General Electric : বিশ্বকে বদলে দেয়া এক প্রতিষ্ঠান | The Story of GE in Bangla
গোটা বিশ্বে যে কয়েকটি আবিষ্কার মানবসভ্যতাকে সামনে এগিয়ে যেতে সরাসরি সাহায্য করেছে, তার মধ্যে বৈদ্যুতিক বাতি অন্যতম। যাদের কল্যাণে আজ আমরা বিদ্যুতের আলো ব্যবহারের সুফল পাচ্ছি, প্রথম সেই বাল্বের ফিলামেন্ট কিংবা চিকিৎসা বিজ্ঞানে অভুতপুর্ব উদ্ভাবন- এক্স রে মেশিন অথবা যেই নীল আর্মস্ট্রং ছোটবড় আমাদের সকলের কাছে সুপরিচিত চন্দ্রবিজয়ের জন্যে, সেই চন্দ্র অভিজানে তিনি যে বুট জুতা পড়েছিলেন তার প্রস্তুতকারক ,যে একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান , যার রয়েছে ১৩০ বছরের ও বেশি পুরনো ইতিহাস। একটি আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি যারা সময়ের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে একের পর এক নিত্যনতুন যুগান্তকারী প্রযুক্তি উদ্ভাবন দ্বারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌছে গেছে। বর্তমানে যার মোট কর্মী সংখ্যা প্রায় ৩০ লক্ষ এবং বার্ষিক রাজস্ব ১৫০ বিলিয়ন ডলারের ও বেশি! বিদ্যুত,স্বাস্থ্য কিংবা শুধু মহাকাশ শিল্প ই নয় , সারা বিশ্ব জুড়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানী, গ্যাস, যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিটা সেক্টরেই তাদের সাফল্যের ইতিহাস ও অবিস্বরনীয় অবদানের জন্যে যাদের কে আজ বলা হয় WORLD ENERGY LEADER.
আজকে জানবো শিল্পের ভবিষ্যত উদ্ভাবনকারী সেই GENERAL ELECTRIC বা GE এর গল্প। বিশ্বের সর্বোচ্চ বৃহত্তম কোম্পানিগুলোর মধ্যে যার অবস্থান ৩য়।
আচ্ছা আপনাদের কি মনে আছে সেই ছোটবেলায় মুখস্ত করা আধুনিক বৈদ্যুতিক বাতির জনক কে? হয়তো অনেকেরই টমাস আল্ভা এডিসন এর নামটি মনে পড়ে যেতে পারে। তিনি ছিলেন একজন আমেরিকান উদ্ভাবক এবং ব্যবসায়ী। মুলত আজকের এই general electric তার হাত ধরেই এতোটা পথ পারি দিতে পেরেছে। তিনি শুধু বৈদ্যুতিক বাতি ই নয়, ভিডিও ক্যামেরা, গ্রামোফোন, স্টক টিকার, ভোট ধারণকারী যন্ত্র, বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি এবং বিশ্বের সর্বপ্রথম ফিল্ম স্টুডিও the black maria তৈরিতেও রয়েছে তার অবদান। এডিসন ইতিহাসের অতিপ্রজ বিজ্ঞানীদের অন্যতম একজন বলে বিবেচিত, যার নিজের নামে ১,০৯৩টি মার্কিন পেটেন্টসহ যুক্তরাজ্যে, ফ্রান্স এবং জার্মানির পেটেন্ট রয়েছে।
সময়টা ১৮৭৬ সাল, এডিসন বৈদ্যুতিক আলো ব্যবস্থার বিকাশের জন্য EDISON LIGHT COMPANY প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও আলোর ফিলামেন্ট তৈরি করতে আরও এক বছর সময় লেগেছিলো। ১৮৭৯ সালে, তিনি বাল্ব লাইট তৈরি করেন এবং ১৮৮০ সালে এসএস কলাম্বিয়াতে বৈদ্যুতিক আলোর একটি প্রাথমিক সংস্করণ স্থাপন করা হয়েছিল।
এই সময়ে, থমাস এবং হিউসটনও তাদের আলোক ব্যবস্থা, আর্ক লাইটিং, উন্নত করছিলেন এবং এটির জন্য তাদের পেটেন্ট ছিল। এই সময়ে তারা আমেরিকান ইলেকট্রিক কোম্পানি শুরু করেন।
পরবর্তিতে ১৮৮৯ সালে, টমাস এডিসন তার অন্যান্য কোম্পানিগুলি EDISON LAMP COMPANY , EDISON MACHINE WORKS AND BERGMANN AND COMPANY একত্রিত করে EDISON ELECTRIC COMPANY গঠন করেন। তার কাজের জন্যে অর্থের প্রয়োজন হওয়ায় তিনি তার কোম্পানির একটি বিশাল ব্লক জে পি মর্গানকে দেন। যিনি ছিলেন পেশায় একজন ব্যাংকার। ফলে এডিসন ইলেকট্রিক কোম্পানির শেয়ারের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করেন জেপি মরগান ।
