কেন ক্ষতির মুখে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ? Why Biman Bangladesh Airlines Faces Loss
একটি প্রতিষ্ঠান যাদের কিনা ২০২২ সালে কাগজে কলমে আয় ছিল ৪৩৬ কোটি টাকা, যেখানে শুধুমাত্র সে বছরই একটি মাত্র প্রজেক্ট থেকে কারচুপি করা হয় প্রায় ১ হাজার ১১৬ কোটি টাকার। এমনই অনিয়ম আর অব্যাবস্থাপনায় ধুকছে, বাংলাদেশের পতাকাবাহী একমাত্র এয়ারলাইন্স(Airlines), বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স (Biman Bangladesh Airlines)।
দেশ বিজয় লাভের মাত্র এক মাসের মাথায় যাত্রা শুরু করে এই প্রতিষ্ঠানটি৷ যা বিশ্বের অন্যান্য স্বাধীনতা লাভ করা দেশের মধ্যে সবথেকে দ্রুততর সময়ে যাত্রা শুরু করা এয়ারলাইন্স। কোন রকম বিদেশি সাহায্য ছাড়া কেবল মাত্র একটি ডিসি ৩ বিমান নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এর বিমান সংখ্যা ২১টি। বিশ্বের সবথেকে কম প্লেন দুর্ঘটনার রেকর্ড(Record) ও রয়েছে এই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এর নামে।
১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। বিমান বাহিনী থেকে প্রাপ্ত একটি মাত্র ডিসি ৩ বিমান দিয়ে যাত্রা শুরু করে এই এয়ারলাইনসটি৷ সাথে ছিল সে সময়কার পূর্ব পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ২৫০০ জন কর্মকর্তা কর্মচারী, বোয়িং ৭০৭ (Boeing 707) এর ১০জন কমান্ডার আর মাত্র ৭ জন পাইলট।বিমান বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক ফ্লাইটটি ছিল একই বছরের ৪ই মার্চ এ। লন্ডন (London) থেকে বাংলাদেশে প্রায় ৩১০ জন যাত্রী নিয়ে অবতরন করে বিমান বাংলাদেশের প্রথম প্লেনটি৷ আর তার ঠিক ৩ দিন পরেই অর্থাৎ ৭ই মার্চ বিমান বাংলাদেশ তাদের প্রথম ডমিস্টিক (Domestic) ফ্লাইট পরিচালনা করে। ফ্লাইটের রুটটি ছিল চট্রগ্রাম থেকে সিলেটে।
বিমান বাংলাদেশের মূল হাবটি রয়েছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (Hazrat Shahjalal International Airport) ও বাকি দুটি সাব হাব রয়েছে যথাক্রমে সিলেট ওসমানিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (Osmani International Airport, Sylhet) ও চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর (Shah Amanat International Airport, Chattogram)। বর্তমানে বিমান বাংলাদেশের অধীনে রয়েছে ছোট বড় মিলিয়ে মোট ২১টি বিমান। প্রায় ৭০টি দেশে বিমান বাংলাদেশের সেবা পাওয়া যায় এবং প্রায় ১৬টি দেশের সাথে বিমান বাংলাদেশ সরাসরি যুক্ত। এবং বর্তমানে প্রায় ২৫টি রুটে(Route) চলাচল করছে বিমান বাংলাদেশ। তবে ১৯৭২ সালে চালু হওয়া বিমান বাংলাদেশের সাথে অনিয়ম আর দুর্নীতির ছিল বেশ দহরম মহরম একটা সম্পর্ক। ১৯৭২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এদেশের একমাত্র এয়ারলাইন্স হলেও ১৯৯৬ সালের পর থেকে বেসরকারি ভাবে বেশ কিছু এয়ারলাইনস বাজারে আসতে শুরু করে।
বর্তমানে বাংলাদেশে বিমান বাংলাদেশ ছাড়াও আর যে কয়টি এয়ারলাইন্স নিজেদের ফ্লাইট পরিচালনা করছে তাদের মধ্যে নভো এয়ার (Novoair), ইউ এস বাংলা (US-Bangla) আর এয়ার আস্ত্রা (Air Astra) যাত্রীদের কাছে বেশি জনপ্রিয়। তবে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে যেখানে অন্য এয়ারলাইনস গুলো নিজেদের সেবার মান ও রুটের সংখ্যা ও পরিমান যেখানে বাড়াচ্ছে। সেখানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এ দেখা যায় উল্টো চিত্র।
