পনজি স্কিম | বিনিয়োগের আকর্ষণ ও কালো অধ্যায়ের রহস্য উন্মোচন | Ponzi Scheme
কেমন লাগবে যদি কেউ ২ মাসে শত ভাগ লাভের একটি ব্যবসার স্বপ্ন দেখিয়ে আপনার কষ্টের টাকা নিয়ে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়? অল্প সময়ে বেশী মুনাফার আশায় এই সব বিনিয়োগের অফারে যখনি টাকা দিয়েছেন, জেনে রাখুন আপনি পঞ্জি স্ক্যামের ফাঁদে পা দিয়েছেন। এবং বেশী নয়, আর অল্প সময়ের মধ্যেই আপনি হারাতে যাচ্ছেন আপনার সর্বস্ব।
পঞ্জি স্ক্যামের উদ্দেশ্য একটাই—প্রথমে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন এবং তারপর তাদের বিনিয়োগের সর্বস্ব আত্মসাৎ করা।
পঞ্জি স্ক্যাম নামটি এসেছে চার্লস পঞ্জি নামের এক ব্যক্তির নাম থেকে। ১৯২০-এর দশকের গোড়ার দিকে ডাক ব্যবস্থা ঘিরে এক প্রতারণার জাল বিছান চার্লস পঞ্জি।
এই স্ক্যামের নামকরণ চার্লস পঞ্জির নামে করা হলেও এরকম প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের জনক কিন্তু তিনি নন। তার আগেও বেশ কয়েকজন এরকম প্রতারণা করেছেন। ১৮৭৯ সালে সারাহ হাউই প্রথম এ ধরনের স্কিম চালু করেন। কিন্তু পঞ্জির হাত ধরেই মূলত এর প্রসার ঘটে।
কে এই পঞ্জি এবং কি সেই কালো অধ্যায়ের রহস্য?
চার্লস পঞ্জি ছিল ইতালিয়ান নাগরিক,তার জন্ম ১৮৮২ সালে ইতালির লগু শহরে।
তার কর্ম জীবন শুরু হয় একজন পোস্টার ওয়ারকার হিসেবে। উনবিংশ শতাব্দী হতে আমেরিকায় লেণ্ড অফ অপর্চুনেটি হিসেবে পরিচয় পেয়ে এসছিল।
যার ফলে ১৯০৩ সালে অন্যান্য মানুষের মতো চার্লস পঞ্জি আমেরিকার উদ্দেশ্যে জাহাজে করে রওনা হয় ২০০ ডলার নিয়ে। যাত্রা পথে জাহাজের গ্রামলিং এবং তার মদের নেশায় এই ২০০ ডলার শেষ হয়ে বাকী রয়ে যায় মাত্র ২ ডলার।
পঞ্জির পরিবার তার এই অভ্যাসের জন্য তাকে ব্রষ্টন থেকে পিচবার্গে তার এক আত্মীয়র বাড়িতে যাওয়ার জন্য একটি ট্রেনের টিকেট কেটে দিলেও জাহাজে সে অর্থ হারিয়ে ট্রেন ষ্টেশনে যেতে ব্যার্থ হয়। এমন অবস্থায় চার্লস বেঁচে থাকার তাগিদে যখন যে কাজ পেতো তখন সে কাজ করতো। কাজের সন্ধানে সে পায়ে হেটে এবং ট্রেনে চড়ে এক শহর থেকে অন্য শহরে ঘুরে বেড়াতো। এ সময় সে নানান ধরনের কাজ করতেন যেমন -গেরেজের শ্রমিক, ওয়েটার। তবে তার কাজের অভিজ্ঞতা না থাকায় অনেক সময় তাকে কাজ থেকে ছাটাই করা হতো, অনেক সময় ছাটাই হওয়ার ভয়ে সে নিজেই কাজ ছেড়ে দিত। তবে এসব কাজ করতে গিয়ে তার ইংরেজি ভাষার প্রতি দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
নতুন কাজ খুজতে খুজতে ১৯০৭ সালে চার্লস কানাডার মঞ্চল শহরে এসে পৌছান। পৌছানোর সময় তার পকেটে ছিল মাত্র এক ডলার। আসার পর তিনি নোট জাল ও অবৈধ পথে যাতায়াতের জের ধরেও ২ বারে মোট ৫ বছরের জেল খাটেন এবং আবারও ব্রষ্টন শহরে ফিরে আসেন। ১৯১৯ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে নিজেই একটি, এক্সপোর্ট ইনপোর্ট ফার্ম প্রতিষ্ঠিত করেন। সে সময় বিজ্ঞাপনের খরচ ছিলো তার জন্য অনেক বেশি। সে খেয়াল করলো এসব পাবলিকেশন গুলো মাসে মাত্র ৫০০০০ পিস বিজ্ঞাপন ছাপাতে পারে। যা খরচের তুলনা অতটা কার্যকারী নয়।
