দি বিগ ফোর, একাউন্টিং এর জগতের অপ্রতিরোধ্য স্বৈরাচারী!
বিশ্ব অর্থনীতিতে দেশ, জাতি, প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রতিযোগিতাপূর্ণ সম্পর্কের ছাপ প্রায়শই দেখতে পাওয়া যায়। প্রত্যেকেই একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার লড়াইয়ে লেগে আছে, যেই লড়াইয়ে কখনো বা শক্তিশালী হচ্ছে এক দেশের অর্থনীতি, কখনো এইসবের মাঝে পড়ে দেউলিয়া হয়ে যাছে নামজাদা সব কোম্পানিও। তবে কিছুক্ষেত্রে আমরা একটি প্রতিষ্ঠানের একচ্ছত্র আধিপত্য যে দেখতে পাই না, এমনটি নয়। প্রায় সময়ই আমরা এমন কিছু প্রতিষ্ঠান দেখতে পাই, যারা তাদের নিজস্ব সেক্টরে মাকরসার জালের মত আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। কিন্তু আজ আমরা এমন একটি গ্রুপের কথা তুলে ধরবো, যাদের কাছে পৃথিবীর প্রায় ৬৭% একাউন্টিং মার্কেটের দখল রয়েছে। এই কোম্পানিগুলো হচ্ছে ডেলোইট, প্রাইস ওয়াটারহাউজ কুপারস ওরফে PWC, আর্নেস্ট এন্ড ইয়াং ওরফে EY এবং KPMG ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড। অর্থনীতির জগতে, এই চার কোম্পানির সমষ্টিকে বলা হয় দি বিগ ফোর নামে।
বিগ ফোরের (Big Four) ইতিহাস
ইতিহাসের পাতা উল্টাতে গেলে, আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই উনিশ শতকের শেষ পর্যায়ে। লন্ডনের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে তখন পরিচিত ছিলেন ইমানুয়েল কুপার (Emmanuel Cooper)। তিনি লন্ডন এন্ড কাউন্টি ব্যাংক এর ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন। তার ছেলে উইলিয়াম কুপার ১৮৫৬ সালে লন্ডনে তার একটি একাউন্টিং প্র্যাকটিসের অফিস খুলে বসেন, যেখানে সাত বছর পর তার বাকি ভাইয়েরাও যোগ দেয়। তখন এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচিতি পায় কুপারস ব্রাদার (cooper’s brother) নামে।
তবে তারও আগে, ১৮৪৫ সালে উইলিয়াম ওয়েলচ ডেলোইট (William Welch Deloitte) লন্ডনে তার ফার্ম খুলেছিলেন, যার নামকরন করা হয়েছিলো তার নামেই।
বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এরকম কনসালটেন্সি ফার্ম খোলার হিড়িক পড়ে যায় লন্ডনে। ততকালীন ব্রিটিশ অর্থনীতিতে এই সার্ভিসটির গ্রহনযোগ্যতা এতটাই বেড়ে যায় যে, কুপারস ব্রাদারের মতো আরও বেশ কয়েকটি একাউন্টিং ফার্মের জন্ম হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আর্নেস্ট এন্ড হুইনি (Ernst & Whinney), আর্থার ইয়াং এন্ড কর্পোরেশন (Arthur Young & Co.), আর্থার এন্ডারসন (Arthur Andersen) সহ আরও অনেকেই। এদের বেশিরভাগের যাত্রা লন্ডনে শুরু হলেও, আর্থার এন্ডারসন এর যাত্রা শুরু হয় আমেরিকার শিকাগো (Chicago) অঙ্গরাজ্য থেকে।