Adani Group:যাদের কথায় নাচে স্বয়ং মোদী | Where is Adani Now?
একজন ব্যাবসায়ী, যিনি একাই কিনা ভারতের বড় বড় ব্যাবসা খাতের ৪৫% নিয়ন্ত্রণ করেন। বলা হয়ে থাকে মোদী সরকার যার হাতের পুতুল। আজ আমরা জানবো এশিয়া মহাদেশের শীর্ষ ধনী গৌতম আদানী সম্পর্কে।
কে এই গৌতম আদানী। কেনই বা স্বয়ং কংগ্রেস লিডার রাহুল গান্ধী পার্লামেন্ট এ দাঁড়িয়ে এটা বলেছেন যে মোদী আসলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নয়, সে আদানীর ইশারায় নাচা একটি পুতুল!!
বর্তমানে এশিয়ার সর্বোচ্চ ধনী গৌতম আদানী খুবই সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। ১৯৬২ সালের গুজরাটের একটি ছোট্ট গ্রাম এ জন্মগ্রহন করে গৌতম আদানী। পেশায় সামান্য এক কাপড় ব্যাবসায়ী এর ছেলে আদানী এর শৈশব কাটে দারিদ্র্যতার সাথে লড়তে লড়তেই।
স্কুল থেকে পড়ালেখা শেষ করে আদানী ভর্তি হয় গুজরাট ইউনিভার্সিটিতে কমার্সে পড়ালেখা করার জন্য। কিন্তু আর্থিক কষ্টের কারণে সেকেন্ড ইয়ারে এসেই আদানীকে কলেজ ছাড়তে হয়। তখন কে জানতো ? এক সময় এই আদানীই হবেন এশিয়া মহাদেশের শীর্ষ ধনী!
এরপর ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে ১৯৭৮ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে আদানী চলে আসে মুম্বাই এ । সেখানে বড় ভাইয়ের সহযোগিতায় সে যোগ দেয় মাহেন্দ্র ব্রাদার্স এর ডায়ামন্ড কোম্পানিতে। এবং আদানী এখান থেকেই ! ব্যাবসার নাড়ি নক্ষত্র সব শিখে ফেলে। ম্যাহেন্দ্রাতে আদানী ডায়মন্ড এর কাজ করে প্রায় ৩ বছর। এরপরই সে এই কাজ ছেড়ে দিয়ে, নিজেই ডায়মন্ড বিক্রি করা শুরু করে৷
১৯৮১ সালে প্রথম বারের মতো ১০ হাজার রুপিতে নিজে কিছু ডায়মন্ড বিক্রি করে আদানী ,এবং প্রথমবারের মতো এত টাকা!! একসাথে দেখে আদানী!! ১৯৮১ সালটিই এমন একটি বছর ছিল যেটা আদানীর ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেয়। এসময়টাতে আদানীর বড় ভাই মাহাশুখবাই আদানী আহামেদাবাদে একটি প্লাস্টিকের ফ্যাক্টরি কেনে , এবং সাহায্যের জন্য গৌতম আদানীকে আহামেদাবাদ ডেকে পাঠায়।
১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধী আমদানী আইন শিথিল করলে এবার আদানী নিজে বাইরের দেশ থেকে পলিভিনাইল ক্লোরাইড আমদানি করা শুরু করে, আর সাপ্লাই দেয়া শুরু করে ভাইয়ের ফ্যাক্টরি এর পাশাপাশি অন্য প্লাস্টিক ফ্যাক্টরিগুলো তেও । ৫ লক্ষ রুপী দিয়ে আদানী এই ব্যাবসা শুরু করলেও কিছু বছরের মধ্যেই যার প্রফিট বেড়ে দাড়ায় ৪০০ গুণ!!
গৌতম আদানী ১৯৮৮ সালে, আদানী এন্টারপ্রাইজ নামে নতুন একটা কোম্পানি খুলে ব্যাবসা করতে শুরু করে। আদানী এন্টারপ্রাইজ আর গৌতম আদানীর ভাগ্য খুলে যায় ১৯৯১ সালে। যখন নারাশিমা রাও আর মনমহন সিং সমুদ্র বন্দরগুলোকে প্রাইভেটাইজশন করা শুরু করে। অর্থ্যাৎ বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানিকে সেই বন্দরগুলো চালানোর জন্য লিজ দেয়। আদানী এন্টারপ্রাইজ এইসময় মুন্দ্রা পোর্টের টেন্ডার পায়।
৭ বছরের মধ্যেই ভারতের ৭টি সমুদ্র তীরবর্তী রাজ্যের প্রায় ১৩টি পোর্টের টেন্ডার পায় আদানী এন্টারপ্রাইজ।
এরপর ১৯৯৮ সালে আদানী এন্টারপ্রাইজ আদানী পোর্ট নামে নিজেদের একটি পোর্ট চালু করে। ৮ হাজার হেক্টর এরিয়া জুড়ে বিস্তৃত এই পোর্টের নিজেদের রেলস্টেশন ছাড়াও রয়েছে বিমানবন্দর। আকার আর সক্ষমতার দিক দিয়ে যেটি ভারতের সবথেকে বড় বন্দর।
এরপর আসে ১৯৯৯ সাল, যখন আদানী এন্টারপ্রাইজ উইলমার গ্রুপের সাথে মিলে ফরচুন ওয়েল প্রথমবারের মতো বাজারে আনে। ধীরে ধীরে ফরচুন, তেল ছাড়াও সয়া ও বিভিন্ন মসলা বাজারে আনতে থাকে৷
এরপর আদানী এন্টারপ্রাইজ কয়লা খনি এর ব্যাবসায় নামে। ২০১০ সালে প্রায় ১.৬ বিলিয়ন !! ইউ এস ডলার খরচ করে আদানী এন্টারপ্রাইজ ইন্দোনেশিয়াতে ৭.৮ বিলিয়ন টনের কয়লা খনি ক্রয় করে।
এভাবেই আদানী এন্টারপ্রাইজ তাদের পরিধি বাড়াতে থাকে। ২০০২ সালের ৭৬৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের কোম্পানিটি ২০১৪ সালে এসে ১০ বিলিয়ন ডলারের কোম্পানিতে পরিনত হয়!!
