ঋণখেলাপী প্লেবয় থেকে দেশ পলাতক । Story of Vijay Mallya and Kingfisher Airlines
সাধারণত একজন মানুষকে ব্যাংক থেকে মাত্র ১ লক্ষ টাকার লোন নিতেই কাগজের উপর কাগজ সাবমিট করা লাগে আর লোন পরিশোধ করতে না পারলে নিজেদের বাড়ি বা জমি জমা, দোকান সব হারাতে হয় সেখানে একজন ব্যক্তি আইনের নাকের ডগার উপর ৮ হাজার কোটির লোন পরিশোধ না করে বিদেশে যেয়ে আরাম আয়াশে দিন কি দিন কাটিয়ে দিতে পারে?
১ মার্চ ২০১৬ ভারতের এস বি আই (SBI) কে সাথে নিয়ে প্রায় ১৭টির মতো ব্যাংক সুপ্রিম কোর্টে যেয়ে সুপারিশ করে যেন কিংফিশার (Kingfisher) গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান বিজয় মালিয়ার(Vijay Mallya) পাসপোর্ট(Passport) জব্দ করে দেওয়া হয় আর কোন ভাবেই সে যেন ভারত ছেডে পালাতে না পারে। সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টা বুঝতে পেরে ৩ মার্চই বিজয় মালিয়াকে কোর্টে উপস্থিত হতে বলে। কিন্তু এরই মধ্যে ২ মার্চ এ দিল্লি এয়ারপোর্ট(Airport) থেকে বিজয় মালিয়া প্রায় ৫৫টির মতো ব্যাগ আর প্রায় ৮ হাজার কোটি রূপী ঋণের বোঝা নিয়ে লন্ডনে(London) পাড়ি জমান।
কিন্তু কে এই বিজয় মালিয়া? আর কীভাবেই এত বিশাল অংকের একটা লোন নিয়ে সে দেশ ছেড়ে পালাতে পারলো ?
সে প্রশ্নের উত্তর জানার আগে আমাদের যেতে হবে ৬০ এর দশকে যখন ভিত্তাল মারিয়া ও লালিতা রামাইয়া দম্পতি এর ঘরে জন্ম নেয় বিজয় মালিয়া। কিন্তু জন্মের পর পরই তার বাবা মার মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়। তবে বিজয় মালিয়ার জীবনে আহামরী এ ঘটনার কোন প্রভাব পড়ে না। বিজয় মালিয়ার বাবা ভিত্তাল মারিয়া ছিলেন ভারতের সে সময়কার অ্যালকোহল(Alcohol) আর বেভারেজ (Beverage) ইন্ডাস্ট্রির প্রথম সারীর প্রতিষ্ঠান ইউ বি গ্রুপের (UB group) চেয়ারম্যান। আর আট দশটা বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিলিস্ট(Industrialist) এর পরিবারের মতো বিজয়ের বাবাও তাকে লন্ডনে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাঠিয়ে দেয়। এর কয়েক বছর পরই উচ্চ শিক্ষা শেষ করে বিজয় ভারতে এসেই বাবার বিজনেস(Business) এ যোগ দেয়। বিজয় তার উচ্চ শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে ইউ বি গ্রুপকে আরো ভাল ভাবে ঢেলে সাজাতে থাকেন।
ততদিনে মোহান ম্যাকিন (mohan meakin) নামের আর একটি কোম্পানি প্রতিদ্বন্দি হিসেবে চলে আসে। যাকে টেক্কা দিতে বিজয় ১৯৭৮ সালে কিংফিশার নামে এলকোহলিক ব্র্যান্ড(Alcoholic Brand) লঞ্চ করে। তবে শুরুর দিকে আশানুরূপ তেমন একটা প্রফিট(Profit) এনে দিতে পারে নি এই ব্র্যান্ডটি।