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ধীরে ধীরে আমেরিকার অর্থনীতিও পৃথিবীর বুকে এক অপ্রতিরোধ্য জায়গা তৈরি করে নিতে শুরু করলে, এই ফার্মগুলোর অধিকাংশই আমেরিকায় তাদের আরেকটি শাখা খোলার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮৯০ সালে ডেলোইট (Deloitte) তাদের আমেরিকান শাখা চালু করেন। দেখতে দেখতে লন্ডনের বেশকিছু একাউন্টিং ফার্ম আমেরিকায় ঘাটি বাধতে শুরু করে, যার ফলে সেখানকার অর্থনীতিতে এক অন্যরকম বাতাস বইতে শুরু করে। হঠাৎ করেই ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে অভিজ্ঞদের কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি আমেরিকার কোনও প্রতিষ্ঠানই। তাই একাউন্টিং ফার্মের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়তে থাকে, সেইসাথে তীব্র হতে থাকে প্রতিযোগিতাও। বিংশ শতাব্দীতে এসে, অন্যান্যদের পিছনে ফেলে এগিয়ে যায় এরকম ৮ টি কোম্পানি, যাদেরকে একাউন্টিং এর জগতে বিগ এইট নামে ডাকতে শুরু করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে আর্থার এন্ডারসন (Arthur Andersen) , আর্থার ইয়াং (Arthur Young), কুপারস এন্ড ল্যাবর্যান্ড(Coopers & Lybrand), ডেলোইট হাসকিং এন্ড সেলস (Deloitte Haskins & Sells), আর্নেস্ট এন্ড হুইনি (Ernst & Whinney), টুশে রস (Touche Ross), প্রাইস ওয়াটারহাউজ (Pricewaterhousecoopers) এবং পিট মারউইক মিশেল (peat marwick mitchell)।
তবে শুধুমাত্র আমেরিকা কিংবা ইউরোপ নয়, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় বিশ্ব অর্থনীতি। এই লক্ষেই প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান একে অপরের সাথে যোগ দিতে শুরু করে, আর তৈরি করতে থাকে নতুন প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৯ সালে আর্নেস্ট এন্ড হুইনি এবং আর্থার ইয়াং এর সমন্বয়ে জন্ম দেয় আর্নেস্ট এন্ড ইয়াং। একইবছর ডেলোইট এবং টুশে রস এর মধ্যেও মার্জিং হয়ে যায়। সেইবছর বিগ এইট এর সমাপ্তি ঘটে, আর জন্ম হয় বিগ সিক্স এর।
তবে বিগ সিক্স এর ইতিহাস বিগ এইটের মত স্থায়ী হওয়ার আগেই, ১৯৯৮ সালে প্রাইস ওয়াটারহাউজ এবং কুপারস এন্ড ল্যাবর্যান্ডের মার্জিং হয়। এই প্রতিষ্ঠানটির নতুন নাম হয় প্রাইস ওয়াটারহাউজ কুপারস ওরফে পিডাব্লিউসি (PWC)। আর এর সাথে সাথে বিশ্ব অর্থনীতিতে পরিচিত পায় আরেকটি নতুন টার্ম, বিগ ফাইভ Big 5।
২০০১ সালে ঘটে যায় একাউন্টিং এর দুনিয়ার সবচেয়ে ব্যয়বহুল দুর্ঘটনাটি। এনরন কর্পোরেশন (Enron Corporation) এর ধোকাবাজি যখন পৃথিবীর সামনে চলে আসে, তখন বিশ্ব অর্থনীতিতে চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। একসময় যেই প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় একাউন্টিং ফার্মগুলোর একটির মালিক ছিলো, সেই এনরন কর্পোরেশন ওইবছর নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেন। আর এর সাথে সাথে বন্ধ হয়ে যায় বিগ ফাইভের অন্তর্ভুক্ত অডিট এন্ড একাউন্টিং ফার্ম আর্থার এন্ডারসন। অর্থনীতির ইতিহাসে এই ঘটনাটিকে বলা হয় এনরন স্ক্যান্ডাল (Enron scandal) হিসেবে।
এই স্ক্যান্ডালের পরই জন্ম হয় বিগ ফোরের, যারা আজও পৃথিবীর অর্থনৈতিক গতিবিধি নিজেদের আমলে রেখেছে।
বর্তমানে বিগ ফোর Big 4.
