আনিল আম্বানির $42 বিলিয়ন হারানোর গল্প। The Rise & Fall of Anil Ambani
জুলাই ৬, ২০০২ গোটা ভারতকে অবাক করে দিয়ে এই দিন মারা যান রিলায়েন্স গ্রুপ এন্ড ইন্ডাস্ট্রি (Reliance Group & Industry)প্রতিষ্ঠাতা ধিরুভাই আম্বানি (Dhirubhai Ambani)। ইয়েমেনের (Yemen) গৃহযুদ্ধ চলার সময় মাত্র ৫০০ রূপী নিয়ে পরিবার নিয়ে ভারতে ফিরে আসা এই ভারতীয় শেষ বয়সে এসে হয়ে যান ভারতের অন্যতম একজন শীর্ষ ধনী। ফোর্বস (Forbes) এর তথ্য অনুযায়ী সে সময় প্রায় ৩০০ কোটি ডলারের সম্পত্তি নিয়ে তিনি ছিলেন পৃথিবীর ১৩৮তম ধনী ব্যক্তি। মৃত্যুর আগে আর আট দশটা বাবার মতো তিনিও চেয়েছিলেন যে তার দুই ছেলে মুকেশ আম্বানি(Mukesh Ambani) আর আনিল আম্বানি (Anil Ambani) তার ব্যবসাগুলো দেখে আরো বড় করবে। তার বড় ছেলে মুকেশ আম্বানি ছোট থেকেই কিছুটা চুপচাপ আর সাধারণ, লাইমলাইট (Limelight) , জনপ্রিয়তা এসব খুব একটা পছন্দ ছিল না তার। অন্য দিকে ছোট ছেলে আনিল আম্বানি ছিল এর পুরো উল্টো। আর তাই দুই ছেলে দুই ধরণের স্বভাবকে মাথায় রেখে ধিরুভাই মুকেশ আম্বানিকে বানান রিলায়েন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান (Chairman) আর ছোট ছেলে আনিলকে বানান ডিরেক্টর (Director)।
কিন্তু ২০০২ সালে বাবা ধিরুভাই আম্বানি এর মৃত্যুর পর থেকেই দুই ভাইয়ের মধ্যে ঝামেলার শুরু হয় কোম্পানিগুলোর দায়িত্ব সামলানো নিয়ে। যেমন রিলায়েন্স কমিউনিকেশন(Reliance Communication) একদম শুরু থেকেই মুকেশ আম্বানি পরিচালনা করলেও এটি চেয়ে বসে ছোট ভাই আনিল আম্বানি। দুই ভাই এর বিবাদ শেষমেশ এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছায় যে তা মিডিয়ার হেড লাইন হতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত দুই ভাইয়ের মধ্যে বিবাদ দূর করতে এগিয়ে আসেন তাদের মা কোকিলাবেন (Kokilaben) আম্বানি । কোকিলাবেন তাদের কোম্পানির সিএ (CA), এস গুরুমুর্তি (S. Gurumurthy) আর পারিবারিক বন্ধু ও ব্যাংকার কে. ভি কামাত (K V Kamath) এর পরামর্শ নিয়ে মুকেশ আম্বানি আর আনিল আম্বানিকে নিজ নিজ কোম্পানি বুঝিয়ে দেন। সেই সাথে এই চুক্তিও করিয়ে নেন যেন আগামী দশ বছরের মধ্যে দুই ভাই কেউ কারো ব্যবসায়ীক ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে না পারে। এ সময় রিলায়েন্স এর নতুন সব কোম্পানিগুলো যায় আনিল আম্বানির কাছে অন্যদিকে মুকেশ এর কাছে যায় পুরাতন সব কোম্পানিগুলো।
আর প্রায় ৪ হাজার ৩০০ কোটি ডলার নিয়ে মুকেশ আম্বানি হন পঞ্চম সর্বোচ্চ ধনী আর ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার নিয়ে আনিল আম্বানি হয়ে যায় ষষ্ঠ সর্বোচ্চ ধনী।
কিন্তু ঠিক এক যুগের মধ্যে কি এমন ঘটে যে আনিল আম্বানির সম্পত্তির পরিমান এসে দাঁড়ায় মাত্র ১০০ কোটি ডলারেরও কমে? এমনকি তার ভাই মুকেশ আম্বানিকে এসে লোন পরিশোধ করে দেওয়ার মাধ্যমে আনিলকে জেলে যাওয়া থেকেও বাঁচাতে হয়!