ফলে সে আরো কম খরচে আরো বেশি পিস পাবলিশের জন্য নিজেই একটি পাবলিকেশন কোম্পানি তৈরি করেন এবং তার মেগাজিনের নাম ছিল “The tradeas guide “। তার উদ্দেশ্য ছিল তার এই ম্যাগাজিন বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় পাবলিশ করার। তবে তার এই ম্যাগাজিন থেকে তার আশানুরূপ লাভ না হলেও এই ম্যাগাজিন একদিন তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
একদিন সকালে চার্লস তার অফিসের মেইল বক্স খুললে দেখতে পায় স্পেনের একটি কোম্পানি তার ম্যাগাজিনের একটি কপি চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। তবে চিঠির চেয়ে বেশি আর্ষনীয় ছিলো চার্লসের জন্য চিঠির সাথে থাকা স্পেনিশ কুপন। আর চিঠির সাথে তখনি এই কুপন দেওয়া হতো যখন মানুষ চিঠির উত্তর চাইতো এবং উত্তরে সকল খরচ নিজেই বহন করতে ইচ্ছুক থাকতো। আর এই কুপন থেকেই চার্লস পঞ্জির প্রতারণা শুরু হয়।
সে সময় বিভিন্ন দেশের ডাক বিভাগ চিঠিপত্র বিনিময়ের জন্য নির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক কুপন ব্যবহার করত। এসব কুপনের স্থানীয় মুদ্রামান একই থাকত- তবে মুদ্রার বিনিময়মূল্যের ওঠা-নামার কারণে অনেক সময় অন্য দেশে আন্তর্জাতিক কুপনের মানও বাড়ত-কমত। এসব কুপনের বিনিময়ে ডাকটিকিট নেওয়ার সুযোগ ছিল। পরে একসময় দেশে দেশে ডাকটিকিটের দামও ওঠা-নামা করতে শুরু করে। চার্লস পঞ্জি এ সুযোগটাই কাজে লাগান।
ইউরোপে কিছু এজেন্ট নিয়োগ করেন তিনি। তাদের দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে এসব কুপন কম মূল্যমানের মুদ্রায় কিনে নিতেন। সস্তায় কেনা এসব কুপনের সঙ্গে তিনি দামি ডাকটিকিট বিনিময় শুরু করেন। এই দুই মূল্যের ব্যবধানের ফলে মোটা অঙ্কের মুনাফা পকেটে ভরতেন পঞ্জি। এই মুনাফার জন্য বিনিয়োগকারীরাও তাঁর কোম্পানিতে অর্থ লগ্নি করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
সে সময় ব্যাংকে টাকা রাখলে বার্ষিক মুনাফা মিলত ৫ শতাংশ। সে জায়গায় পঞ্জির কোম্পানিতে আন্তর্জাতিক কুপন কিনলে ৪০-৫০ শতাংশ মুনাফা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত আইনের মধ্যেই ছিলেন পঞ্জি। কিন্তু একপর্যায়ে ‘সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি’ নামে প্রতিষ্ঠান খুলে বসলেন। এই কোম্পানির কার্যক্রম এমনভাবে উপস্থাপন করলেন, যাতে দেখে সবার মনে হলো এখানে বিনিয়োগ করলে স্বল্প সময়ের মধ্যে মোটা মুনাফা পাওয়া সম্ভব।
আসল ঘটনা হলো, এ কোম্পানিতে পঞ্জির নিজের বিনিয়োগ ছিল একেবারেই কম। তিনি আসলে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নেওয়া টাকাই নানাভাবে ফের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন, যাতে তাঁরা বিশ্বাস করেন যে এই স্কিমের মাধ্যমে সত্যিই ভালো মুনাফা করা যায়। অর্থাৎ চার্লস পঞ্জি আজকের বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নেওয়া টাকা গতকালের বিনিয়োগকারীদের ঋণ পরিশোধে ব্যবহার করতেন।
সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কোম্পানির আন্তর্জাতিক কুপন কিনলে মাত্র ৪৫ দিনে ৫০ শতাংশ এবং ৯০ দিনে ১০০ শতাংশ মুনাফা হবে এমন প্রতিশ্রুতি দেন পঞ্জি বিনিয়োগকারীদের।