এরই মধ্যে এক পার্টিতে অবস্থানকালে আকস্মিক ভাবে মৃত্যুবরণ করে ভিত্তাল মারিয়া। বাবার মৃত্যুতে হতবিহবল হয়ে পরে বিজয়। কোম্পানির মালিকানা নিয়েও তাকে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয় বাবার মৃত্যুর পর। যদিও পরে বিজয়ই ইউবি গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন। বিজয় নির্বাচিত হওয়ার সময় ইউবি গ্রুপের টার্ন ওভার ছিল প্রায় ৩৫০ কোটি ডলার।
দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই মালিয়া আরো দুটি বিয়ার(Beer) ব্র্যান্ড বাজারে লঞ্চ করে। তবে তার কোনোটি বাজারে সেভাবে সাড়া ফেলতে পারে না। বাজারে টিকে থাকতে ব্র্যাণ্ড দুটিতে কাচের বোতলের বদলে ক্যান সিস্টেম চালু করা, পানীয় অ্যালকোহলের মাত্রা বাড়ানো সহ বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়। যা দ্রুতই এর গ্রাহকদের মাঝে জনপ্রিয় করে তোলে । বিজয়ের হাত ধরে প্রায় ৬ হাজার কোটির রুপির ভ্যালুএশন(Valuation) নিয়ে ভারতের সব থেকে বড় ব্র্যান্ডে পরিনত হয় ইউবি গ্রুপ। যা তাকে আরো উচ্চাভিলাশি করে তোলে । এর সাথে রয়েছিল বিজয়ের অদ্ভুত আর পাগলাটে স্বভাব । যা জন্ম দেয় বেশ কিছু ভুল সিধান্তের।
ভারতের কিংফিশার এয়ারলাইন্সের(Kingfisher Airlines) কথা অনেকেরই অজানা নয়। বিজয় মালিয়ার এই কোম্পানির গঠনের পেছনে রয়েছে মজার একটি ঘটনা। একমাত্র সন্তান সিদ্ধার্ত মালিয়ার ১৮ বছর উদযাপন উপলক্ষে বিজয় ছেলেকে এয়ারলাইন্স গিফট করার সিধান্ত নেয়। বিজয়ের খামখেয়ালিপনা শুনে পরিচালকগন সায় না দিলেও এক বছরের মাথাতেই পুরোপুরি কোম্পানির টাকা দিয়ে ১৩টি প্লেন (Plane) নিয়ে কিংফিশার এয়ারলাইন্স খুলে বসে বিজয় মালিয়া।
যাত্রার একদম শুরু দিক থেকেই কিংফিশার এয়ারলাইন্স মেইন ফোকাস(Focus) দেয় গুণমান আর উচ্চ মূল্যের ওপর। যেখানে অন্য এয়ারলাইন্সগুলো শুধু যাত্রীদের ম্যাগাজিন দিতো সেখানে কিংফিশার প্রতি সিটে ছোট ছোট মনিটর, ফ্রী ইয়ারফোন, ভালো মানের খাবার আর সুন্দরী সব এয়ারহোস্টেস(Air Hostess) দিয়ে বিমান পরিচালনা করত।
প্রথম এক বছর বেশ ভালোই ব্যবসা করে কিংফিশার। কিন্তু এই কিংফিশার এয়ারলাইন্সই কাল হয়ে দাঁড়ায় বিজয় মালিয়ার। যেখানে বাকি সব এয়ারলাইন্সগুলো নিজেদের খরচ কমানোর দিকে মনোযোগ দিতে থাকে সেখানে বিজয় মালিয়া একের পর এক বিমান তার এয়ারলাইন্সে যোগ করতে থাকে।। ২০০৯ এবং ২০১২ সালের মধ্যে কিংফিশার ৬ হাজার ৬শ কোটি রুপির বেশি লোকসান করে। আর তাই পুরো এয়ারলাইন্সই খরচ চলত ব্যাংক লোনের উপর। এই ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে প্রথম বছর ৯০০ কোটি এবং এর পরের বছর আরো ১ হাজার ৬০০ কোটির লোন নেয় বিজয় মালিয়া।