প্রিয় বিজনেস ম্যানিয়ান, আজকের ব্লগে আমরা আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করবো আনিল আম্বানির এই উথান ও পতনকে। যে ঠিক কি কারণে পৃথিবীর ষষ্ঠ সর্বোচ্চ ধনী ব্যক্তি হঠাৎ করে দেউলিয়া হতে বাধ্য হলেন। পুরো ঘটনাটি জানতে ব্লগটির শেষ পর্যন্ত পড়ার অনুরোধ রইল।
আপনাদের আগেই বলেছি যে ২০০৫ সালে যখন দুই ভাইকে কোম্পানি বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তখন মুকেশ পায় রিলায়েন্স ইন্ড্রাস্টিজ, পেট্রোলিয়াম, পেট্রোক্যামিকেল এর মতো পুরাতন সব বিজনেসগুলো। অন্য দিকে আনিল পায় আরকম (Reliance Communication), রিলায়েন্স এনার্জি (Reliance Energy), রিলায়েন্স ব্রডকাস্ট (Reliance Broadcast) সহ বেশ কিছু নতুন নতুন কোম্পানি । তাই বিশেষজ্ঞদেরও এটি ধারণা ছিল যে আনিল হয়তো তার বড় ভাই মুকেশকে কাটিয়ে অনেক উপরে উঠবে। কেননা আনিল এর প্রতিটি ব্যবসা যেমন ছিল নতুন, আবার তেমনি সম্ভাবনাময়। আর সেটি প্রমান করে প্রথম কয়েক বছর আনিল তার ব্যবসাকে খুব দ্রুত গতিতে অগ্রসর করাতে থাকে যেখানে মুকেশ এর ব্যবসা উন্নতি করলেও তা আগাচ্ছিল বেশ ধীর গতিতে ।
যেহেতু আগে থেকেই আনিলের মিডিয়া জগত, লাইমলাইট, বলিউডের সৌখিন জীবনযাপনে বেশ আগ্রহ ছিল তাই ২০০৫ সালেই তিনি মিডিয়া বিজনেস এ নেমে পরে। সেই সময় আনিল এডল্যাব (Adlab) নামের একটা ফিল্ম মিডিয়া হাউজ কিনে নেয়। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি গোটা ভারতে বিগ সিনেমা নামে মুভি চেইন থিয়েটার চালু করে। ২০০৮ সালের দিকে গোটা ভারতজুড়ে বিগ সিনেমার ছিল প্রায় ৭ হাজারের ও বেশি স্ক্রিন। শুধু তাই নয় হলিউডের বিখ্যাত ডিরেক্টর স্টিভেন স্পিলবার্গের (Steven Spielberg) সাথে তিনি প্রায় ১২০ কোটি ডলারের জয়েন ভেঞ্চার করেন। যার লক্ষ্য ছিল অস্কার জয়ী কিছু মুভি প্রযোজনা করা। যার ভেতরে ছিল ওয়ার হর্স, হেল্প এবং লিঙ্কন এর মতো বিখ্যাত কিছু সিনেমা, এর মধ্যে লিংকন দুটি অস্কার সহ একাধিক পুরস্কার লাভ করে।
এরপর ২০০৮ সালে আনিল তার রিলায়েন্স পাওয়ার (Reliance Power) এর আই পি ও (IPO) লঞ্চ করে। আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাত্র ১ মিনিটের মাথায় কোম্পানীটির সব শেয়ার বিক্রী হয়ে যায়। যা ভারতের শেয়ার বাজারে গড়া রেকর্ড যা আজো ভাঙ্গেনি। সময়টা বেশ ভালোই চলছিল আনিলের। কিন্তু হঠাৎই আনিলের জীবনে নেমে আসে কালো আধাঁর।
২০০৫ সালের চুক্তি অনুযায়ী আনিলের রিলায়েন্স পাওয়ার এর জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানী আসত তার ভাই মুকেশ এর প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্স পেট্রোলিয়াম থেকে। যার দাম ধরা হত প্রতি গ্যালনে ২.৩৪ ডলার। কিন্তু হঠাৎ করে মুকেশ ২০১০ সালে এসে তার গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে দেয়। এ কারণে আনিল তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে আদালতে গিয়ে মামলাও করে। কিন্তু আদালত রায় দেয় মুকেশের পক্ষে। ফলে প্রায় দুই গুণ মূল্য পরিশোধ করে আনিলকে জ্বালানী কিনতে হয়। যা ছিল রিলায়েন্স পাওয়ারের জন্য বেশ বড় ক্ষতি।
এদিকে ২০১৫ সালে তাদের মায়ের করা চুক্তি শেষ হওয়া মাত্রই মুকেশ আম্বানি তার টেলি যোগাযোগ কোম্পানি জিও (Jio) শুরু করার মাধ্যমে টেলিকম ইন্ড্রাস্টিতে ঢুকে পড়ে। আর ওই সময়টাতে আনিলের Rcom. এমনিতেই লোকসানে চলছিল। কেননা আনিল তার R com. এ ব্যবহার করেছিল পুরাতন সিডিএমএ (CDMA) প্রযুক্তি যা 2জি আর 3জি এর জন্য ভালো হলেও 4জি অথবা 5জি প্রযুক্তি সহায়ক ছিলনা। ফলে এমনিতেই লোকসানে চলতে থাকা কোম্পানিটিতে জিও (Jio) আসায় আর টিকতে পারে নি। যেখানে ২০১৫ সালে আরকম এর মার্কেট ভ্যালুয়েশন ছিল প্রায় ১.৬৫ লাখ কোটি রুপি সেখানে মাত্র ৩ বছরে তা ৯৮% লসে এসে দাঁড়ায় ১৮৫ কোটি রুপিতে।
