজকের সফল জিরোধার অন্যতম গোপন রহস্য।
শুধু কি তাই? জিরোধা কোম্পানির গ্রাহকদের প্রতি স্বচ্ছতা তাদের দিনকে দিন সফলতার উচ্চ শিখরে নিয়ে গেছে। ট্রেডিংয়ে বিভিন্ন অপারেশন এবং প্রাইজ নির্ধারণে স্বচ্ছতার প্রতি কোম্পানির প্রতিশ্রুতি জিরোধার ক্লায়েন্টদের মধ্যে অন্য রকমের আস্থা তৈরি করেছে।
নিঃসন্দেহে, জিরোধা ভারতের ব্রোকারেজ শিল্পে অগ্রগামী ভুমিকা পালন করেছে, কিন্তু তারা বেশ কিছু চ্যালেঞ্জেরও সম্মুখীন হয় যেগুলি তাদের অতিক্রম করতে হয়েছে।
প্রথমত বিপুল সংখ্যক লেনদেনের কারণে, প্ল্যাটফর্মটি মাঝে মাঝে প্রযুক্তিগত ত্রুটির মুখে পড়ে। যা ব্যবহারকারীদের ট্রেডিং এবং বিনিয়োগ বেশ ব্যাহত করে।
এখন পর্যন্ত, Zerodha এর কোন অফলাইন শাখা নেই কারণ বেশিরভাগ অপারেশন অনলাইনে সম্পাদিত হয়। সুতরাং, যদি কোন গ্রাহক কোন অসুবিধার সম্মুখীন হয়, তাদের তাদের অনলাইন গ্রাহক সহায়তা দলের সাথে যোগাযোগ করতে হয়। এবং প্রায়ই গ্রাহক সহায়তা দল গ্রাহকের উদ্বেগগুলি সমাধান করতে ব্যর্থ হয়।
এমনকি প্রতিষ্ঠাতারা এই বলে স্বীকার ও করেছেন যে তাদের কাস্টোমার সার্ভিস এখন জিরোধার দুর্বলতম দিক যদিও তা কাটিয়ে ওঠার জন্য কাজ করা হচ্ছে।
এখন, জিরোধার প্রতিযোগিতার দিকে নজর দেওয়া যাক।
কোভিড -১৯ লকডাউনের পর থেকে, ফিনান্সিয়াল সার্ভিস শিল্প একটি দুর্দান্ত উত্থান দেখেছে। এখন, আরও বেশি লোক স্টক ও শেয়ার মার্কেট এ বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।
যদিও ভারতের শেয়ার মার্কেট এ অনেক প্রতিযোগিতা রয়েছে কিন্তু এর মাঝেও একমাত্র জিনিস যা জিরোধাকে অন্য ব্রোকারদের থেকে আলাদা করে তা হল জিরোধার বিজ্ঞাপন এবং মার্কেটিং।
জিরোধা এমন একটি কমুনিটি তৈরি করেতে পেরেছে যা তাদের মুখের কথার মাধ্যমে নতুন গ্রাহকদের অর্জন করতে সাহায্য করেছে
মূলত আজকের এই জিরোধা এবং কামাথ ভাইদের লম্বা সফল যাত্রার পেছনে তাদের ছিলো লেগে থাকার মনমানসিকতা, ট্রেডিং নলেজ এবং চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবার ক্ষমতা! যা আপনার-আমরা থাকলে আমরা প্রত্যেকেই এমন একটি সফর বিজনেস সহজেই দাঁড় করাতে পারবো।
সেই সাথে দরকার যেকোনো বিজনেস মডেলের উপর একটি পরিষ্কার দৃষ্টিভঙ্গি। প্রযুক্তি, স্বচ্ছতা এবং গ্রাহকদের প্রতি বাড়তি গুরুত্ব নিশ্চিত করতে পারলেই এমন হাজারো সফল জিরোধার জন্ম দেওয়া সম্ভব।
ভারতীয় স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের সবচেয়ে কিংবদন্তি উদ্যোক্তাদের একজন কুনাল শাহ জিরোধার সাফল্যের মূল কারণ হিসাবে বলেন, যদি কোন উদ্যোগ তাদের এফিসিয়েন্সি ঠিক করতে পারে এবং সাধারণ মানুষকে সাহায্য করতে পারে তবে সেই উদ্যোগ শতভাগ সফল হবেই! যা করে দেখিয়েছে জিরোধা।
আরেকটু সহজভাবে বললে জিরোধার এই সফলতাকে WhatsApp এর সাথে তুলনা করা যায়। মানুষের প্রয়োজনীয়তার তাগিদেই কোম্পানিটি আজ সফল। সেই সাথে জিরোধার সহজ ইউজার ইন্টারফেস সিস্টেম তো রয়েছেই!
সো ভিউয়ার্স! এতোসব বিজনেস থিওরি জেনে আপনি এখন কি ভাবছেন? ট্রেডিং নাকি টেক ইন্ডাস্ট্রি? কোন সেক্টরে ভবিষ্যতে আপনার সফল এনরোল ঘটছে? কমেন্ট বক্সে আমাদের জানাতে ভুলবেন না। আর বিজনেস দুনিয়ার আরো অজানা তথ্য জানতে বিজনেস ম্যানিয়া নিউজলেটারটি সাবস্ক্রাইব করুন।