১৮৯২ সালে, জেপি মরগান এডিসন ইলেকট্রিক এবং থমসন-হিউস্টন ইলেকট্রিক এই ২ টি প্রতিযোগী কোম্পানিকে একত্রিত করার একটি সুদূরপ্রসারী উদ্যাগ নেন। ১৮৯২ সালে, এই দুটি কোম্পানি মিলিত হয়ে জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর ফলাফল খুবই ইতিবাচক ছিল। একই বছর জিই নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে (NYSE) ব্যবসা শুরু করে।
কিন্তু টমাস এডিসন ১৮৯৪ সালে GE থেকে পদত্যাগ করেন তবে পেটেন্ট থেকে অর্থ আয় সহ পরামর্শদাতা হিসাবে জিই এর সাথে থাকেন ।
জিই এর নাম এলে একজনের নাম না বললেই নয়। জ্যাক ওয়েলচ এর নাম শুনেছেন কখনো? তাকে জিই এর একজন কিংবদন্তী পরিচালকের আখ্যা দেয়া হয়। তার নেতৃতের কারনে তিনি বহুলাংশে আলোচিত ও সমালোচিত ও। তার সময়কালে জিই কোম্পানির শেয়ারের দাম চার হাজার শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। তিনি প্রায় ২০ বছর কোম্পানিতে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদে বহাল ছিলেন।
জিই এর প্রাথমিক বছরগুলিতে মুলত বিদ্যুৎ শিল্প যেমন – বৈদ্যুতিক বাতি, জেনারেটর এমনকি রেডিওর মতো অন্যান্য ক্ষেত্রে গবেষণা শুরু করে পাশাপাশি বৈদ্যুতিক পাওয়ার গ্রিড, ট্রান্সফরমারের উন্নয়ন ও বৈদ্যুতিক মোটর তৈরি করে আধুনিক বিশ্বে বিপ্লব ঘটাতে সাহায্য করে। আমেরিকার প্রথম কমার্শিয়াল পাওয়ার স্টেশন তৈরি করে জিই। এমন কিছু সফটওয়্যার তৈরি করে তারা যা ইলেক্ট্রিক সিস্টেম গুলাকে আরো দক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ , সুরক্ষিত এবং বিদ্যুৎ বিভ্রাট প্রতিরোধে সাহায্য করে।এছাড়াও বিদ্যুৎ সরঞ্জামে ব্যবহৃত গ্যাসের পরিবেশবান্ধব বিকল্প নিয়েও কাজ করে চলেছে। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ই নয় বরং বিশ্ব জুড়ে তাদের প্রযুক্তির উন্নয়ন ছড়িয়ে পড়ে।
পারকিনসনের মত রোগ নির্নয় সহজ হয়েছে জিই এর জন্যেই। বিশ্বের প্রথম ফুল-বডি ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স বা MRI মেশিন তৈরি করতে জিই কে বিজ্ঞানী আমেরিকান পদার্থবিদ এবং প্রকৌশলী ইভার ইয়েভার (( Ivar Giaever) সাহায্য করেছিলেন । এই অসামান্য কৃত্বের কারনে ইয়েভার 1973 সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার জিতেন। ইয়েভার ছাড়াও, জিই এর আরেক বিজ্ঞানী আরভিং ল্যাংমুইর ল্যাম্প ফিলামেন্ট নিয়ে গবেষণার জন্য 1932 সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন। তার কাজ জিইকে রক্তনালীগুলির প্রথম ছবি তুলতে সাহায্য করে।
এছাড়াও জিই গবেষক এইচ ট্রেসি প্রথম সিন্থেটিক হীরা তৈরি করেন,আরেকজন ক্যাথারিন ব্লগডেট অ-প্রতিফলিত কাঁচ তৈরি করেন। যা আজত সমস্ত ক্যামেরার লেন্স ও চশমায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
HA টারবাইন নামে একটি বিশেষ টারবাইন ব্যবহার করে বিশ্বের সবচেয়ে দক্ষ পাওয়ার প্লান্ট তৈরি করার জন্যে GE গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড অর্জন করে। এই টারবাইনটির বিশেষ্ত এই যে এটি দক্ষতার সাথে খুব কম জ্বালানীতে অধিক বিদ্যুৎ উতপাদন করতে সক্ষম। যা পরিবেশ বান্ধব।জলবিদ্যুত উৎপাদন , ভূপৃষ্ঠ থেকে গ্যাস, তেল অনুসন্ধান ও উত্তলনের করে থাকে জিই। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে জিই একটা Global Power House হয়ে উঠে ।