প্রথম দিকে বিনিয়োগকারীদের মুনাফা ঠিকমতোই দেওয়া হতো। সে জন্য পঞ্জির ওপর বিশ্বাস এসে পড়ে সবার। কাজেই লোকে তাঁর স্কিমে বিনিয়োগ করার জন্য হামলে পড়ে।
হুড়মুড় করে লোকে পঞ্জির স্ক্যামে বিনিয়োগ করতে থাকেন। হাজার হাজার বিনিয়োগকারীর মধ্যে পঞ্জি এমন বিশ্বাস ঢুকিয়ে দেন যে তিনি তাঁদের সহজে অর্থ উপার্জনের উপায় বাতলে দিচ্ছেন। এভাবে তিনি আট মাসের মধ্যেই দেড় কোটি ডলার আয় করে ফেলেন।
কিন্তু এরপরই তাঁর প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড নিয়ে লেখালেখি শুরু হয় পত্রপত্রিকায়। তার জের ধরে তদন্তে নামে মার্কিন আইনরক্ষা বাহিনী। তদন্তে বেরিয়ে আসে পঞ্জিতে বিনিয়োগ শুধুই একটি ধোকার নাম–এতে আসলে কোনো মূল ব্যবসা নেই। ১৯২০ সালের ১২-ই আগস্ট গ্রেপ্তার হন তিনি।
একটি পঞ্জি স্কিমের অ্যানাটমি ঃ-
বিনিয়োগের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো গ্রাহকের মন জয় করা,আর গ্রাহকের মন জয় করে বিনিয়োগের বিস্তার যে করতে পারে,সেই হতে পারে বিনিয়োগ রাজ্যের রাজা । আর এই মন জয় করায় অনেক এগিয়ে আছে পঞ্জি স্কিমের কোম্পানিগুলো। তারা প্রথমে মানুষের মন জয় করে । তার পর গাছের শিকড়ের ন্যায় মানুষের মাঝে বিস্তার করে আর তাদের বিস্তারের এই লোভনীয় পরিকল্পনা থেকে মূল পরিকল্পনাকারী ও প্রাথমিক সদস্যরাই কেবল লাভবান হতে পারেন। তাছাড়া এরা গ্রাহকদের নানান ধরনের লোভনীয় প্রস্থাব দিয়ে থাকে। যেমন -স্বল্পমেয়াদে মুনাফা সহ বিনিয়োগ ফেরৎ পাবার টোপ দেখিয়ে নতুন নতুন গ্রাহক তৈরি করা হয়। নতুন গ্রাহকরা মনে করেন, তারা যদি আরও কিছু গ্রাহককে ঘোষিত স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন তবে তার মুনাফা আরো বাড়বে। যার ফলে দিন দিন গ্রাহক বৃদ্ধি হতে থাকে, এবং নতুন গ্রাহকের বিনিয়োগেয় অর্থ দ্বারা তারা পূরাতন গ্রাহকদের লভ্যাংশ দিয়ে থাকে।
আর এটাই তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ ছাড়াও তাদের আরো কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেমন-
১. অল্প বিনিয়োগে বিশাল মুনাফার আশ্বাস,
২. আয়ের প্রবৃদ্ধি ও ব্যবসা বাড়ানোর পরিকল্পনা স্পষ্ট না করা,
৩. অতিরিক্ত ধারাবাহিক রিটার্ন,
৪. অনিবন্ধিত বিনিয়োগ
৫. প্রাথমিক বিনিয়োগকারীদের টাকা বিশাল মুনাফাসহ ফেরত দিয়ে তাদেরকে আরও বিনিয়োগে প্রলুব্ধ করা।
৬.বিনিয়োগ কারীকে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করায় উৎসাহ করা এবং লভ্যাংশ বৃদ্ধির করার লোভ দেখানো।
৭. লভ্যাংশর টাকা দিয়ে বিনিয়োগে উৎসাহ করা।
বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য পঞ্জি স্ক্যাম >
পৃথিবীতে অনন্য দেশের মতো বাংলাদেশে নানান সময় নানান ধরনের পঞ্জি স্ক্যাম সংঘটিত হয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ঃ
ডেসটিনি–>
বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পঞ্জি স্কিমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ডেসটিনি। ইহার দূর্নিতির পরিমাণ এতটা ভয়াবহ যে দূর্নিতির তালিকা দেখলে মানুষের মাথা ঘুরে যাবে।