এরপর আদানী এন্টারপ্রাইজ নামে এয়ারপোর্ট ব্যাবসায় । বর্তমানে ভারতের প্রায় ৬টি এয়ারপোর্ট আদানী এন্টারপ্রাইজ প্রায় ৫০ বছরের জন্য লিজ নিয়েছে। তা বাদেও ভারতের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ এয়ারপোর্ট মুম্বাই এয়ারপোর্টের ৭৪% স্টেক দখল করে আছে আদানী এন্টারপ্রাইজ।
এভাবেই মাত্র তিন দশকে, শূন্য থেকে শুরু হওয়া আদানী এন্টারপ্রাইজ বিলিয়ন ডলারের কোম্পানিতে পরিনত হয়। ২০২৩ সালের হিসেব অনুযায়ী আদানী এন্টারপ্রাইজ এর রেভিনিউ এর পরিমান প্রায় ২.৬২৫ লাখ কোটি ডলার।
শুধু তাই নয় ২০২২ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনের হিসেবে আদানী এন্টারপ্রাইজ এর কর্নধার গৌতম আদানী বনে যান বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এবং এশিয়া মহাদেশের সর্বোচ্চ ধনী ব্যাক্তি।
শুধু তাই নয় বর্তমানে ভারতে টোটাল আমদানি রপ্তানির প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ হয় আদানী এন্টারপ্রাইজ এর হাত ধরে। এবং মোট এয়ার ট্রাফিকের ৬ ভাগের ১ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে এই আদানী এন্টারপ্রাইজ।
প্রিয় দর্শক ব্যাবসার একটি জনপ্রিয় উক্তি হলো ‘একটি দেশের নিয়ন্ত্রণের মূলে রাজনীতিবিদেরা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে কলকাঠি নাড়ায় সেই দেশের বড় বড় ব্যাবসায়িরা। ”
আর গৌতম আদানীর ক্ষেত্রে এই কথা যেন পুরোপুরি সত্য। কেন এমন বলছি? চলুন দেখা যাক।
এই তো কয়েক মাস আগেও উইকিপিডিয়া থেকে অভিযোগ আনা হয় যে আদানী এন্টারপ্রাইজ অনেক ফেইক রি্ভিউয়ার ও এডিটর হায়ার করে নিজেদের উইকিপিডিয়া প্রোফাইলে অনেক বেনামি পরিবর্তন করছে যা পুরোপুরি বে আইনি।
আর ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে যেন গৌতম আদানীর রয়েছে অন্য রকম এক প্রেমের সম্পর্ক।
আপনারা হয়তো জানেন যে নরেন্দ্র মোদী এক সময় গুজরাটের মূখ্যমন্ত্রী ছিলেন। সে সময় বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানি গুজারাটে তাদের কারখান স্থাপনের জন্য সরকারের কাছ থেকে জমি কিনে। যেখানে মাহেন্দ্রা মোটর্স এর পার স্কোয়ার মিটার জমির জন্য দাম পড়ে ৪৭০ রূপী, মারুতি সুজুকি ৬৭০ রূপী, টাটা এন্টারপ্রাইজ ১১০০ রুপী। সেখানে আদানী এন্টারপ্রাইজের পার স্কয়ার ফিট জমির জন্য দাম গুনতে হয় সর্বোচ্চ ৩২ রূপি। এমনকি কোন কোন জায়গায় মাত্র ১ রূপী খরচ করতে হয়!!