বিদ্যুতখাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশেও পদাচারনা আছে জিই এর। প্রথমদিকে সরকারি বিদ্যুতকেন্দ্রে অর্থায়ন ও প্রযুক্তি সরবরাহ করলেও পরবর্তিতে যখন বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ শুরু হল ,সেখানেও অর্থ ও প্রযুক্তি বিনিয়োগ করে, বর্তমানে সামিট কর্পারেশন ,ইউনিক গ্রুপ এবং রিলায়েন্স গ্রুপ এর মতো কোম্পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কৌশল গত অংশীদারীত্বে রয়েছে জিই। এছাড়াও নবায়নযোগ্য জ্বালানী, স্বাস্থ্য , এভিয়েশন ও যোগাযোগ খাতেও প্রযুক্তিগত সহায়তা ও অর্থায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের সাথে কৌশলগত অবস্থাম আরো বিস্তৃত করেছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের সাথে ২২ বছরের জন্যে ৫৮৩ মেগাওয়াট বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্যে চুক্তি করে।
RCA, NBC এবং হানিওয়েলের মতো কোম্পানির অধিগ্রহণ করে জিই নিজেদের কর্ম পরিসর আরো প্রসারিত করে। জিই এবং RCA মিলে প্রথম বাণিজ্যিক TEM বা transmission electron microscope নিয়ে আসে যা আজ রসায়ন ও জীব বিজ্ঞান গবেষণায় গুরুত্বপুর্ণ হাতিয়ার। এছাড়াও Asset performance management বা APM নামে একটি স্মার্ট প্রযুক্তির সাথে এভিয়েশন শিল্পকে পরিচয় করানো হয় যা থেকে বিশ্বের শত শত এয়ারলাইন্স ও বিমান অপারেটররা সহজেই ফ্লাইট সম্পর্কিত বিভিন্ন ডাটা বিশ্লেষণ করতে পারে। এমনকি ফ্লাইট চলাকালীন কোন সমস্যার মোকাবেলা করতেও এই প্রযুক্তি তাদের সাহায্য করে। ওয়াশিংটনডিসি, অস্টিন, টেক্সাস, দুবাই, সাংহাই, প্যারিসের মত বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে জিই এর সেবা কেন্দ্র রয়েছে। যার মাধ্যমে বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন ডিজিটালাইজ, পাওয়ার গ্রিড সুরক্ষা উন্নত করার মাধ্যমে বিমান ভ্রমনকে আরও বেশি নিরাপদ এবং নির্ভরযোগ্য করে তুলেছে।
জিই প্রথম লাইটওয়েট কার্বন ফাইবার কম্পোজিট দিয়ে তৈরি জেট ইঞ্জিন তৈরি করে । সাফরান এয়ারক্রাফট ইঞ্জিন এর সাথে যৌথ উদ্যেগে লিপ ইঞ্জিন ও তৈরি করে। CFM International এটির ডেভেলপ, প্রডাকশন এবং মার্কেটিং এর কাজ করে।এই ইঞ্জিন গুলি এতটাই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে যে best in class reliability achieve করেছে। এমনকি সমুদ্রের যান সাবমেরিন ডিটেক্টর ও জি ই এর অবদান।
মহাকাশ গবেষণা নিয়ে NASA কাজ করে এটি জানে না এমন লোক হয়ত খুজে পাওয়া যাবে না। তবে NASA ও কখনো কখনো তার কিছু প্রজেক্টে নির্দিষ্ট কোন উপকরন বা প্রযুক্তির জন্যে প্রায়শই বিভিন্ন কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। জিই ও তেমনই একটি কোম্পানি। জিই NASA ‘র জন্যে স্পেস লঞ্চার, স্যাটেলাইট তৈরি করেছে। আর ঐ যে নীল আম্রস্ট্রং এর সেই বুট জুতা জিই তাদের উদ্ভাবিত প্লাস্টিক ও সিলিকনের রাবারের মাধ্যমে তৈরি করেছিল।
জিই কমার্শিয়াল ফাইন্যান্স, জিই কঞ্জিউমার ফাইন্যান্স, জিই ইকুয়েপমেন্ট সার্ভিস এবং জিই ইন্সুরেন্স এর মাধ্যমে আর্থিক সেবাও দিয়ে থাকে।সময়ের সাথে সাথে জিই নিজেদের প্রসারিত করেছে নানা শিল্পে, আপডেট করেছে বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রবর্তনে। ২০১৫ এর ১৪ সেপ্টেম্বর নতুন একটি ইউনিট তইরির ঘোষণা দেয় জিই ডিজিটাল নামে। যা সফটওয়্যার ও আইটি ক্ষমতাকে একত্রিত করবে। জিই ডিজিটাল প্রযুক্তিতে ডাটা analylics করতে industrial internet of things (IIOT) তৈরি করেছে।
২০২১ এর নভেম্বরে জিই এনাউন্স করে তারা তাদের কম্পানিটি কে ৩ টি পৃথক ব্র্যান্ড এর আন্ডারে পরিচালনা করবে। ২০২২ সালের জুলাইয়ে তারা নতুন ব্র্যান্ডগুলোর নাম ঘোষণা করে। GE Aerospace, GE healthcare এবং GE vernova.
ভালো লাগলে লাইক দিন, সাবস্ক্রাইব করুন, বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন এবং সাথে থাকুন নিউজলেটার এর।