শুধু তাই না কিংফিশার এতটাই লোকসানে চলছিল যে কোন ক্লায়েন্টকেই (Client)ঠিক মতো পেমেন্ট(Payment) করা হচ্ছিল না। কেটারিং সার্ভিস(Catering Service) এর পেমেন্ট তারা প্রায় ৬ মাস বন্ধ রাখে ফলে খাবারের মান ও কমতে শুরু করে। ফলে যাত্রী সংখ্যা কমতে থাকে। অবস্থা এমন হয় যে কিংফিশার তাদের কর্মীদের বেতন ঠিক মতো দিতে পারছিলনা , তবুও বিজয় মালিয়ার ব্যাংক থেকে লোন নেওয়া বন্ধ হয় নি। যেখানে তিনি কর্মীদের বেতন ই দিচ্ছিলেন না সেখানে তিনি কিংফিশার থেকে বেতন হিসেবে প্রায় ৩৪ কোটি টাকা নিতেন মাসের প্রথমেই। এছাড়াও যে কোন উপলক্ষে সপ্তাহ ব্যাপী পার্টির আয়োজন তো চলতই ।
এরই মধ্যে পার্লামেন্টেও (Parliament) খবর ওঠে যে বিজয় মালিয়া সরকারের ১৫০ লক্ষ ডলার ট্যাক্স(Tax) না দিলেও ৩৪০ লক্ষ্ ডলার দিয়ে ফ্রান্সে নতুন একটা কোম্পানি কিনেছে। এবার বাকি সব ব্যাংক সহ সিবি আই (CBI) এটা বুঝতে পারে যে বিজয় মালিয়া ইচ্ছে করেই ঋন পরিশোধ করছেনা এতোদিন।
সামর্থ্য থাকার সত্ত্বেও বিজয় মালিয়া কোন লোন শোধ না করে এবার বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগ ওঠে। এসব কিছুর মধ্যে ২০১২ সালে কিংফিশার এয়ারলাইন্স এর লাইসেন্স(License) বাতিল করে দেওয়া হয়। তখন ও বিজয় মালিয়াকে গ্রেফতার সম্ভব হয়নি। কেননা ২০১০ সালের নির্বাচনে তিনি কার্নাটাকার রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। যদিও রাজ্যসভার কোন দায়িত্বই তিনি পালন করতেন না।
মালিয়াকে একাধিক বার দেশ না ছাড়ার এবং যেকোনো সীমান্ত পার না হওয়ার নোটিশ জারি করা থাকলেও ক্ষমতা এবং টাকার জোরে সে নোটিশই পাল্টে দেয়া হয়।
আর এরই সুযোগ নিয়ে ১ মার্চ ২০১৬ তে SBI কে সাথে নিয়ে ভারতের ১৭টি ব্যাংক বিজয় মালিয়ার বিরুদ্ধে করার পরের দিনই ৮ হাজার কোটি রূপী ঋণ খেলাপ করে বিজয় মালিয়া প্রায় ৫৫টি ব্যাগ নিয়ে দিল্লি এয়ারপোর্ট থেকে লন্ডনের উদ্দেশ্য পাড়ি জমান।
তারপরে আর কি। পরের ঘটনাগুলো খুব সাধারন। ২০১৭ এর ১৮ এপ্রিল লন্ডন পুলিশ তাকে গ্রেফতার করলেও ঠিক পরের দিনই তিনি জামিনে বেরিয়ে পরেন। এভাবে আরো বেশ কয়েকবার গ্রেফতার করা হলেও তাকে আর ভারতে আনা সম্ভব হয়নি। একদিনের কম সময়েই জামিনে বেরিয়ে পরেন।
আর এভাবেই সাধারন মানুষের ৮ হাজার কোটি রূপী আত্বসাৎ করে বিজয় মালিয়া লন্ডনে নিজের গার্লফ্রেন্ড এর সাথে আরামে দিন পার করছেন। আমাদের বাংলাদেশেও অহরহ এমন ঘটনা দেখতে পাই আমরা।
আমাদের দেশেও অনেক বড় কোম্পানি বা ব্যাক্তি ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্বসাৎ করেও দিব্বি সবার সামনে ঘুরে বেড়ালেও প্রশাসন কিংবা আইন রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান কিছুই করতে পারেনা, অথচ এখনো দেশের অনেক জনগনকেই অনাহারে বা অর্ধাহারে জীবন নির্বাহ করতে হয়। আমরা আশা করি একদিন হয়তো সব কিছুর বিচার হবে আর আমরাও পাবো সোনার বাংলাদেশ।
আজকের জন্য এই পর্যন্তই। ব্লগটি আপনাদের কাছে কেমন লাগলো তা কমেন্টে জানাবেন । সাম্প্রতিক বিষয়গুলো নিয়ে প্রতিদিন আপডেট পেতে চাইলে নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করে ফেলুন।