শুধু তাই নয় ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবার পর মহারাষ্ট্রের প্রায় ৩২০ একর বনভূমি চলে যায় আদানী এন্টারপ্রাইজের কাছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মোদী সরকার একটি প্রতিবেদনে পাবলিশ করে। সেই প্রতিবেদনের মতে বনভূমি দেওয়ার অজুহাত হিসেবে দেখানো হয় যে এতে করে প্রায় ৩৫০ জন স্থানীয় মানুষের চাকরির সুযোগ তৈরী হবে৷ যেটি আসলে কখনোই হয় নি।
শুধু তাই নয় এসবে সরকারে প্রায় ৫৮৭ মিলিয়ন রূপীর ক্ষতি হয়। যেটা মূলত ভারতের সাধারণ জনগনেরই টাকা।
প্রিয় দর্শক আপনারা হয়তো ভারতে মুম্বাই এয়ারপোর্টে সন্ত্রাসী হামলার কথা শুনেছেন৷ বলা হয়ে থাকে এ হামলাটিও আসলে করা হয়েছে গৌতম আদানী এর ইশারাতেই৷
মুম্বাই এয়ারপোর্টে হামলার আগে এয়ারপোর্টের দায়িত্ব ছিল জেএসকে এন্টারপ্রাইজ এর হাতে। কিন্তু হামলার পরপরই এ দায়িত্ব চলে যায় আদানী এন্টারপ্রাইজ এর হাতে। তারা মুম্বাই এয়ারপোর্টের জেএসকের ৫০% শেয়ার এর পাশাপাশি টোটাল ৭৪.৬% শেয়ার নিয়ে নেয়।
শুধু তাই নয় প্রিয় দর্শক আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন যে সরকার যখন কোন প্রতিষ্ঠান লাভজনক ভাবে চালাতে পারে না তখন সেটা কোন প্রাইভেট কোম্পানিকে লিজ হিসেবে দেয় চালানোর জন্য। বাংলাদেশ সরকার যেমন বাংলাদেশ রেলওয়েকে লাভজনক করার জন্য প্রাইভেটাইজশন করেছে।
অন্যদিকে মোদীর সরকার শুধু মাত্র গৌতম আদানীকে লাভবান করার জন্য। তাদের লাভজনক এয়ারপোর্টগুলোকে প্রাইভেটাইজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। শুধু তাই নয়, প্রাইভেটাইজশন করার আগে তারা নতুন দুটি বিল পাশ করে।
সেই বিল অনুযায়ী আগের কোন অভিজ্ঞতা না থাকলেও যেকোন কোম্পানি এয়ারপোরর্টের লিজ নিতে পারবে আর একটি কোম্পানি যতগুলো ইচ্ছা এয়ারপোর্টের লিজ নিতে পারবে। আর এই সুযোগকেই কাজে লাগিয়ে আদানী এন্টারপ্রাইজ ৭টির মধ্যে প্রায় ৬টি এয়ারপোর্ট লিজ হিসেবে নেয়।
যেখানে CIA অব্দি কোন একটি অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে দুটোর বেশি এয়ারপোর্ট লিজ হিসেবে দিতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু মোদি সরকার আর কি শুনে সেই কথা !
যদিও এক সময় মিলিয়ন মিলিয়ন ডলায় আয় করা আদানী এন্টারপ্রাইজ এর অবস্থা এখন কিছুটা নড়বড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে পাবলিশ হওয়া আমেরিকার হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ এর একটি রিপোর্ট নড়িয়ে দেয় গৌতম আদানীর গোটা সম্রাজ্যকে। ১২৪ বিলিয়ন ডলার থেকে ৬০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে আদানীর সম্পত্তির পরিমান।
সেই রিপোর্ট অনুযায়ী গৌতম আদানী তার এই সম্রাজ্যের অনেকটাই গড়ে তুলেছেন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে। আর এই ঋণের পরিমান ৩.৩৯ ট্রিলিয়ন ডলার যেটা শোধ করার ক্ষমতা গৌতম আদানীর আদৌ নেই।
শুধুমাত্র তা নয় বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধণী হওয়া সত্ত্বেও আদানী ভারতের শীর্ষ ২৫ জন করদাতার তালিকার মধ্যে নেই। শুধু তাই নয়, আদানী এন্টারপ্রাইজ এর মতো বিশাল একটা কোম্পানির অডিট এর দায়িত্বে রয়েছে এমন একটা এজেন্সি যাদের নিজস্ব কোন অফিস অব্দি নেই। কর্মচারীর সংখ্যা মাত্র ১১ জন।
একদম শূন্য থেকে শুরু করে শীর্ষে পৌছানো গৌতম আদানী এর জীবনে যে অনেক কালো অধ্যায় রয়েছে তা সহজেই অনুমান যোগ্য। একদম দারিদ্র্যতা থেকে উঠে এসে ভারতের উন্নতিতে কাজ করা এই মানুষটি হিরো না ভিলেন তা এখনো অনিশ্চিত।
কেমন লাগলো আমাদের আজকের ব্লগটি? কমেন্টে অবশ্যই জানাতে ভুলবেন না। ভালো লাগলে লাইক দিন নিউজলেটার , সাবস্ক্রাইব করুন এবং শেয়ার করুন সবার সাথে।