অন্যদিকে রিলায়েন্স পাওয়ারকে লোকসান থেকে বের করতে আনিল আম্বানি ২০১৪ সালে তার বিগ সিনেমাকে কার্নিভাল সিনেমাসের (Carnival Cinemas) কাছে ৭১০ কোটি ডলার এবং তার অন্য ব্রডকাস্ট চ্যানেল গুলোকে জি এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রির কাছে ১ হাজার ৮৭২ কোটি ডলারে বিক্রি করতে বাধ্য হয়।
কিন্তু তবুও আনিল তার রিলায়েন্স পাওয়ারকে বাঁচাতে পারে না। শেষমেষ ২০১৭ সালে এসে রিলায়েন্স পাওয়ারকেও প্রায় ২৫০ কোটি রুপির বিনিময়ে আদানী গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দিতে হয়।
কিন্তু এতো কিছুর পরও আনিল আম্বানির ভুলভাল বিনিয়োগ করা থামেনি। কোন রকম অভিজ্ঞতা ছাড়াই ২০১৬ সালেই ১০০ কোটি ডলার দিয়ে পিপাভাভ ডিফেন্স এন্ড অফসোর ইঞ্জিনিয়ারিং (Pipavav Defence & Offshore Engineering Co.) নামের আরেকটা কোম্পানি খুলে বসে। কিন্তু অভিজ্ঞতা না থাকায় ২০১৯ সালে মাত্র ১০ কোটি ডলারে কোম্পানিটি বিক্রি করতে বাধ্য হয় আনিল।
এছাড়াও মুম্বাই সি লিংক এর মতো উচ্চভিলাসী বেশ কিছু প্রজেক্ট ও করে। কিন্তু তার কোনটাই লাভের মুখ দেখতে পায়নি।
২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে আনিল আম্বানির কাঁঁধে এসে পরে আরকম, রিলায়েন্স ন্যাভাল, রিলায়েন্স পাওয়ার, দিল্লি মেট্রো এর প্রায় ৬০০ কোটি ডলারের সমপরিমান ঋন। আর আনিল আম্বানির মোট সম্পত্তি তখন কমতে কমতে এসে দাঁড়িয়েছিল মাত্র ১০০ কোটি ডলারে। কিন্তু এত সব ভুল সিদ্ধান্তের কারন কি ছিল ?
অনেকের মতে মূল কারণ ছিল তার উচ্চাভিলাসিতা। শুধুমাত্র নিজের উচ্চাভিলাসিতা দেখানোর জন্য আনিল এমন সব ব্যবসা ও প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিল যেগুলোই শেষমেষ তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শুধু তাই নয় আনিল তার ব্যবসার বেশির ভাগই করেছে ব্যাংক থেকে ঋন নিয়ে। শুধুমাত্র ভারতের ইয়েস ব্যাংক থেকেই আনিল ১২ হাজার ৮০০ কোটি রুপির লোন নেয়। যা সে পরে আর শোধ করতে পারে না। ফলে শেষ অব্দি ইয়েস ব্যাংকই বন্ধ হয়ে যায়।
আনিল যে শুধু ব্যাংক থেকেই ঋন নিয়েছিল এমন নয়। বরং অনেক প্রতিষ্ঠান থেকেও তার অর্থ নেয়া ছিল। যার মধ্যে সুইডিশ টেলিযোগাযোগ এবং নেটওয়ার্কিং কোম্পানি এরিকসন (Ericsson) অন্যতম । ২০১৯ সালে এরিকসন আদালতে আনিলের নামে তাদের ৮০০ কোটি ডলার ফেরত চেয়ে মামলা করে বসে। আদালত আনিলকে কয়েক মাসের সময় বেধে দেয় ঋন পরিশোধের জন্য, নাহলে তাকে জেলে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। তবে শেষ অব্দি তার ভাই মুকেশ আম্বানি এসে এই লোন পরিশোধ করে ভাইকে জেলে যাওয়া থেকে রক্ষা করে।
শুধু তাই নয় এখনো আনিলের নামে লন্ডনের একটা আদালতের চীনের তিনটি ব্যাংকের মামলা চলছে। যেখানে আনিলকে প্রায় ১০০ কোটি ডলারের ঋন শোধ করতে হবে।
বর্তমানে আনিল আম্বানির একমাত্র লাভজনক প্রতিষ্ঠান হলো রিলায়েন্স ক্যাপিটাল। কিন্তু করোনা মহামারীর পর থেকে এই প্রতিষ্ঠানের অবস্থাও তেমন একটা ভালো না।
প্রিয় পাঠক, আনিল আম্বানির এই পতনের পেছনে আসলে দায়ী কে বা কি ছিল বলে আপনার মনে হয়? যার জন্য এক সময়কার ষষ্ঠ সর্বোচ্চ ধনীর মাথার উপর এখন হাজার হাজার কোটি ডলারের ঋণের বোঝা। ব্লগটি ভালো লাগলে নিউজলেটারটি subscribe করে রাখুন।