ডেসটিনি গ্রুপ বাংলাদেশের একটি বাণিজ্য গোষ্ঠী। তাদের প্রধান কোম্পানি ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেড তাদের পণ্যসমূহ এমএলএম পদ্ধতিতে সরাসরি বিক্রয়ের (ডিরেক্ট সেল)-এর মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করত। ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেড এমএলএম বাণিজিক্যক পদ্ধতির মাধ্যমে চার হাজার কোটি টাকা অর্থ আত্মসাৎ সম্পর্কিত জালিয়াতির এবং বিদেশে অর্থ পাঁচার এর সম্ভাব্য অভিযোগের কারনে মূলধারার গণমাধ্যমে সমালোচিত এবং বাংলাদেশী আইনে দন্ডপ্রাপ্ত হয়েছিল।
বর্তমানে ডেসটিনি গ্রুপের মাত্র ২টি প্রতিষ্ঠান চলমান রয়েছে (যেমন- দৈনিক ডেসটিনি এবং বৈশাখী টেলিভিশন)। বাকি সকল সহযোগী কোম্পানীর ব্যাংক হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংক ও মহামান্য আদালতের নির্দেশে স্থবির করে রাখা হয়েছে। ফলে তারা বাকি সহযোগী কোম্পানীগুলো পরিচালনা করতে পারবে না। বর্তমানে মহামান্য হাইকোর্টে এ বিষয় নিয়ে মামলা চলমান রয়েছে। এছাড়াও
’বিতর্কিত বহুস্তর বিপণন (এমএলএম) পদ্ধতির ব্যবসায়ের নাম করে এক যুগ ধরে মানুষের কাছ থেকে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছিল ডেসটিনি। ২০১২ সালে ধরা পড়ার পর কেটে যায় আরও আট বছর। অথচ এত বছরেও গ্রাহকদের কেউ কোনো টাকা ফেরত পাননি। ডেসটিনির নিজের হিসাবেই তাদের ক্রেতা, পরিবেশক ও বিনিয়োগকারী মিলে ৪৫ লাখ।
এছাড়া ও বিভিন্ন সময়ে ডেস্টিনির নানান গ্রুপের কর্মিদের উপর অর্থ জালিয়াতি ও দূর্নিতির অভিযোগ বেরিয়ে এসেছে।
ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমীন এবং ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইন জামিন দূর্নিতিতে অভিযুক্ত হয়েছিলেন।
যুবক—-ঃ
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ যুবকের উৎপত্তি হয় বাংলাদেশে।
যুবকের নিবন্ধনও নেওয়া হয় ১৯৯৬ সালে। তারাও নানা প্রলোভন দেখিয়ে জনগণের কাছ থেকে সঞ্চয় সংগ্রহ করে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। ২০০৬ সালেই বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে বেরিয়ে আসে যুবকের বিরুদ্ধে অবৈধ ব্যাংকিংসহ নানা প্রতারণার চিত্র। এরপর যুবক বিষয়ে ২০১০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিনকে প্রধান করে একটি কমিশন (প্রথম কমিশন) গঠন করেও তেমন লাভ হয়নি। অর্থ ফেরত পাননি এর গ্রাহকেরা। সর্বশেষ হিসাবে যুবকের ৩ লাখ ৩ হাজার ৭৩৯ ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকের পাওনা ছিল ২ হাজার ৫৮৮ কোটি ১১ লাখ টাকা।
এসডিএস ও আইটিসিএল —–ঃ
সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট সংসদ (এসডিএস) ও ইসলামিক ট্রেড অ্যান্ড কমার্স লিমিটেড (আইটিসিএল) ছিল নব্বইয়ের দশকের পঞ্জি ব্যবসা। শুরু হয়েছিল টাঙ্গাইল থেকে। মূলত উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে প্রতিষ্ঠান দুটি গ্রাহকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করেছিল। ১৯৯৬ সাল থেকে আইটিসিএল অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম চালালেও বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের নিষিদ্ধ করে ২০০২ সালে এসে। তত দিনে সর্বস্বান্ত হাজার হাজার গ্রাহক। এর প্রতিষ্ঠাতা ইসমাইল হোসেন সিরাজী তখন থেকে পলাতক থাকলেও ধরা পড়েছিলেন ২০১৭ সালে। এসডিএস ও আইটিসিএল এ দুটি যৌথ ভাবে ছিল বাংলাদেশে প্রথমদিকের পঞ্জি স্কিম গুলোর মধ্যে একটি। আর এই পঞ্জি স্কিমের কারণে নব্বই দশকের হাজারো মানুষ সর্বশ্ব হারিয়েছে।
ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য পঞ্জি স্কিম ঃ
আধুনিক ইতিহাসের বেশ কিছু পঞ্জি স্ক্যাম রয়েছে, যাদের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে লক্ষ মানুষ সর্বস্ব হারিয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
মানিট্রন স্কিম—১৯৯১
আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ: ৮৬ কোটি ডলার এই স্কিমের হোতা জাঁ-পিয়েরে ভ্যান রোসেম। ভ্যান রোসেম তার বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান মানিট্রনের মাধ্যমে এই স্কিম চালান। মানিট্রন দাবি করত তারা একটা কম্পিউটার মডেল ব্যবহার করে বাজারের অবস্থার কথা বলে দিতে পারে। অর্থনীতির ব্যাকগ্রাউন্ড কাজে লাগিয়ে ভ্যান রোসেম ‘স্টক মার্কেট গুরু’ হিসেবে সুনাম কুড়িয়ে নেন। ফলে বহু গ্রাহক বাগিয়ে নেন তিনি। তার গ্রাহকদের মধ্যে বেলজিয়ান রাজপরিবারের কয়েকজন সদস্যও ছিলেন।
বিনিয়োগকারীদের যেসব চেক দিয়েছিল, সেগুলো একের পর এক বাউন্স করতে থাকলে মানিট্রন ভেঙে পড়ে। এরপরই গ্রেপ্তার হন ভ্যান রোসেম।
১৯৯১ সালে প্রতারণার দায়ে রোসেমকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কারাবাস এড়ানোর জন্য তিনি রাজনীতিতে ঢোকেন। তার এ কৌশল কাজেও লেগে যায়। কয়েক বছর বেলজিয়ামের সংসদে দায়িত্বও পালন করেন তিনি।
উল্লেখ্য, ১৯৮০-র দশকের শেষ দিকে ফর্মুলা ১ রেসিং টিম অনিক্স গ্র্যান্ড প্রিক্স-এর অন্যতম মালিক ছিলেন ভ্যান রোসেম।
কারিতাস স্ক্যাম—১৯৯৪
আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ: ১০০-৫০০ কোটি ডলার।
অ্যাকাউন্টেন্ট ইয়োয়ান স্টয়কা এই স্কিমের হোতা। এ স্কিম ছাড়া হয় দারিদ্র্যপীড়িত রোমানিয়ানদের টার্গেট করে। স্টয়কা আমানতকারীদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, ৩ মাসের মধ্যে তাদের ৮০০ শতাংশ বেশি টাকা ফেরত দেওয়া হবে। ৩০ লাখ রোমানিয়ান এই স্কিমের ফাঁদে পা দেন। লোকের মনে বিশ্বাস তৈরির জন্য কারিতাস নিয়মিত স্থানীয় পত্রিকায় বিজয়ীদের তালিকা প্রকাশ করত।
কিন্তু ১৯৯৩ সালের অক্টোবরে কারিতাস বিজয়ীদের টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এর কদিন পরই মানুষ জানতে পারে, প্রতিষ্ঠানটি ৪৫ কোটি ডলার দেনায় আছে।
১৯৯৪ সালে স্টয়কাকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রতারণার অপরাধে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাকে। কিন্তু ২ বার আপিলের পর তার শাস্তির মেয়াদ কমিয়ে মাত্র দেড় বছর করা হয়।
বিধ্বংসী প্রভাব :
নিউটনের তৃতীয় সূত্র – প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে।
আর পঞ্জি স্কিম ফাঁদে যারা পা দেয় তাদের জীবনের বিপরিত প্রতিক্রিয়া বড়ই ভয়াবহ রূপ ধারণ করে পরিবারে এবং সমাজে।