২০০৭ সালের আগেও বিমান বাংলাদেশ তাদের ফ্লাইটগুলো প্রায় ২৯টি আলাদা আলাদা রুটে পরিচালনা করতো। এমনকি নিউইয়র্ক(New York) থেকে টোকিও (Tokyo) কিছু কিছু ফ্লাইট প্রায় নিয়মিত যাতায়াত করতো। যেখানে বর্তমানে প্রায় ১৭ বছর পরে এসেও রুটের সংখ্যা তো বাড়েনি বরং কমে দাঁড়িয়েছে ২৫টি তে। শুধুমাত্র তাই নয় যেখানে ২০০৮ সালেই বিমান বাংলাদেশের অধীনে ছিল ২০টি বিমান সেখানে এই ১৬ বছরেও বিমান বাংলাদেশের সাথে যুক্ত হয়েছে মাত্র ১টি মাত্র বিমান। ২০০৭ সালে লস(Loss) সহ নানা রকম ইস্যুকে(Issues) কারণ হিসেবে দেখিয়ে সে সময়কার সরকার বিমান বাংলাদেশকে প্রাইভেটাইজেশন (Privatization) করার সিদ্ধান্ত নেয়।এরপর পরই ২০০৮ সালে বিমান বাংলাদেশ ১০টি নতুন বোয়িং বিমান ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে সেটা ওই অব্দিই। ওই বিমান গুলো এখন অব্দি বিমান বাংলাদেশের বহরে এসে যুক্ত হয় নি।
বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এর দ্বারা যাত্রী হয়রানি খুব সাধারন একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে (Middle East) ও ইউরোপের (Europe) বিভিন্ন দেশ থেকে আসা যাত্রীরা মাঝে মধ্যেই এমন অভিযোগ করেন যে তাদের লাগেজ গেটে সোনা, ফোন সেট, ল্যাপটপ সহ এমন দামী সামগ্রী চুরি করা হয়েছে।
এমনকি অনেক সময় দেখা যায় প্রবাসীদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কিনা বিয়ের গহনা অব্দি লাগেজ কেটে চুরি করা হয়েছে। এসব বিষয়ে অভিযোগ জানানো হলেও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এ ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা তো নেয়ই নি। বরং দোষ চাপাতে দেখা যায় এয়ারপোর্ট ম্যানেজমেন্টর (Airport Management) উপরে ৷ যেখানে প্রবাসীরা প্রতি বছর দেশে বিপুল পরিমানে রেমিটেন্স (Remittance) নিয়ে আসে সেখানে বিমান বাংলাদেশের এমন আচরণ কোন ভাবেই কাম্য নয়।
শুধু তাই নয় টিকিটের প্রাইস ও সেবার মানের অনুপাতের দিক দিয়েও বিমান বাংলাদেশ যথেষ্ট বাজে অবস্থানে রয়েছে। একদিকে সেবার মান যতটা বাজে টিকিটের প্রাইস ও ততটা চড়া।
একটি নীরিক্ষায় দেখা, স্বাভাবিক কর্মদিবসগুলোতে প্রায় একি সময়ে ছেড়ে যাওয়া ঢাকা থেকে কক্সবাজারর গামী ফ্লাইটগুলোর টিকিট প্রাইস পর্যালোচনা করে দেখা গিয়েছে যে, আপনি যদি যাত্রার দিনেই টিকিট কাটেন সেক্ষেত্রে নভো এয়ারে গেলে আপনাকে গুনতে হবে প্রায় ৬ হাজার ৩৪৬ টাকা, ইউ-এস বাংলায় ৬ হাজার ৭৩৮ টাকা আর আপনি যদি বিমান বাংলাদেশে যান সেখানে আপনাকে গুনতে হবে ৭ হাজার ৬৩৪ টাকা। যা অন্য এয়ারলাইনের থেকে প্রায় ১ হাজার বেশি!!
শুধু তাই নয় মাঝে মাঝেই বিমানকর্মীদের বিরুদ্ধে সোনা চোরাচালানে যুক্ত হওয়া, নির্দিষ্ট এজেন্টদের সুবিধা দিতে টিকিট বুকিংয়ে কারসাজি, বিভিন্ন কেনাকাটাসহ নানা ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। সরকারি নিরীক্ষায়ও এমন অনেক অনিয়মের তথ্য আসে। কিন্তু সে অনুযায়ী বিমান বাংলাদেশের দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনা হয় না।
এছাড়াও গত বছরের জানুয়ারিতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট পরিচালনায় লাভ-ক্ষতির হিসাব নির্ধারণে ৫ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে দুটি সফটওয়্যার কেনায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিমানের ক্রয়নীতি লঙ্ঘন করে এগুলো কেনা হয় বলে অভিযোগ উঠে।
২০১৬ এবং ২০১৮ সালে ‘ বিমান বাংলাদেশ ফ্লাইট প্রফিটিবিলিটি সিস্টেম'(Biman Bangladesh Flight Profitability System)’ এফপিএস (FPS) এবং ‘কস্ট অ্যান্ড বাজেট (Cost & Budget)’ নামের এ দুটি সফটওয়্যার (Software) ক্রয় করে। সফটওয়্যারগুলোর ক্রয় করা হয় এক্সেলা সেল সলিউশন (Accela Cell Solution) নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে। সফটওয়্যার দুটি কেনা ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এক্সেলা ৫ কোটি ৪ লাখ টাকা পরিশোধ করে বিমান বাংলাদেশ। এর আগে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিমান বাংলাদেশ মাইক্রোসফট এক্সেলের (Micrsoft Excel) ফাংশন ব্যবহার করে নিজস্ব পদ্ধতিতে ‘রুট কস্টিং (Route costing)’ যা বিভিন্ন রুটের ফ্লাইট পরিচালনার মোট খরচ এবং ‘রুট প্রফিটিবিলিটি (Route profitability)’ যা লাভসহ বিভিন্ন রুটের ভাড়া নির্ধারণ করে System ব্যাবহার করে আসছিল পরে এ দুই কাজের জন্য একজন কর্মকর্তা দুটি সফটওয়্যার কেনেন। এর মধ্যে ২০১৮ সালে কেনা ফিন্যান্স বাজেটিং সফটওয়্যারটি এখন অব্দি চালু করা সম্ভব হয় নি। । অন্য সফটওয়্যার এফপিএস (ফ্লাইট প্রফিটিবিলিটি সিস্টেম) দিয়ে কাজ শুরু করা হয় ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে। অর্থ্যাৎ কার্যত একটি সফটওয়্যারই ক্রয় করা হয়েছে বলে আসা হচ্ছিল।
শুধু তাই নয় ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে তিনি বিমানে কোনো সফটওয়্যার কেনার আগে তার বিকল্প কী কী আছে এবং সেগুলোর বিষয়ে আরএফপি (RFP) বা রিকোয়েস্ট ফর প্রপোজাল (Request for Proposal দিতে হয়, তাও তিনি দেন নি। এ ছাড়া তিনি বিমানের আইটি IT) বিভাগ বা অন্য কোনো কমিটির পরামর্শ না নিয়ে ইন্টারফেস কস্ট সার্ভিস চার্জ (Interface cost service charge) নির্ধারণ করেন। প্রোটোকল (Protocol)অনুযায়ী, কোনো কিছু কেনার আগে যেসব কর্মকর্তার মতামত নিতে হয়, তাও নেননি তিনি।এ ব্যাপারে ওই কর্মকর্তার এখন অব্দি কোন শাস্তি আনা হয় নি। উল্টো সেই অভিযুক্ত কর্মকর্তার অভিযোগ, একটি মহল তার প্রোমশন (Promotion) ঠেকানোর জন্য এসব করছে।
এখানেই শেষ নয় প্রিয় পাঠক, সাম্প্রতিক সময়ে মিশর থেকে দুটো বোয়িং ৭৭৭–২০০ ইয়ার মডেলে প্লেন লিজ (Lease) নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই প্রজেক্টে প্রায় ১ হাজার ১১৬ কোটি টাকার কারচুপির অভিযোগ করে খোদ দুদক। অভিযোগ ওঠে প্রায় ২১ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। কিন্তু কারও ই সেভাবে শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হয়নি নি। কারণ হিসেবে জানানো হয়, এই ২১ জনের মধ্যে এমন উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা রয়েছেন যাদের শাস্তির মধ্যে আনা সম্ভব নয়।
তবে দেরিতে হলেও বিমান বাংলাদেশের অনেক পরিবর্তন আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে যাত্রীদের সেবার মান বাড়াতে বিমান বাংলাদেশ ২৪ ঘন্টা কল সেন্টার চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুধু তাই নয় এখন ২৫টি রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করলেও, সামনে বিশ্বের যে যে জায়গায় বাংলাদেশি রয়েছে তার প্রতিটা রুটেই বিমান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিমান বাংলাদেশ।
এখানেই শেষ নয় এ বছরেই ইতালির রোম (Rome, Italy) এ ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করতে যাচ্ছে বিমান বাংলাদেশ। সেই সাথে নিউইয়র্ক এবং টোকিও রুটেও পুনরায় ফ্লাইট পরিচালনা করতে যাচ্ছে বিমান বাংলাদেশ।
বিমান বাংলাদেশ যে ধীরে ধীরে যাত্রী সেবার মান বাড়াতে সক্ষম হচ্ছে। এর একটি পরিচয় পাওয়া যায় সাম্প্রতিক সময়ে।
গত বছর বিমান বাংলাদেশ প্রায় ২১ লক্ষ যাত্রী আনা নেওয়া করে, যা এর আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১০ লাখ বেশি। এ বছর বিমান বাংলাদেশ যে সেই সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে তাও সহজে অনুমান করা যাচ্ছে।
সুতরাং হাজার অনিয়মের মধ্যেও বিমান বাংলাদেশ যে ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে চলছে এ কথা আমরা স্বীকার করতেই পারি।
আজ এ অব্দি। আগামী ব্লগে আমরা আসবো এমনই কোন বিষয় নিয়ে। সেই পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। আমাদের সাথেই থাকুন। আর এ ধরণের ব্লগ পছন্দ করলে, বিজনেস ম্যানিয়ার নিউজলেটার Subscribe করতে ভুলবেন না। ধন্যবাদ।