বর্তমান সময়ে বিগ ফোরের অন্তর্ভুক্ত চার কোম্পানি বিশ্বের ৬৭% ব্যবসা নিজেদের দখলে রেখেছে। ডেলোইট, আর্নেস্ট এন্ড ইয়াং, PWC এবং KPMG প্রতিবছর প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করছে শুধুমাত্র অডিট, বিজনেস কনসাল্টেন্সি সার্ভিস, মার্কেট রিসার্চ সার্ভিসের মতো সেবা প্রদান করেই। সারাবিশ্বের প্রায় দেড় কোটি একাউন্টেন্ট এই চার ফার্মের জন্য দিনরাত কাজ করে চলেছে। তবে বিলিয়ন ডলারের ছড়াছড়ি এবং কোটি কোটি কর্মকর্তা কর্মচারীদের নিয়ে গঠিত এই ফার্মগুলো যে একদম দুধে ধোয়া তুলসিপাতা, তাও নয়।
বিগ ফোরের যত অনিয়ম
বিগ ফোরের অন্তর্ভুক্ত ফার্মগুলোর আয়ের এক বড় অংশই আসে কোম্পানি অডিট সেক্টর থেকে। কিন্তু এখানেই এই ফার্মগুলোর গাফেলতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বহুবার। আর এই গাফেলতির জন্য শুধু একটি প্রতিষ্ঠানকেই ভুগতে হয়েছে, এমন নয়। ধ্বংস হয়ে গেছে হাজার হাজার মানুষের আয় রোজগারের পথ, হারাতে হয়েছে শেষ সম্বলটাও।
পাবলিক কোম্পানি একাউন্টিং ওভারসাইট বোর্ডের ভাষ্যমতে, ২০০৯ সালের পর থেকে বিগ ফোর ফার্মের মাধ্যমে হওয়া অডিটের মধ্যে প্রায় ৩১% অডিটেই গাফেলতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি গাফেলতি করেছে KPMG । অথচ এই ভুল, ত্রুটিপূর্ণ অডিটের জন্য অনেক কোম্পানিকে অপূরণীয় ক্ষতির মুখ দেখতে হলেও, বিগ ফোরের কোনও ফার্মকেই সেজন্য কড়া শাস্তি প্রদান করা হয়নি।
কিছুক্ষেত্রে এমনও দেখা গিয়েছে যে, একই ফার্ম একটি প্রতিষ্ঠানের অডিটর এবং কনসালটেন্ট হিসেবে রয়েছে, যার ফলে একধরণের কনফ্লিক্টেড পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। এইসব কেসগুলোতে উঠেছে স্বচ্ছতার প্রশ্নও। এমন এক প্রশ্নের ফাদে পড়ে ২০২০ সালে PWC ফার্মকে শুনতে হয়েছিলো কড়া সমালোচনাও।
বহির্বিশ্বে বিগ ফোর ফার্মের সবচেয়ে বড় সমালোচনার জায়গাটি অবশ্য এর ওয়ার্ক কালচারে। পৃথিবীর সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজের পরিবেশ এই ফার্মগুলোতে। আকর্ষণীয় বেতন বোনাস, ইন্ডাস্ট্রির ব্যাপারে অনেককিছু জানতে পারার সুযোগ কাজে লাগিয়ে এখান থেকে প্রতিবছর অনেক উদ্দোক্তা বের হয়ে আসে সত্যি, কিন্তু সেইসাথে প্রতিষ্ঠানগুলোর অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং একশতভাগ একুরেসি মেইনটেইন করার লক্ষ্য অনেকের স্বাভাবিক জীবনকেই নষ্ট করে দিচ্ছে। অভ্যন্তরীণ কোন্দল, অফিস পলিটিক্স, একে অপরকে সহযোগিতা না করার মন মানসিকতা তৈরি, ইত্যাদি নানাধরনের সমস্যাই রয়েছে এই ফার্মগুলোতে। তাই অনেকেই এই অফিসগুলোতে বর্তমানে যোগ দিচ্ছেন নিজেদের পোর্টফলিও শক্তিশালী করার উদ্দেশ্য নিয়েই।
তবে এটাও সঠিক যে প্রতিবছর এখানে কাজের ক্ষুধা নিয়ে লাখ লাখ নতুন ছেলেমেয়ে চাকরি করতে আসেন। এদের সবার মধ্যেই রয়েছে দ্রুত নিজের জায়গা তৈরি করে নেয়ার পীড়া, ফলে ঘন্টার পর ঘন্টা, নিজের স্বাভাবিক জীবনকে জলাঞ্জলি দিয়ে কাজ করে যাওয়ার মতো মানুষ এই ফার্মগুলো প্রতিনিয়তই পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অভিজ্ঞরা ধীরে ধীরে এই ফার্মগুলো ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ায় যেই শুন্যতা তৈরি হচ্ছে, তা পুরণ হচ্ছে না। ফলে অডিট, কনসালটেন্সি সার্ভিসে গাফেলতির পরিমাণও ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। বর্তমানে বিগ ফোরের মধ্যে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে ডেলোইট, আর সবচেয়ে সমালোচিত ফার্ম হিসেবে পরিচিত হচ্ছে KPMG । অদুর ভবিষ্যতে এই বিগ ফোর আরও ছোট হবে কিনা, তা সময়ই বলে দিবে আমাদের। তবে বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে বলে দেয়া যায়, সামনে কঠিন পরীক্ষা অপেক্ষা করছে বিগ ফোরের জন্য।
আমরা প্রতিনিয়তই চেষ্টা করি আপনাদের কাছে বিজনেস জগতের নতুন এবং অজানা তথ্যগুলো তুলে ধরতে। আপনাদের কিছু ভাল কথা আমাদেরকে অনুপ্রেরনা দেয়। ব্লগটি থেকে নতুন কিছু জেনে থাকলে লাইক, কমেন্ট করুন আর শেয়ার করুন আপনার বন্ধু ও পরিজনের সাথে এবং পরবর্তী ব্লগ পেতে নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করে আমাদের সাথেই থাকবেন।