কখনো কখনো বিপরীত প্রতিক্রিয়া এতটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে যে,মানুষ তার জীবন মৃত্যুকে ডেকে আনতে ও দ্বিধা বোধ করে না। এসব পঞ্জি স্কিমের ফাঁদে পা দিয়ে আত্নহত্যাও করেছে এমন মানুষের সংখ্যা অগণিত। আর এই আত্নহত্যাও করে মানুষ সামাজিক চাপে পড়ে।
পঞ্জি স্কিমের দেওয়া লোভনীয় প্রস্তাবে মানুষ তার আত্মীয়-স্বজন,বন্ধু-বান্ধব,পাড়া-প্রতিবেশী কে বিনিয়োগ করতে উৎসাহ করে।আর যখন পঞ্জি স্কিমের কোম্পানি গুলো পালিয়ে যায়,তখন আত্মীয়-স্বজন,বন্ধু -বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী রা ওই ব্যাক্তির কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করে যারা তাদের বিনিয়োগে উৎসাহ করেছিল।
আর এসব কারণে অনেক কে নিজের ঘর বাড়ি, জায়গা জমি বিক্রি করে মানুষ কে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। আর যারা দিতে পারেনা তাদের পালিয়ে যেতে হয় নয়ত আত্নহত্যার পথ বেছে নেয়।
মানুষ কে তার সমাজ থেকে বঞ্চিত করতে,পরিবার থেকে আলাদা করতে,বন্ধুত্ব ও আত্নীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করতে এই পঞ্জি স্কিম হলো একটি বিষাক্ত টোপ।
যে টোপ হাজারো মানুষের আলোকিত জীবন অন্ধকার হওয়ার পিছনের কালো অধ্যায়।
শিক্ষাঃ
“অতি লোভে, তাঁতি নষ্ট “!
অর্থের লোভে মানুষ কখনো কখনো সর্বস্ব হারায়। আর এই মানুষের সর্বস্ব হারানোর পিছনে রয়েছে লোভ এবং ধৈর্যের অভাব। ধৈর্য না ধরে ক্ষণিকের মাঝে বড়লোক হওয়ার লোভ যাদের গ্রাস করেছে তারাই নানা সময়ে নানান ধরনের প্রতারণার স্বীকার হয়েছে। আর সেসব প্রতারণার মধ্যে উল্লেখযোগ্য এবং অন্যতম প্রতারণা হলো পঞ্জি স্কিম।
বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর সকল দেশের মানুষ নানান সময়ে নানান ধরনের পঞ্জি স্কিমের স্বীকার হয়েছে। আর এর জন্য দাই মানুষের লোভ এবং দ্রুত কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন। মানুষ কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখে,আর সেই স্বপ্ন পূরণে নানান সময়ে নানান ধরনের প্রতারনার স্বীকার হয়। স্বপ্ন পূরণে সঠিক সময়ে ধৈর্য সহকারে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়াটাই হলো বুদ্ধিমানের কাজ।
অর্থের লোভে যারা ধৈর্য হারিয়ে রাতারাতি কোটিপতি হতে চায়,তাঁরাই পঞ্জি স্কিম নামক প্রতারণার ফাঁদে পরে।
ছোট একটা সারমর্মঃ
জীবন বেঁচে থাকতে অর্থের কোন বিকল্প নেই! আর সেই অর্থ কিভাবে উপার্জন করবেন তা আপনার একান্তই ব্যাক্তিগত ব্যাপার। তবে আপনাদের প্রতি আমাদের একটি ছোট্ট রিকোয়েস্ট, জীবনে যখন যেই পদক্ষেপ নিবেন,তা ঠান্ডা মস্তিষ্ক এবং ধৈর্য সহকারে নিবেন। কেননা আপনার একটি ভূল উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারে আপনার জীবনের চাকা।
লোভে পড়ে, ধৈর্য হারিয়ে, নিজের জীবন কে ঝুকিতে ফেলবো কি?
সবি আমাদের চিন্তার বিষয়, আসা করি এ সম্পর্কে আপনাদের মতামত আমাদের জানাবেন! সব সময় আমাদের ওয়েবসাইট এর সাথে থাকবেন। আমাদের ব্লগ ভালো লাগলে এবং পরবর্তী ব্লগ পেতে নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করে আমাদের সাথেই থাকবেন।
very informative video. I was researching on Scam all over the world and this video came across and I. find it very helpful. keep growing